(অধ্যাপক ওটেনের নিগ্রহের পর সুভাষচন্দ্র বসু ও অনঙ্গমোহন দামের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে প্রেসিডেন্সি কলেজের লেগে গিয়েছিল আশি বছর। ভারত স্বাধীন হওয়ার ৪৯ বছর পর, ইংরেজ জমানার সিদ্ধান্ত খারিজ করে প্রেসিডেন্সির অধ্যক্ষের চিঠি পৌঁছেছিল অনঙ্গমোহনের পরিবারের কাছে। লিখেছেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।)
প্রেসিডেন্সি কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ইংরেজ সরকারের নিষিদ্ধ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্বাধীনতা সংগীত-‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ ছাত্ররা গেয়ে উঠলে অধ্যাপক ওটেন ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বক্তব্য রাখা শুরু করেন। প্রতিবাদে সোচ্চার হন প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা। অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজে ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয়। কিছুদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬-য় ফের ছাত্রদের সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন ওটেন। সেই সময়েই হিন্দু হস্টেলের আবাসিকরা প্রহার করেন ওটেনকে। রটে যায়, নেতাজি মেরেছেন ওটেনকে। সুভাষচন্দ্র পরে জেলজীবনের সঙ্গী নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন, ওই ঘটনায় উনি ছিলেন না। ওটেনকে মেরেছিলেন হিন্দু হস্টেলে থাকা ‘বাঙাল’ অনঙ্গমোহন দাম।
ওটেনকে সুভাষ কখনেও মারতে চাননি নিবন্ধে দেবব্রত মণ্ডল উল্লেখ করেছেন যে, সুভাষ এই মারামারিতে না থাকলেও বেয়ারা বংশীলালের সাক্ষ্য অনুযায়ী সুভাষ এবং অনঙ্গমোহন দাম— দু’জনকেই কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ওটেনকে মারার অভিযোগের সূত্র ধরে অনঙ্গমোহন দাম ও সুভাষচন্দ্র বসু প্রসঙ্গে ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬ তে প্রেসিডেন্সি কলেজের গভর্নিং বডির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, “Subhas Chandra Basu and Ananga Mohan Dam be expelled from the college for taking a leading part in the assault on Professor Oaten”. এরপর বহু জল গড়িয়েছে। ব্রিটিশকে এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। ভারত স্বাধীন হয়েছে। প্রেসিডেন্সি কলেজের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের ৮০ বছর পর আর স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর দুই স্বাধীনতা সংগ্রামীর কলেজ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। ২২ জানুয়ারি, ১৯৯৬ নেতাজি জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করে নেন। ৭ মার্চ, ১৯৯৬ প্রেসিডেন্সি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক অমলকুমার মুখোপাধ্যায় একটি চিঠিতে (রেফারেন্স নম্বর-৪১৩) অনঙ্গমোহন দামের কন্যা শান্তা নন্দীকে তাঁর শিলচরের বাড়ির ঠিকানায় ডাকযোগে জানিয়ে দেন, “I, as Principal of the College, made a formal declararation that the expulsion order on Subhas Chandra Bose and Ananga Mohan Dam has been withdrawn and that we acknowledge both of them as illustrious students of Presidency College.” অনঙ্গমোহন দামের বড় ছেলে আশিসকান্তি দামের