পর্ব ১৭

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

ইলিশের মরসুম সুন্দরবনের বড় জলদস্যুদের কাছে সবচেয়ে লোভনীয় সময়। এই বর্ষার মরসুমে সাগরে নদী এতো উত্তাল থাকে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই সময় বেশি টহল দেয় না। বলা যায়, এই সময় সুন্দরবন একটি অবাধ মুক্ত অঞ্চল। সুন্দরবনের মাছ ব্যবসায়ীরা বহু টাকা লগ্নি করে এই সময় ট্রলার জলে নামায়। আর এটাই জলদস্যুদের কাছে একটা মোক্ষম সময়। এই সময় জলদস্যু বাহিনীগুলির টার্গেট থাকে তারা সত্তর, আশি বা একশো জেলেকে অপহরণ করবে, অথবা সুযোগ পেলে ইলিশ ভর্তি ট্রলার বাজেয়াপ্ত করবে। ধরা যাক, একটা বড়ো ফিশিং ট্রলার দশ, বারো বা পনেরো দিন সাগরে মাছ ধরেছে।  পুরো ট্রলার ভর্তি ইলিশ মাছ। কত মাছ হতে পারে ? ধরুন, চার পাঁচ হাজার পিস! আর সেগুলির সাইজও চমৎকার। কল্পনা করুন তো, একবার যদি এই রকম ট্রলার দস্যুদের হাতে পড়ে, তাহলে সেই ট্রলারের মহাজনের কী অবস্থা হয়? সবচেয়ে মজার বিষয় হল, যে মুহূর্তে জলদস্যুরা কোনও ট্রলার আটক করে, তখনই ডাঙায় খবর হয়ে যায়—সাগর থেকে ট্রলার ভর্তি ইলিশ মাছ এসেছে। মাছ তো কেড়ে নিয়েছে জলদস্যুরা।  কিন্তু এত মাছ তারা বেচবে কোথায়? সেই সময় ওই জলদস্যুদের বন্ধু মাছ ব্যবসায়ীরা নিজেদের ট্রলার নিয়ে এসে মাছগুলি নিয়ে গিয়ে খুলনা, মংলার বিভিন্ন আড়তে দিয়ে দেয়।

যারাই এই ব্যবসার সাথে যুক্ত, তারা সবাই জানে ব্যাপারগুলি। সবাই জানে, এই মাছ গুলি ডাকাতির মাছ। কিন্তু তার পরেও বিষয়টি নিয়ে কেউ নাড়াচাড়া দিতো না। নানা জায়গায় বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে যেত ডাকাতির মাছ। গিফট। একেবারে খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত। গিফট যদি সঠিক সময়ে পাওয়া যায়, তবে সেই মাছ ব্যবসায়ীকে আর ধরবে কে? কখনও কখনও সুন্দরবনের হরিণের মাংসও  গিফট হিসাবে পৌঁছে যেত কিছু নির্দিষ্ট লোকের কাছে। এই যে চক্র, দস্যুতা ,দস্যুতার টাকা লেনদেন, ভাগাভাগি ,অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচা—  সব মিলিয়ে এর বিস্তার ছিল বহুদূর। একেবারে খুলনা থেকে সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম পর্যন্ত। আর এইখানে বড় একটি ভূমিকা থাকতো জলদস্যুবাহিনীর সর্দারের। সুন্দরবনের জলদস্যু সর্দার কিন্তু সহজে দল পরিচালনার যোগ্য হতো না। অযোগ্য কোনও লোক সর্দার হলে তার দল বেশিদিন টিকতো না সুন্দরবনে।

যাই হোক, ফিরে আসি মোস্তফা শেখের কথায়।

ইলিয়াস চলে যাবার পরে, নোয়া চাইল তাদের দলটিকে আবার সুসংগঠিত করতে। প্রথমে সে চাইল, যারা পুরনো জলদস্যু তাদের দলে নিয়ে আসতে। নোয়া যাদের দলে নিয়ে এসেছিল, তাদের একজন মোস্তফা শেখ।

