দৃশ্য এক: শহরতলির নামী স্কুলের সকালবেলা। গেট খুলেছে। বাচ্চার একে একে ঢুকছে স্কুলবাড়ির ভিতরে। হঠাৎ চিলচিৎকার করে কান্নার শব্দ। তার পরের দৃশ্যের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। একটি বাচ্চা ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে স্কুলে না-যাওয়ার দাবি জানিয়ে। মা-বাবাও নাছোড়। টানাহিঁচড়া করছে তাকে— আজকেই সহবত জ্ঞান আর পড়াশোনা দু’টোই একসাথে শিখিয়ে ছাড়বে। উত্তেজনা বাড়ছে ক্রমাগত। দু’-একজন অভিভাবকের তরফ থেকে অনুরোধও আসছে বাচ্চাটিকে ছেড়ে দেওয়ার। কিন্তু সেই দম্পত্তিও ‘কর্তব্যে’ অনড়।

দৃশ্য দুই: সব মিলিয়ে জনাকুড়ি হবে। স্কুলড্রেসেই বসে পড়েছে রাস্তায়। কিচিরমিচির করছে শালিখ পাখির মতো। বয়স কত আর হবে— সদ্য আঠেরো বা উনিশ। মুখগুলোর মধ্যে লেপ্টে আছে মফস্বলী গন্ধ। স্ট্রিট-স্মার্টনেসের ছিটেফোঁটাও নেই। তবে স্কুল যেতে না চেয়ে ধুলোয় গড়াগড়ি খাওয়া সেই বাচ্চাটার মতোই ওদের একবগ্গা জেদ। দাবিটা আলাদা— পাশ করিয়ে দিতে হবে। শুধুমাত্র ইংরেজিতে তাদের পাশ-মার্ক ওঠেনি। অতএব সেই ঘাটতিটুকু যে ভাবেই হোক পূরণ করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাসে ওদের অনেকেই নাকি লেটার মার্কস পেয়েছে। শুধু ইংরেজিতেই ইচ্ছে করে তাদের ‘ফেল করানো হয়েছে।’ অতএব পাশ করাতে হবে।

স্কুলে ঢুকতে না-চেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দেওয়া বাচ্চাটার সঙ্গে এদের পার্থক্য একটাই। এই ছেলেমানুষি দাবি ধর্নার তকমা পেয়েছে। বুম হাতে সেখানে পৌঁছে গেছে মিডিয়া। এর পরেই ঘটনার ক্লাইম্যাক্স। সাংবাদিক যাচাই করতে বসেছেন সেইবাচ্চা মেয়েগুলোর বিদ্যে-বুদ্ধির দৌড়। বিশেষত যে ইংরেজিতে তারা অকৃতকার্য হয়েছে, তার গভীরতা মাপতে চেয়েছেন অতিসরলীকৃত উপায়ে। জনৈক সাংবাদিক তাঁর ভূমিকা বদলে ফেলেছেন দ্রুত। সাক্ষাৎকার নেওয়ার বদলে প্রশ্নকর্তার দায়িত্ব পালন করে দেখাতে চাইছেন এই পাশের দাবি কতখানি অযৌক্তিক। জানতে চাইছেন আমব্রেলা-র ‘বানাম’। জানতে চাইছেন, তাঁদের দেওয়া পরীক্ষাটির নাম, এইচ.এসের ফুল ফর্ম, হায়ার সেকেন্ডারি বানান ইত্যাদি ইত্যাদি। পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে বাচ্চাগুলো। আর ততই উত্তেজনা কিংবা কৌতূক বাড়ছে সাংবাদিকের। পুলক একেবারে চাগাড় দিয়ে মাথায় উঠছে আমজনতার। গোটা সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে সারাদিন ধরে ‘আমরেলা’ ট্রেন্ডিং। এই ডিজিটাল সময়ে ভাইরাল হওয়া তথাকথিত এই ‘সংবাদ’-টাই তো চাই চ্যানেলের টিআরপি বাড়াতে।
সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইন জুড়ে যতবার স্পষ্ট করে ভেসে উঠছে ওদের মুখ, ওদের ইংরেজির বহর, ততবারই হাসির ছর্রা ছুটছে। খোরাক তো হওয়ারই কথা। সামান্য ইংরেজি বানানটুকুও না জেনে কনফিডেন্টলি ভুল বলে পাশ করানোর দাবিতে অনড় ছাত্রীদের। তাই না? ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তের মুখও আড়াল করা হয় ক্যামেরায়, কিন্তু ইংরেজি বানান না-জানার এই ঔদ্ধত্য বরদাস্ত করা যায় না কিছুতেই! অতএব খাপ বসে যায় ভার্চুয়ালে। বইতে থাকে মিমের বন্যা— ‘গরমেন্ট আমাদের ভিত্তি, আমরেলা আমাদের ভবিষ্যৎ।’ অথবা, ‘আমিও ইংরেজিতে THANQ, LOL, OMG লিখতে পারি, আমাকে অক্সফোর্ডে পড়ার সুযোগ দিতেই হবে। নইলে ধর্নায় বসব।’ পাশের দাবিতে যে ছাত্রীরা ধর্নায় বসেছে তাদেরই কোনও এক অভিভাবকের সামনে বুম ধরা। মেয়ের ইংরেজিতে মেসেজ করতে পারার দক্ষতার কথা জানিয়ে তিনিও পাশের দাবি তুলে পাশে দাঁড়ান সন্তানের। আবারও সেই ভয়ানক আব্দার আর অবুঝপনা। আর সাংবাদিকের অক্লান্ত পরিশ্রম সত্যিটা সামনে আনার জন্য!

