পর্ব ৫০

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

রিপন শরীফকে গুলি করে পালিয়ে গেল সাত্তার। যদিও তার কিছুদিন আগে সাত্তারের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। সে আমাকে আশ্বস্ত করেছিল যে সুমন বাহিনীর সঙ্গেই আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু শেষমুহূর্তে সুমন বাহিনীর সঙ্গে বোঝাপড়ায় সমস্যা হয়েছিল সাত্তারের। সেই কারণেই সে ওই অঘটন ঘটিয়েছিল, আত্মসমর্পণের দিনেই।

সেই সকালে জুয়েল আমাকে ফোন করে বলল, মামা, ‘‘রাতের বেলা আপনাদের আসার কথা। কিন্তু আগে আগেই আপনারা চলে আসুন। কারণ, আরও বড় কোনও ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’’ কথাটা শুনে আমি বুঝলাম, ওখানে কে কাকে সন্দেহ করছে, সেটা একটা বড় ব্যাপার। কারণ, সুমন বাহিনীর লিডার সুমনের বড় ভাইকেই গুলি করে দিয়েছে সাত্তার। ওই ঘটনার পর দলের একজন অন্যজনকে সন্দেহ করছিল। তারা ভাবছিল, ঘটনাটা ঘটানোর ব্যাপারে দলের ভিতর থেকে কেউ ইন্ধন দিয়েছে কিনা। যেহেতু এক রকমের উত্তপ্ত পরিস্থিতি, মানে ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটা ঘটনা ঘটে যেতে পারে, তাই জুয়েল আমাকে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছে যেতে বলছিল।


আমি আবার চিন্তা করছিলাম, এই উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যে যদি আমি যাই তাহলে না জানি আমাদের কোন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। এই গোলাগুলিতে কী হয়েছে, কতজনের গুলি লেগেছে, কেউ মারা গেছে কিনা— সেই ব্যাপারগুলি তখনও পর্যন্ত জানতে পারিনি। যাই হোক, দুপুর গড়াতে গড়াতে আমি তাদের বললাম— দেখো ভাই, আমাদের ট্রলার চরে ওঠানো। এখনও জোয়ার আসেনি। ট্রলার ভাসবে শেষ জোয়ারে। তখন নামাবো। তার পরের জোয়ারে রওনা দিবো। আগের পরিকল্পনার বাইরে যাওয়ার সুযোগ হবে না। তবুও চেষ্টা করবো। আসলে আমি সময় নিচ্ছিলাম। আবার আমার ভাবনা যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য তাদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
যাই হোক, ওই ঘটনা জানার জন্য আমি তখন চারপাশ থেকে খোঁজখবর নিচ্ছি। কিন্তু গহীন বনের ভিতরের সেই গোলাগুলির খবর তখনও বের হয়নি। দুপুর গড়ানোর পরে আধা জোয়ার যখন তখন আমরা রওনা দিলাম। আমরা দুবলার চর থেকে ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালের ঠিক উল্টো দিকে পাশাখালীতে চলে গিয়েছিলাম। ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালের ভিতরে সুমন বাহিনী ছিলো। সেখানে না ঢুকে আমরা পরিস্থিতি বুঝতে পাশাখালীতে গেলাম। সেখানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। আমার পরিকল্পনা ছিল, পাশাখালীতে পৌঁছেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবো, ফোনে কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করবো। সেজন্যই ওই জায়গায় আমার যাওয়া। সেখানে গিয়ে RAB-এর সঙ্গে আমি যোগাযোগ করলাম। বরিশাল RAB-এর মেজর সোহেল সেবার আত্মসমর্পণের ব্যাপারে দায়িত্বে ছিলেন। তাঁকে পুরো ঘটনাটা জানালাম আমি। বললাম, আপনারা সঙ্গে একজন ডাক্তার নিয়ে আসবেন। যাতে হতাহতদের চিকিৎসা দেওয়া যায়। বললাম, দস্যু দলের সদস্যদের কয়েকজন আত্মীয় থাকবে ঘাটে। তাদেরও নিয়ে আসবেন সঙ্গে করে। তাদের নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করবেন না। শুধু আমার নামটি বললেই ট্রলারে উঠিয়ে নিবেন।

