(প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক ওটেন সাহেবের নিগ্রহের ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ওই কলেজেরই ছাত্র অনঙ্গমোহন দাম। বিভিন্ন তথ্য ও বয়ানে স্পষ্ট— নেতাজি নন, অধ্যাপক নিগ্রহে মূল ভূমিকা ছিল অনঙ্গমোহনেরই। ওটেন নিগ্রহের ঘটনার জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ, হিন্দু হস্টেল। প্রেসিডেন্সির ওই ঘটনার পর বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অনঙ্গমোহন। ছয় বছরের জেল হয়েছিল তাঁর। সিলেটের আদি বাসিন্দা এই মানুষটি দেশভাগের কয়েকবছর পর থেকে দীর্ঘ সময় উত্তর ২৪ পরগনার উদ্বাস্তু নগরী অশোকনগরে বসবাস করেছেন। ইতিহাসের ধুলো উড়িয়ে সেদিনের উত্তাল দিনগুলি আর উপেক্ষিত বিপ্লবী অনঙ্গমোহন দামের জীবনের বিভিন্ন দিককে তুলে ধরেছেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।)

প্রেসিডেন্সি কলেজের  অধ্যাপক ই. এফ. ওটেনকে নিগ্রহের ঘটনায় অনঙ্গমোহন দাম ও সুভাষচন্দ্র বসুকে বহিষ্কারের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা কলকাতা। ছাত্র বিক্ষোভের এমন চেহারা দেখে রীতিমতো ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। সেই কারণে অধ্যক্ষের অজান্তেই প্রেসিডেন্সি কলেজ ও হিন্দু হস্টেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নেতাজি ও অনঙ্গমোহন দাম বহিষ্কৃত হওয়ার ৯৪ বছর পর, ১৯৯৬ সালে, প্রেসিডেন্সির অধ্যক্ষ ড. অমলকুমার মুখোপাধ্যায় অনঙ্গমোহন দামের সাসপেনশন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত লিখিত ভাবে তাঁর পুত্র আশিস দামের হাতে তুলে দেন।

ওটেন লাঞ্ছিত হওয়ার পর বংশীলাল নামে প্রেসিডেন্সির একজন বেয়ারা অধ্যক্ষ জেমসকে জানিয়েছিলেন, হামলাকারীরা বেকার ল্যাবরেটরির দিকে পালিয়ে গেছে। ওই দিকে ইডেন হিন্দু হস্টেলে যাওয়ার পথ। এরপর সেই রাতে বংশীলালকে নিয়ে জেমস হিন্দু হোস্টেলে চড়াও হন। কলেজ ও হস্টেলের গেটে তালা লাগিয়ে দেন অধ্যক্ষ জেমস। ওই রাতে অনঙ্গমোহন দাম হস্টেলে ছিলেন না। নিগ্রহের সময়ে উপস্থিত আর এক ছাত্র বিপিন দে তখন ওয়ার্ডে ছিলেন কিনা জানা যায়নি। বংশীলাল সেই রাতে কোনও ছাত্রকেই সনাক্ত করতে পারেনি। পরের দিন সকাল ১১টায় অধ্যক্ষ তাঁর চেম্বারে ‘কালো তালিকা’য় থাকা ছাত্রদের ডেকে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিলেন। আড়াল থেকে সুভাষচন্দ্র বসু ও অনঙ্গমোহন দামকে সনাক্ত করেছিল বেয়ারা বংশীলাল। ঘটনার চারদিন পর ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬ প্রেসিডেন্সি কলেজের গর্ভনিং বডি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, “Subhas Chandra Bose and Ananga Mohan Dam be expelled from the college for taking a leading part in the assault of Professor Oaten.” এই সিদ্ধান্তের পর ছাত্র বিক্ষোভের জেরে বেসামাল ব্রিটিশ সরকার অধ্যক্ষের অজান্তেই প্রেসিডেন্সি কলেজ ও হিন্দু হস্টেল বন্ধ করে দেয়।

১৯১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় একটি সরকারি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। যাতে জানানো হয়,, মিস্টার হেনরি. আর. জেমস কাউন্সিল-ইন-চার্জ অফ এডুকেশনের সদস্য মিস্টার লিয়নকে অপমান করেছেন। তাই তাঁকে প্রেসিডেন্সির অধ্যক্ষের পদ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি এ-ও জানানো হয়, প্রেসিডেন্সি বিভাগের স্কুল পরিদর্শক ডবল্যু.সি.ওয়ার্ডসওয়ার্থকে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষে র পদে নিযুক্ত করা হয়েছে। আর বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ জেমসকে প্রেসিডেন্সি বিভাগের বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি ওই পদে যোগ দেননি। পরে অবশ্য ক্ষমা চেয়ে তিনি ওই পদে যোগ দিয়ে ছুটির আবেদন করেন। প্রেসিডেন্সির ঘটনার জেরে দীর্ঘ ছুটির পর অবসর গ্রহণের নির্ধারিত সময়ের ২১ মাস আগেই ইন্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিস থেকে তিনি বিদায় নিতে বাধ্য হন।

