রেলগাড়ি ঝমাঝম। কলকাতায় আরও একটি মেট্রো লাইন সেক্টর ফাইভ থেকে শিয়ালদহ চালু হয়ে গেল। এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা– কবে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর লাইন হাওড়া ময়দান থেকে শিয়ালদহ অব্ধি চালু হয়। গঙ্গার নিচ দিয়ে মেট্রো, ভারতে এটাও প্রথমবার। বউবাজারে ধস নেমে টানেল বোরিং মেশিন আটকে না গেলে হয়তো এতদিনে হাওড়া থেকে সেক্টর ফাইভে মেট্রো চালু হয়ে যেত। 
পাশাপাশি আরও একটি মেট্রোরুট জোকা-বিবাদিবাগ নিয়েও হয়তো দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে। শোনা যাচ্ছে, অগস্ট মাস থেকেই বেহালা মেট্রোর ট্রায়াল রান শুরু হবে। রিটায়ার করে ফেলা নন-এসি মেট্রো রেকগুলো নোয়াপাড়ার কারশেডে পড়ে ছিল। সেইগুলো দিয়েই আপাতত ট্রায়াল রান হবে। মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ তাতে কিছুটা হলেও কমবে আর এলাকার প্রোমোটারদের পোয়াবারো হবে। ফ্ল্যাটের দাম স্কয়ারফিটে আরও কিছুটা বেড়ে যাবে৷ 

কিন্তু চালু হবার আগেই বেহালা মেট্রো একটি রেকর্ড করে বসে আছে! সবচেয়ে বেশিদিন ধরে চলা মেট্রো প্রজেক্ট হিসাবে ভারতের মধ্যে তার নাম সবার আগে। ২০০৯ সালে কাজ শুরু হওয়া বেহালা মেট্রো যাওয়ার কথা জোকা থেকে এসপ্ল্যানেড হয়ে  বিবাদি বাগ পর্যন্ত। হাওড়া ময়দান থেকে গঙ্গার তলা দিয়ে আসা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর মহাকরণ স্টেশন হবে এই জোকা মেট্রোর সংযোগ বিন্দু। স্টেশনগুলি হল মহাকরণ, ধর্মতলা, পার্কস্ট্রিট, ভিক্টোরিয়া, খিদিরপুর, মোমিনপুর, মা ঝেরহাট,  তারাতলা, বেহালা বাজার, চৌরাস্তা, সখের বাজার, ঠাকুরপুকুর, জোকা। আজ এই ২০২২-য়ে দীর্ঘ তেরো বছর ধরে জোকা থেকে তারাতলা অব্ধি কাজ শেষের পথে। বাকিটা এখনো বিশ বাঁও জলে। 
আশ্চর্যের কথা হল, আজ থেকে একশো বছর আগে বেহালা দিয়ে চলত ট্রেন৷ আজ সেই ভুলে যাওয়া ইতিহাসের গল্প করি৷ ম্যাকলয়েড লাইট রেলওয়ে কোম্পানি বেহালার ঘোলসাহাপুর থেকে ফলতা অব্ধি ন্যারোগেজ লাইন দিয়ে রেল চালাতে শুরু করে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ১৯২০-তে এই লাইনটিকে বাড়িয়ে আদিগঙ্গার ধারে চেতলার অপর প্রান্তে নিয়ে আসা হয়। কালিঘাট মন্দিরের দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য।  বর্তমানে শিয়ালদহ-বজবজ লাইনের রবীন্দ্র সরোবর এবং মাঝেরহাট স্টেশনের মাঝে একটি ছোট্ট স্টেশন নিউ আলিপুর৷ ছোটবেলায় আমি নিউ আলিপুর মালটিপারপাস স্কুলে পড়তাম। স্কুলের সামনে দিয়েই চলে গিয়েছে দুর্গাপুর ব্রিজ৷ তলায় শিয়ালদহ বজবজ লাইন। পাশেই নিউ আলিপুর স্টেশন। তার পাশে বিশাল রেলওয়ে সাইডিং। পাথর, কয়লা, সিমেন্ট নামানোর জন্য। এই জায়গাটাকে সবাই কালিঘাট সাইডিং বলেই ডাকত। এখান থেকেই একশো বছর আগে ছাড়ত কালিঘাট ফলতা ন্যারোগেজ রেল। ওখান থেকে চেতলার ভিতর দিয়ে পায়ে হাঁটা রাস্তা ছিল কালিঘাট মন্দিরে যাওয়ার।
স্বাধীনতার পর ১৯৫৭ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই রেলওয়ে। ব্রিটিশ আমলে এমন অনেক প্রাইভেট কোম্পানি ভারতে রেল চালাতো। স্বাধীনতার পরে তার অধিকাংশই ভারতীয় রেল অধিগ্রহণ করে। ম্যাকলয়েড কোম্পানির এই লাইন কেন অধিগ্রহণ করেনি সেটাও ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়। করলে জোকা-বিবাদি বাগ মেট্রো নিয়ে আপামর বেহালা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এমন তীব্র চাহিদা তৈরিই হতো না। 

রেল বন্ধ হবার পর লাইন তুলে দিয়ে রাস্তা করা হয়। যার বর্তমান নাম জেমস লং সরণি। যার পাশেই আমাদের বাড়ি। এখনো পুরোনো লোকেরা এই রাস্তাকে রেললাইন বলে ডাকে। বাড়ির সামনেই ছিল ঠাকুরপুকুর স্টেশন। আজও জেমস লং সরণি থেকে ডায়মন্ড হারবার কানেক্টিং রাস্তাটার নাম স্টেশন রোড। বেহালায় জেমস লং সরণির ধারের বিশাল মাঠের নাম KFR গ্রাউন্ড। পুরো নাম হল কালিঘাট ফলতা রেলওয়ে গ্রাউন্ড। 
১৯৫৬ সালে রিলিজ করে দেবকী কুমার বসু পরিচালিত বাংলা ছবি ‘নবজন্ম’। শ্রেষ্ঠাংশে উত্তমকুমার, অরুন্ধতী দেবী, কানু বন্দোপাধ্যায়, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, তুলসী চক্রবর্তী। এই সিনেমাটির একটি বড় অংশের শুটিং হয় কেএফআর রেলওয়ের ঠাকুরপুকুর স্টেশনে। বাবার বন্ধু চিত্র পরিচালক অমল সুরের কাছে এই ছবির শুটিং এর অনেক গল্প শুনেছি৷ দেবকী বোসের আরও একটি হিট ছবি ১৯৪৯-য়ে রিলিজ হওয়া ‘কবি’। নায়ক ছিলেন রবীন মজুমদার। এই ছবিরও শুটিং হয়েছিল আমাদের বাড়ির সামনের কালিঘাট ফলতা রেললাইনে। ঠাকুমার মুখে গল্প শুনেছি শুটিংয়ের অবসরে দেবকী বোস আর রবীন মজুমদার নাকি আমাদের বাড়ির উঠোনে মোড়ায় বসে চা খেয়ে গেছেন৷ 
আমার বাবার এখন ৮৪ বছর বয়েস। বাবা ছোটবেলায় এই কেএফআর রেল চড়ে মামারবাড়িতে যেত। জানিনা কবে জোকা-বিবাদিবাগ মেট্রো চালু হবে! হলে বাবাকে অবশ্যই একদিন নিয়ে গিয়ে চড়াবো৷ একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে৷