ততক্ষণে নিশ্চিত হয়েছি শুধু রিপন শরীফের হাতেই গুলি করেছে সাত্তার। অন্য কেউ হতাহত হয়নি। জানতে পেরেছিলাম, রিপনের একটা হাত ধসে গেছে কিন্তু তিনি জীবিত আছেন। তবে এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটল। পাশাখালীতে আমরা উঠতে উঠতেই তরুণ একজন বনকর্মী আমার কাছে ছুটে এলেন। তিনি বললেন, ‘‘ঘটনা আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে একজন দস্যু দু’টো বন্দুক নিয়েএই অফিসে উঠেছিল। পানি নিয়ে আবার জঙ্গলের ভিতরে চলে গেছে।’’ তখন বুঝলাম, সেই দস্যু আসলে সাত্তার আর পাশাখালীর ভিতর দিয়েই উল্টো দিকে সে বনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম সাথে কেউ ছিল কি না। ওই বনকর্মী জানালেন, অন্য কেউ সঙ্গে ছিল না। একজন দস্যুই সেখানে এসেছিল। আমার খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়ায় আমার এমন দুশ্চিন্তার দিন খুব কমই কেটেছে।
রাত যখন বারোটা ছুঁই ছুঁই তখন আমরা রওনা দিয়ে দিলাম। পশুর নদী পাড়ি দিয়ে আমাদের উল্টো পাশে ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালে যেতে হবে। ওই খালের ভিতরেই কোনও একটা জায়গায় সুমন বাহিনী রয়েছে। তারা আমাকে আলোর সিগন্যাল দেবে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ চলছিল। এরই মধ্যে RAB-এর ট্রলারও রওনা দিয়েছে। রাত দু’টো নাগাদ RAB-এর ট্রলার এলো। আমরা একসঙ্গে হলাম ঘসিয়াঙ্গাড়ীর মুখে, পশুর নদীতে। RAB সঙ্গে করে একজন মেডিক্যাল অ্যাসিস্টেন্টকে নিয়ে এসেছিল। তাকে নিয়ে আমরা রওনা দিয়ে দিলাম।


খালের ভিতরে ৪০-৪৫ মিনিট যাওয়ার পর সুমন বাহিনীর ট্রলারের সামনে আমাদের ট্রলার পৌঁছল। তখন রাত প্রায় তিনটে। একটু বেশিও হতে পারে। এই সময়ে আমি খুব চিন্তার মধ্যে ছিলাম। ভাবছিলাম, যা উত্তেজনার পরিস্থিতি, তাতে না জানি কী হয়।

আমাদের ট্রলার ওদের নৌকার কাছে পৌঁছনোর সাথে সাথে দস্যু দলের নেতা বড় সুমন আমাদের ট্রলারে লাফ দিয়ে উঠলেন। একই সঙ্গে দলের বাকি সদস্যরাও। আমার বুক ধকধক করছিল। না জানি কি প্রতিক্রিয়া দেয় তারা। কিন্তু দেখলাম ট্রলারে এসে তারা অবাক করার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। দস্যুরা তাদের বন্দুক, গুলি শরীর থেকে খুলে আমাদের ট্রলারে রেখে দিল। আর বলল, ‘‘তাড়াতাড়ি এগুলো নেন। আমাদের আর ভাল লাগছে না। এই জীবনটা আর বহন করতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আমাদের কাছে এই অস্ত্রসস্ত্র গোলাবারুদের ওজন বেড়ে গেছে কয়েক গুন। আমরা এসব নিয়ে আর চলাফেরা করতে পারছি না। আপনি এগুলি নিয়ে RAB-এর কাছে জমা করে দিন।’’ আমি তখন আশ্বস্ত হলাম। সুমন বাহিনীর সদস্যদের সান্তনা দিলাম আমি। বেলায়েত সরদারকে বললাম চা জ্বালাতে। ওদিকে গুলিতে আহত রিপন শরীফকে একটা ছোট্ট নৌকার মধ্যে রাখা হয়েছে।
(ক্রমশ)