কথায়, “প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ ড. অমল কুমার মুখোপাধ্যায় আশা করেছিলেন যে আমার স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবার সম্পর্কে কিছু নতুন তথ্য দিয়ে আমি তাঁকে সমৃদ্ধ করতে পারব। আমি তা পারিনি। কারণ, বাবা ছিলেন প্রচারবিমুখ। তাছাড়া, তাঁকে নিয়ে কোথাও কিছু লেখালেখি রয়েছে কিনা তা-ও আমাদের বা আমার জানা ছিল না। এক সময় অনঙ্গমোহনদের জমিদার পরিবার দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে এ পারে চলে আসে। আর পাঁচটা উদ্বাস্তু পরিবারের মতোই জীবন সংগ্রামই প্রাধান্য পেয়েছিল পরিবারের সদস্যদের কাছে। কিন্তু ইতিহাস গবেষকদের লেখায় তেমন গুরুত্ব না পাওয়ার আক্ষেদ রয়েছে বিপ্লবী পরিবারের।
ওটেনকে কে মেরেছিলেন, এই প্রশ্ন তুলে তাঁর বইয়ে বারিদবরণ ঘোষ উল্লেখ করেছেন, স্টুডেন্ট কনসালটেটিভ কমিটির সম্পাদক ভোলানাথ রায়, সুধীন্দ্রলাল রায়, দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অনঙ্গমোহন দামরা ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসুর বন্ধু। যদিও অনঙ্গমোহন দাম ছিলেন সুভাষচন্দ্রের থেকে তিন বছরের বড়। সুভাষ যখন তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া অনঙ্গমোহন তখন ষষ্ট বর্ষের ছাত্র। জন্মসূত্রে সিলেটের বাসিন্দা অনঙ্গমোহন থাকতেন হিন্দু হস্টেলে। তবে কলকাতায় ১ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে তাঁর একটি লাইব্রেরি ছিল। হিন্দু হস্টেল ও অনঙ্গমোহন দামের লাইব্রেরির উপর নজর ছিল ব্রিটিশ পুলিশের। আদতে দুটিই ছিল ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের ঘাঁটি। ছাত্রবস্থায় যুগান্তর দলের পাশাপাশি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্সির এক দল ছাত্রের ঘনিষ্ট যোগাযোগের খবর ব্রিটিশ পুলিশের অজানা ছিল না। তিনি ওই লাইব্রেরি থেকেই অনঙ্গমোহন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন।
ওটেনকে মারার ঘটনার সঙ্গে সুভাষ চন্দ্র বসুর নাম প্রচার পেলেও ওই ঘটনার মূল নায়ক অনঙ্গমোহন দামের নাম অনেক পরে আলোচনায় উঠে আসতে থাকে। এমনকি, অনেক গবেষকদের লেখাতেও অনঙ্গমোহন দাম-এর বহিষ্কারের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য Making of the Political Consciousness within the Student Community of Bengal, নিবন্ধে মৃগাঙ্ক মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “… Presidency College was suspended after the(in) famous ‘Oaten Incident’ that saw the expulsion of Subhas Bose, resignation of H.R. James and a temporary suspension of the Hostel and the College(Page No.59)। ওই নিবন্ধে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, “A lot of items were seized from the rooms of the boarders in the name of raid. Most of these articles were apolitical in nature except a diary of A. Sur found from Manindra Majumdar’s room which provided evidences from the political unrest of 1916. It reports the Oaten /incident in some detail and mentions the name of Ananga Mohan Dam, one of the two boys expelled from the College as the consequence of this incident. But interestingly, the diary does not mention the name of Subhas Bose!”