ওটেনকে নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। সেই তদন্ত কমিটির প্রথম সভা ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬ কলকাতা হাইকোর্টে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের চেম্বারে বেলা আড়াইটায় শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকার দ্রুত তদন্ত শেষ করতে চেয়েছিল। প্রতিদিনই কমিটির বৈঠক হতো। কমিটি ১৯১৬-র ১০ মার্চ তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করে। ২৭ মে, ১৯১৬ ক্যালকাটা গেজেটে কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ওটেন নিগ্রহের ঘটনায় কারা কারা যুক্ত ছিল— সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি তদন্ত কমিটি। সেই প্রসঙ্গটি দেখার ভার কমিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ ও গর্ভনিং বডির উপর অর্পণ করে।

এদিকে, প্রেসিডেন্সি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর সুভাষচন্দ্র বসু স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্র অনঙ্গমোহন দাম আর উচ্চশিক্ষা চালানোর কোনও আগ্রহ প্রকাশ করেননি। ওটেন নিগ্রহের ঘটনার পর স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা নিয়ে অনঙ্গমোহন দাম ও সুভাষচন্দ্র বসু গোপন বৈঠক করেছিলেন। সেই বৈঠকের খবরে ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল। তবে বৈঠকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বিষয়ে অন্যান্য অনেক স্বদেশীর সঙ্গে সহমত হতে পারেননি সুভাষ। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, “India’s freedom depended upon a process of natural reconstruction”. বৈঠকে অনঙ্গমোহন দাম-সহ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ ছিল— এমন স্বদেশী আন্দোলনের সৈনিকরা যোগ দিয়েছিলেন। ওই গোপন বৈঠক সম্পর্কে জানা যায় যে, “The Raj’s intelligence and security branch, the Criminal Investigation Department(CID), kept this clique under surveillance.” এর কিছু দিন পরেই অনঙ্গমোহন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে প্রায় ছয় বছর কারাজীবনের পর তিনি মুক্তিলাভ করেন। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে গান্ধিজির ডাকে অসহযোগ আন্দোলন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কারাবরণ করায় পূর্ব ভারতে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিপ্লবী অনঙ্গমোহন দাম। 

স্বাধীনতা ও দেশভাগের আগে ১৯৪৬–এ শ্রীহট্ট থেকে অনঙ্গমোহন দাম গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তবে এর আগে তিনি ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি বা ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের আইনসভায় আসামের জনগণনা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে অনঙ্গমোহন দামের নাম উল্লেখ রয়েছে। ভারত সরকারের ফাইল নম্বর. ২/৩/৪১-পাবলিক, ১৯৪১ The Govt. of India, Home Deptt. Public-ওই ফাইলে আসামের জনগণনা  সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, “Proposed resolution in the legislative Assembly by  Mr. Ananga Mohan Dam relating to the census figures of Assam”. ওই ফাইলের নোট থেকে স্পষ্ট, ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতের আইনসভার (ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি বা ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি) সদস্য ছিলেন অনঙ্গমোহন দাম।

স্বাধীনতা সংগ্রামে আজীবন নিবেদিত অনঙ্গমোহন ইতিহাসে যথাযোগ্য মর্যাদা পাননি। এমনকি, প্রেসিডেন্সি কলেজে সুভাষচন্দ্রের মূর্তি স্থাপন হলেও উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন এই বিপ্লবী—  যিনি ওটেনকে মারার ব্যাপারে মূল ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে খোদ নেতাজি স্বীকার করে গিয়েছেন।

4 COMMENTS

  1. […] অনঙ্গমোহনের মারের পরই বন্ধ প্রেসিডেন… ভাইসরয়কে বোমা, পরে সম্বর্ধনা! ব্রিটিশকে ঘোল খাইয়েছিলেন রাসবিহারী Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleনজিরবিহীন বন্যায় এখনও ভাসছে শিলচরNext articleফাঁক সুকুমার মিত্রhttps://balihas.com/ […]

  2. […] অনঙ্গমোহনের মারের পরই বন্ধ প্রেসিডেন… Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleবন্যার সময় ভেসে থাকবে ‘উভচর বাড়ি’Next articleকালজয়ী এক বাংলা গানের আশ্চর্য সফর মোহসীন উল হাকিমhttps://balihas.com/ […]

  3. […] অনঙ্গমোহনের মারের পরই বন্ধ প্রেসিডেন… Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleএকটি অসমাপ্ত কাহিনী -৬Next articleবুঝলাম, আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত একা নিতে পারবে না মাস্টার বালিহাঁস ডেস্ক […]

Comments are closed.