সঞ্জয় গুপ্ত
১৯৭৭ সালের এক দুপুরে, বাইশ বছরের ছেলেটি বসে আছে উত্তরপ্রদেশের খালিলাবাদ শহরে, গ্রাম পঞ্চায়েতের অফিসে। কাপড়ের ব্যবসা করার জন্য তাঁর কিছু টাকা ধার নেওয়ার দরকার পড়েছে।
যুবকটিকে চমকে দিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্মসচিব তাঁকে জানালেন, আপনি তো মৃত! গতবছর, ৩০ জুলাই, ১৯৭৬ সালে আপনি মৃত বলে ঘোষিত হয়ে গেছেন!
তিনি যে মৃত নন, সেকথা প্রমাণ করতে লালবিহারী নামের যুবকটিকে এর পর যা যা করতে হয়েছিল, তা চমকপ্রদ বললে কম বলা হয়। লালবিহারীর কাকু তাঁকে মৃত বলে কাগজপত্রে ঘোষণা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, যুবকটির সম্পত্তির ভাগ নিয়ে নেওয়া। মৃত ঘোষিত হলে, সম্পত্তির পাঁচ ভাগের এক ভাগ তার দখলে চলে আসে। অন্য আত্মীয়রাও ভাগ পেয়ে চুপচাপ।
নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে, লালবিহারী সবচেয়ে প্রথম তাঁর আত্মীয় বাবুরামকে অপহরণ করলেন। বাবুরাম ছিল তাঁর সেই আত্মীয়ের সন্তান, যে ঘুষ দিয়ে লালবিহারীকে খাতায় কলমে মৃত ঘোষণা করিয়েছিল। পশুর রক্তে রাঙানো পোশাক অবধি লালবিহারী পাঠালেন বাবুরামের বাড়িতে। কিন্তু তাঁর আত্মীয়ের বাড়ি থেকে পুলিশে কোনও অভিযোগ করা হলো না। লালবিহারী কয়েকদিন অপেক্ষা করে শেষটায় বাবুরামকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। এরপর, তিনি যে বেঁচে আছেন, সেটা প্রমাণ করতে একজন পুলিশ অফিসারকে পাঁচশো টাকা ঘুষ দিয়ে, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে বললেন। পুলিশের লোকটি টাকা নিয়েও, শেষটায় উদ্দেশ্য জেনে, ভয় পেয়ে টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন।
উপায় না দেখে লালবিহারী তাঁর বউয়ের নামে বিধবা ভাতা পাওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করলেন। ভেবেছিলেন, খোঁজখবর নেওয়ার সময় তিনি উপস্থিত হয়ে গেলে, রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের নজরে পড়ে যাবেন। আর তিনি যে বেঁচে আছেন— সেই কারণ দেখিয়ে সরকার তাঁর স্ত্রীকে বিধবা ভাতাও দেবে না। কিন্তু প্ল্যানটাও কাজে এলো না। রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা অন্য কারণ দেখিয়ে ভাতার আবেদন নাকচ করে দিলেন।
তবে এই সব কাণ্ডকারখানার কারণে খবরের কাগজে লালবিহারীর নাম আসা শুরু হলো। এমনকি, একজন এমএলএ তাঁকে নিয়ে বিধানসভায় প্রশ্ন অবধি তুলে ফেললেন। একদিন লালবিহারী প্রবেশপত্র জোগাড় করে বিধানসভায় হাজির হয়ে, দস্তুরমতো ‘ম্যায় জিন্দা হু’ বলে বিস্তর চেঁচালেন। বিধানসভা চত্বর থেকে পুলিশ তাঁকে জোর করে বের করে দিলো।
এসবই চলছিল, কিন্তু কাগজেকলমে তিনি মৃতই থেকে যাচ্ছিলেন।
এবার এলো লোকসভার নির্বাচন। ১৯৮৮ সালে, ভি পি সিংয়ের বিরুদ্ধে লোকসভায় দাঁড়িয়ে গেলেন লালবিহারী। রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে তিনি প্রার্থী হলেন ১৯৮৯ সালে। আশ্চর্য হওয়ার মতো কথাটি হচ্ছে, ১৯৮৮ সালে লালবিহারী ১৬০০ ভোটও পেয়েছিলেন। এই খবরটি কাগজে বেরিয়েছিল। সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার।
কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে, লালবিহারী একটি সংস্থা তৈরি করলেন। যার নাম ছিল, মৃতক সংঘ । ইংরেজিতে Association of dead people। এর উদ্দেশ্য ছিল, সেই সব মানুষদের সাহায্য করা, যাঁরা বেঁচে থাকলেও, কাগজে কলমে মৃত বলে ঘোষিত হয়েছেন। দেখা গিয়েছিল, ভারতে এরকম প্রচুর মানুষ রয়েছেন, যাঁদেরকে তাঁদের আত্মীয়রা মৃত বলে কাগজেকলমে ঘোষিত করিয়ে দিয়েছে।
শেষটায় , ১৮ বছর পর, ১৯৯৪ সালে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট লালবিহারীকে জীবিত বলে ঘোষণা করে। এরকম ভাবে মৃত বলে ঘোষিত অন্যান্যদেরও সুযোগ করে দেয় আদালতের কাছে আবেদন করে নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে। আদালত National Human Rights Commission কে এই ব্যাপারটি নিয়ে তদন্ত করতে বলে।
শুধু কি লালবিহারী?
২০০৮ সালে, একটি তথ্য জানার আবেদনের উত্তরে জানা গিয়েছিল, শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশে ৩৩৫ জন কাগজেকলমে মৃত মানুষের কথা— আদালত যাঁদের জীবিত হিসেবে বেঁচে রয়েছেন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এমনটিও হতে পারে, ভাবলে আশ্চর্য লাগছে না?
২০০৪ সালে লালবিহারী মৃতক পেলেন আই জি নোবেল প্রাইজ। যাঁরা অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটান, এই পুরস্কারটি তাঁদের দেওয়া হয়ে থাকে। ১৯৯১ সাল থেকে এই পুরস্কারটি চালু হয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্দার্স থিয়েটার হলে প্রায় ১১০০ মানুষের সামনে প্রতি সেপ্টেম্বর মাসে পুরস্কারটি দেওয়া হয়। অল্প অর্থ এবং একটি সার্টিফিকেট প্রাপকের হাতে তুলে দেন কোনও সত্যিকারের নোবেল প্রাপক। লালবিহারীর সেই পুরস্কার পাওয়ার পিছনে ছিলেন সতীশ কৌশিক। এই ঘটনাটি নিয়ে তাঁরই প্রযোজনায় ‘কাগজ’ নামের একটি সিনেমা হয়েছিল। কাগজেকলমে মৃত মানুষটির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী। সিনেমাটি অবশ্য কমেডি ঘরানার ছবি।
গল্পটা এখানে শেষ করে দিলেই ভালো হতো। কিন্তু আরও কিছু কথা বাকি রয়েছে। সেটা হল, সরকারি খাতায় দীর্ঘদিন ধরে মৃত থাকার জন্য, রাজ্য সরকারের কাছে ২৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেছিলেন লালবিহারী।
ইলাহাবাদ হাইকোর্ট ২০২৩ সালের মার্চ মাসে এই মামলার ফয়সালা করতে গিয়ে জানাল, লালবিহারীর সঙ্গে যা ঘটেছিল তার জন্য দায়ী ছিল তাঁর আত্মীয়রা। তারাই রেকর্ড জাল করে তাঁকে মৃত সাজিয়েছিল। এতে সরকারের দায় নেই। ফালতু কেস করে আদালতের সময় নষ্ট করার জন্য লালবিহারীর উপর দশ হাজার টাকার জরিমানা বসানো হলো। লালবিহারী অবশ্য জানিয়েছেন, ওই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যাবেন।
বোঝাই যাচ্ছে, লড়াই করার স্পৃহা ভদ্রলোকের এখনও কমেনি।
অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়