অসীম শীল

এবারের বাংলাদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা পর্বেই ফয়সাল একটা লোভ দেখিয়ে রেখেছিল, ‘দাদা, আপনাকে একটা ভাসমান বাজার দেখাতে নিয়ে যাব।’ এরকম প্রলোভনে কে না সাড়া দেয়? বরিশাল অবস্থান কালে একটা দিন দুপুরের পরই সদলবলে শহর থেকে পশ্চিম দিকে রওনা দিলাম। আমাদের গন্তব্য, আটঘর কুড়িয়ানা, জায়গাটা স্বরূপকাঠির নিকটবর্তী। বড় সড়ক, মাঝারি রাস্তা ছেড়ে গ্রামের সরু পথ ধরে অবশেষে একটা ছোট সেতুর উপর আমাদের গাড়ি গিয়ে থামল। জায়গাটার নাম ভীমরুলি, অবশ্য সেখানে কোন ভীমরুল আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য উপস্থিত ছিল না। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল দুই পাশে ফলের পসরা। গ্রামের মহিলারা বিক্রি করছেন ঝুড়ি ঝুড়ি পেয়ারা, আনারস আর লাল টুকটুকে পাকা গাব। কেউ ডাকছে, ‘ঢেকি শাক লইয়া যান, কচি শশা লইয়া যান।’
এরপর নৌকা নিয়ে খালের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর পালা। আমাদের এই যাত্রার গাইড প্রশান্ত— ওর বাড়ী কাছেই স্বরূপকাঠিতে। ও আর রেজাউল নৌকার দরদস্তুর করতে লাগল। একগাল পান মুখে নিয়ে খালি গায়ে এক বৃদ্ধ ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। খয়ের লেপা লাল দাঁত আর শ্যামবর্ণ শরীরে রুপোর মাদুলিতে মানুষটাকে বেশ আকর্ষনীয় লাগছিল। দুটো কথা বলতেই এগিয়ে এলেন ঘাটের কাছে।
—নিশ্চিন্তে যায়েন। এহানে আমরা নিয়ম ঠিক কইর‍্যা লইসি। কেউ বেশি টাহা (টাকা) নেতে পারবে না। আগে লইত, জাগার বদনাম হইয়্যা গ্যাসেলে (জায়গার বদনাম হয়ে গেছিল)।

এক যুবক যেতে রাজি হল দেড় ঘন্টার জন্য। বৃদ্ধের আশ্বাসে আমরা ছ-সাতজন নৌকায় উঠলাম। প্রতিশ্রুতি মিথ্যা ছিল না। আমাদের কান্ডারী হারু খুব হাসিখুশি ছেলে। নানান বর্ণনা সহকারে গ্রাম দেখাতে থাকল।