ইলিয়াস যখন মধ্য সুন্দরবনে জলদস্যুতা করছে, মোস্তফা শেখ তখন স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিজের বাড়িতে বসবাসের চেষ্টা করছিলেন। আমি গিয়েছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। জায়গাটা ছিল রামপালের কাটালিবাজার। দেখা হয়, কথা হয় মোস্তফা শেখের সঙ্গে। এটি ছিলো দ্বিতীয় দেখা। এর আগে মোস্তফার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো রাজুবাহিনীর আস্তানায়। প্রথম পরিচয় সেখানেই।

মামলার চাপ খেয়ে মোস্তফা একদিন যোগ দিয়েছিল রাজুবাহিনীতে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন দস্যুতা করেনি। সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যায় কক্সবাজারে। সেখানে বিয়ে করে। সন্তানের বাবা হয়। ওই কক্সবাজারে রোজগার করে একদিকে সংসার চালাতেন অন্যদিকে সব মামলা সামাল দিতেন।  মামলা শেষ হলে ফিরে আসেন নিজের গ্রামে।

কাকতালীয় ভাবে যেদিন মোস্তফা বাড়ি ফিরে আসেন, সেদিন আমি কাটালিবাজারে গিয়েছিলাম। একরাত ছিলাম তার বাড়ি। একটা ছোট ঘেরের মধ্যে আধভাঙা ঘর। সামনে মাটির বারান্দা। প্রায় সারা রাত গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছিলাম আমরা।

-“আমার মামা ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আমি ছিলাম তার বাহিনীর একজন লাঠিয়াল। সেই ছোটবেলা থেকে। মাছের ঘের দখল করা, অন্যান্য  অনেক কাজ উনি করাতেন আমাদের দিয়ে। মারপিট, হাঙ্গামা। এইসব করতে গিয়ে একদিন মামলা খেয়ে গেলাম আমি। ফেরারি হলাম। মজার কথা হল, আমার চেয়ারম্যান মামা ভুলে গেলেন আমাকে। চিনতেই পারেন না। মামলা সেই সময় আমাকে দৌড় করিয়ে মারছে। আমি বার কয়েক গেলাম তার কাছে, বলেছিলাম মামলা সামাল দেওয়ার কথা। উনি আমার কথা কানে তুললেন না। উল্টে আমাকে বললেন, তুই জলদস্যুবাহিনীতে ঢুকে যা। উনি নিজে রাজুর সঙ্গে কথা বলে আমাকে ঢুকিয়ে দিলেন রাজুবাহিনীতে। “

মোস্তফা বলেছিলেন, “রাজুবাহিনীতেও আমি বেশিদিন থাকতে পারিনি। একদিন বের হয়ে আসি সেখান থেকে। চলে যাই কক্সবাজার। এখন উনি আমাকে চেনেন না। বরং পুলিশ- ৱ্যাব ডেকে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। কিন্তু সত্যি বলছি দাদা, আমি সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি। আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাই।”

মোস্তফার সমস্ত কথা শুনে আমি তার মামার সঙ্গে যোগাযোগ করি। স্থানীয় থানার সঙ্গেও যোগাযোগ করি। তাঁদের বলি, মোস্তফাকে হ্যারাস করবেন না। লোকটি ভাল হওয়ার চেষ্টা করছে। পারলে ওকে সহযোগিতা করুন। আমার যতটা করার আমি করতে চেষ্টা করলাম।

মোস্তফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি ঢাকায় ফিরে আসি। এর দেড়-দুই মাস পরে এক রাতে একটা ফোন পেলাম। মোস্তফার ফোন।

“আমি কোথায় যাচ্ছি জানি না। বেঁচে থাকলে কথা হবে।’’

কী হল মোস্তফার সঙ্গে?  ভাবনাতে আমার ঘুম উড়ে যাবার জোগাড়। কোনও বিপদ!

(ক্রমশ)