Emotion and Attitude of Netaji Subhas Chandra Bose towards Emancipation of India from British Colonial Rule নিবন্ধে কালীপ্রসন্ন নাই লিখেছেন, “Professor Oaten and some students eventuated on 15th February, 1916, and a group of students including Subhas Chandra Bose decided to acquire the law in their own hands. When Oaten was come down the broad staircase from the 2nd floor, he was surrounded by the students who breech him with their sandals and dissolved from there, although Oaten was not able to identify the attackers but a bearer told he saw Subhas Chandra Bose and Ananga Dam among those were fled.(Page-851)
প্রেসিডেন্সি কলেজ বা হিন্দু হস্টেলে আসার পর অনঙ্গমোহন দাম বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, এমনটা নয়। তবে বিপ্লবী কার্যকলাপের পরিধি অনেক বেড়ে গিয়েছিল এই সময়ে। সিলেটে স্কুল ছাত্র থাকাকালীনই স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। অনঙ্গমোহন দামের বয়স তখন ১৫ বছর। তরতাজা কিশোর। তিনি সিলেট শহরের গিরিশচন্দ্র হাই স্কুলে পড়তেন। বিপিনচন্দ্র পালের ভাষণ শুনে কিশোর অনঙ্গমোহন স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার তাড়না তাঁকে ক্রমশ বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করে। স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকলেও অনঙ্গমোহন এতটাই মেধাবী ছাত্র ছিলেন যে, ১৯০৯ সালে তিনি স্কলারশিপ পেয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। তখন বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পাল প্রায়ই বলতেন, ‘শিক্ষা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা পারে না’। তাঁর সেই ডাকে বহু মেধাবী ছাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। অনঙ্গমোহন দাম সেই বিপ্লবে উৎসর্গীকৃত নিঃসন্দেহে এক কৃতী ছাত্র। পরবর্তীকালে বৃহত্তর স্বাধীনতা সংগ্রামে এসে, পরাধীন ভারতের আইনসভার সদস্য, গণ পরিষদের সদস্য হিসেবে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল অংশ গ্রহণ ও চার বছর কারাবাস। তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যথাযথ তো নয়ই বিক্ষিরপ্ত ভাবে কিছু নিবন্ধে ও গ্রন্থে অনঙ্গমোহন দামকে নিয়ে লেখালেখি হয়েছে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
১) নেতাজি রচনাবলী
২) নেতাজি সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুন্দর প্রকাশন
৩) দেশনায়ক সুভাষ চন্দ্র- পার্থ ভৌমিক
৪) ওটেনকে সুভাষ কখনো মারতে চাননি, দেবব্রত মণ্ডল
৫) প্রেসিডেন্সি কলেজের চিঠি, রেফারেন্স নম্বর- ৪১৩, তারিখ ৭মার্চ, ১৯৯৬
৬) সুভাষ কি ওটেনকে মেরেছিলেন?-বারিদবরণ ঘোষ, পারুল প্রকাশন, কলকাতা
৭) The Statesman, 24th February, 1916
৮) ভারত সরকারের ফাইল নম্বর ২/৩/৪১-পাবলিক, ১৯৪১, The Government of India, Home Deptt. Public.
৯) সুভাষ স্মৃতি- অনঙ্গমোহন দাম
১০) An Indian Pilgrim, Or Autobiography of Subhas Chandra Bose, Page-73.
১১) Indian Express, 10th April,2010
১২) Making of the Political Consciousness within the Student Community of Bengal, Mringanka Mukhopadhaya, Academia Edu
১৩) আশিসকান্তি দাম (বিপ্লবী অনঙ্গমোহন দাম-এর জ্যেষ্ট পুত্র)
১৪) স্বামী গম্ভীরানন্দ- শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, বেলুড়
১৫) Emotion and Attitude of Netaji Subhas Chandra Bose towards Emancipation of India from British Colonial Rule, Kaliprasanna Nai, June, 2022, IJIRT, Vol. 9, Issue 1
১৬) Assam’s distorted History erases True Identity of Indigenous Fighters By Bidhayak Purkayastha, February 12, 2019.
১৭)সুভাষ নন, ওটেনকে মারেন অশোকনগরের অনঙ্গমোহন, সুকুমার মিত্র, balihas,com, ২ জুলাই, ২০২২
১৮) অনঙ্গমোহনের মারের পরই বন্ধ প্রেসিডেন্সি, হিন্দু হস্টেল, সুকুমার মিত্র, balihas,com,৭ জুলাই, ২০২২
১৯) রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে এক মঞ্চে বিপ্লবী অনঙ্গমোহন, সুকুমার মিত্র, balihas.com, ১১ জুলাই, ২০২২
২০) Not Netaji, ‘Bangal’ of Sylhet’s Anangamohan attacked Otten at Presidency College, Sukumar Mitra, Academia Edu, 2022.
২১) শ্রী উৎপল আইচ, শ্রীহট্ট সম্মিলনী, কলকাতা, ফেসবুক পোস্ট।