স্কুলড্রেস পরেই মাটিতে লেপ্টে পরা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে যতটা হেসেছে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, ততটা তলিয়ে ভাববারই প্রয়োজন বোধ করেনি আদৌ। তাই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে মিমের বন্যা। ট্রোলের বাহাদুরি। এই ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই হয়তো প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। আর হ্যাঁ, ওরা ইংরেজিতে দুর্বল বলেই হয়তো অকৃতকার্য হয়েছে ওই বিষয়ে। শিক্ষায় হালফ্যাশনের ট্রেন্ড মেনেই ধর্নায় বসেছে। কিন্তু সমস্যা একটাই। শহুরে এলিটপনা বা স্মার্টনেস কোনোটাই ওদের নেই। না আছে ওদের অভিভাবকদের। তাই যে গুরুতর প্রশ্নগুলো এই ঘটনার প্রেক্ষিতে উঠে আসার দরকার ছিল, তার বদলে শানিত হয় বিদ্রূপ। স্যাডিজ়মের আনন্দে মাতোয়ারা হয় আট থেকে আশি। রাজা-উজির-মন্ত্রী-সেপাই-গবেষক —কেউ বাদ নেই সেখানে।

উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে ইমোটিকনের হইহুল্লোড়। আর মেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ? এরা কিন্তু সেই সময়ে মাধ্যমিক পেরিয়েছে, যখন করোনাবধের দাওয়াই লকডাউন-পরীক্ষা বাতিল-সবাই পাশ। দীর্ঘ আড়াই বছরের টালবাহানাময় ইস্কুল-ইস্কুল খেলারও সাক্ষী কিন্তু এরা। স্মার্টফোনহীন বাড়িতে কী ভাবে পৌঁছল অনলাইন শিক্ষা, জানা নেই। প্রিয় ক্লাসঘর ছেড়ে ওরা কেমন ছিল, উত্তর নেই। ট্যাব হাত পেয়ে ওদের প্রথম ভাবনার কোনো সাথী নেই। শুধু এই ডামাডোলের বাজারে সবাই পাশ করে যায়, এই বিশ্বাসটুকু ছিল। এই বিশ্বাসটুকু সম্বল করেই হয়তো রুখে দিয়েছে বাড়িতে পাকা দেখার আয়োজন। কন্যাশ্রীর ধাপ পেরিয়ে হয়তো রূপশ্রীর সুবিধা সুবিধা নিতে বাবা-মায়েরাও চেয়েছেন মেয়েটা আরেকটা পাশ দিক। কোনো ছাত্রী হয়তো কলেজে পড়ার স্বপ্নও দেখে ফেলেছিল চোখ খুলেই। পাড়াপড়শি, আত্মীয়েরা হয়তো মুখিয়ে আছে পাশের খবরটুকু শোনার জন্য। এই বাজারে আবার কেউ ফেল করে নাকি!

কোনো মিরাকেল না-হলে অমোঘ ভবিতব্যের দিকে এগোতে চলেছে ওই গলাবাজি করে ‘আমরেলা’ বলা মুখগুলো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নেটফ্লিক্স জীবনে সে ভবিতব্যের কল্পনা, ধারনা বা নাগাল পাওয়াও মুশকিল। কোনো এক বৈশাখী দুপুরে ‘শোভনীয় শাড়ি’ময় ডিজিটাল গণমাধ্যম পরবর্তী ঘটনা পরম্পরার দায় স্বীকার করতে প্রস্তুত তো? ডিএ-র ন্যায্য দাবিকে ক্ষণিকের জন্য পথে ফেলে রেখে ওদের বুকে আগলে ঠিক-ভুল চেনাতে চায় তো আপামর শিক্ষক সমাজ? আরো কিছু মিম বানানো আর শেয়ার করার আগে বোধোদয় হোক।

6 COMMENTS

  1. খুব ভালো লেখা। সামাজিক অবহেলা ও আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী অভিঘাতের সাম্প্রতিকতম ঘটনাবলীর উপর অনবদ্য সুখপাঠ্য বিশ্লেষণ। লেখকের উপস্থাপনা প্রসংশার দাবি রাখে।

    তবে রাষ্ট্রের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থচরিতার্থতার জনমোহিনী মুখশ্রীর কেয়া শেঠীয় উপকরণগুলির অপসারণের অবকাশ ছিল।

  2. বতর্মান পরিস্থিতি সম্পর্কে উল্লেখিত রচনা ও বাস্তব ঘঠনা খুব ভাল ভাবেই ফুটে উঠেছে। আশা করি পরবর্তী লেখা গুলো আরও বেশী হৃদয়স্পর্শী হবে। খুবই ভাল ।

  3. খুব সুন্দর বিশ্লেষণ। খিল্লি আর সেন্স অফ হিউমার যে এক নয়, সেটা বোঝার সময় হয়েছে। খিল্লি করে গভীরের কারণটা উপেক্ষিত হয়ে যায়। তাতেই বিপদ।

  4. দায়িত্বে থাকা আধিকারিক এবং জনসাধারণ, বোধোদয় হওয়া প্রয়োজন সকলেরই। শিক্ষার নামে দিনে দিনে যে তামাশা চলছে, শিক্ষক হয়ে তা প্রত্যক্ষ করা খুবই বেদনাদায়ক। এরকম লেখা আরো আসুক। ভালো লাগলো analysis।

  5. A very well written article indeed. It captures not only the ruptures that have surfaced in recent years in our social fabric, it also indicates to some extent towards the sociological and ideological reasons leading to this tragic situation.

Comments are closed.