এ এক অপূর্ব বাংলাদেশ। আমার কাছে অনন্যা, একেবারে অনাস্বাদিত। স্নিগ্ধ সবুজ প্রকৃতি শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয় প্রাণের আরাম বিতরণেও অকৃপন। যেন অন্য পৃথিবীতে চলে এলাম। গাছ এমনিতেই কত সুন্দর, আর যদি তা সদ্য বৃষ্টিস্নাত হয় তাহলে তার উজ্জ্বল রূপের বাহার আরও বেরিয়ে পড়ে। খালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, জলের উপর পেয়ারা গাছের ডাল ঝুঁকে পড়েছে, চাইলেই নৌকা থেকে ফল ছিঁড়ে নেওয়া যায়। ছোট ছোট গাছ থেকে কাগজি লেবু তুলে চাষিরা নৌকায় জমা করছে। পিছনের সারিতে গাছভর্তি আমড়া, কোন গাছে পাতা কিছু আছে, কোনওটাতে শুধু ফলগুলোই ঝুলে রয়েছে। মাঝে মাঝেই উল্টোদিক থেকে নৌকা আসছে, তাতে বড় বড় কাঁচকলার কাঁদি, লাউ, শশা ভর্তি। কোনওটায় বা বিভিন্ন গাছের চারা।
পুরো অঞ্চলটাই মনে হচ্ছে সুন্দরবনের এক ছোট সংস্করণ, যদিও এটা সমুদ্র থেকে অনেকটাই দূরে। এখানেও খালের পর খাল গুনতে গুনতে ক্লান্ত হয়ে যেতে হয় একদম সুন্দরবনের নদীর মতন। তফাৎ শুধু গাছগুলোতে— গরাণ, হেঁতাল, গোলপাতার বদলে এখানে পেয়ারা, আমড়া, গাব, লেবু আর নারকেলের দল। নৌকায় চলতে চলতে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম ফলের বাগানের মধ্যে মধ্যে অনেক মানুষও বাস করে। দেবালয়ও আছে এদিক ওদিক, গাছের ফাঁক দিয়ে তাদের চূড়া দেখা যায়। এখানেও লোক থাকে? খাবার উপাদান না হয় আছে, অনান্য প্রয়োজন? সেটা মিটবে কী করে? শহুরে শপিংমলবিহারীদের চোখে এরা নিশ্চয় এক বিস্ময়কর জীব। লোকজন খালের ধারে ঘাটে বা বাঁশের মাচায় বসে আড্ডা মারছে, ছোট ছোট নৌকা বেয়ে এদিক ওদিক যাচ্ছে, বুড়িকে বসিয়ে প্রাইভেট বোটে বুড়ো দাঁড় টানছে। কেউ আবার নৌকা থেকে নৌকায় বিড়ি বিনিময় করছে। আমার হাতে ক্যামেরা অনর্গল চলতে থাকে। চতুর্দিকে এরকম দৃশ্য থাকলে কয়েকশো ছবি তুলেও মন ভরে না।

এবার বিপদটা আমিই বাধালাম। খালের এপার ওপার সংযোগ করার জন্য মাধেমধ্যেই কোথাও পাকা সেতু, কোথাও বাঁশের সাঁকো বানানো আছে। নৌকায় বসে থাকলে ব্রিজের তলা দিয়ে অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলে সেতুর সামনে এলেই মাথা সামলাতে হবে নিচু হয়ে। একে তো আমি এসব এলাকায় চলাচলে অনভ্যস্ত, তার উপর ছবি তোলার দিকে মন ষোলো আনা চলে গেছে, একটা ব্রিজের কাছে প্রায় এসে গেছি, তখন খেয়াল হল মাথা বাঁচাতে হবে। দ্রুত বসে পড়তে গেলাম— একেবারে পা পিছলে নৌকার মেঝেতে আছাড় খেয়ে হাঁটুর কাছে প্যান্ট ছিঁড়ল, চোট লাগল ডান দিকের পাঁজরে। ভাগ্য ভালো যে মাথাটা বেঁচেছে এবং পড়ে যাবার পরও অন্যের সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারলাম। ক্যামেরাটা অক্ষতই রইল।

সাথে যারা রয়েছে— তারা আমার ছাত্র-ছাত্রী সবাই খুব বিব্রত হয়ে পড়ল। কিন্তু করবে কি এই খালের মাঝে?
—খুব লাগে নাই তো, স্যার?
—না, না।
—শ্বাস নিতে অসুবিধা নাই তো?
—কিছু কষ্ট নেই। চিন্তা করো না।
—কষ্ট নেই’, কী যে বলেন!

উল্টো দিক থেকে একটা পেয়ারা বোঝাই নৌকা আসে। তার পাশে আমাদের নৌকাকে ভেড়াতে বলে রেজাউল, এক ঝুড়ি মাঝারি মাপের পেয়ারা কিনে নেয় নৌকায় বসে খাবার জন্য। এও এক অভিনব আনন্দ, এত পেয়ারা কি এমনি কখনো খাই? সন্ধ্যার কাছাকাছি আমাদের জল ভ্রমণ শেষ হলো। ভীমরুলির ঘাটে পা দিতে দিতে দেখলাম সামনের কালী মন্দিরে প্রদীপ জ্বালানো হচ্ছে।

এই সময় একটু চা পেলে বেশ ভাল হতো। চায়ের দোকান খুঁজতে খুঁজতে দেখা পেলাম সেই বৃদ্ধের যিনি আমাদের নৌকায় তুলে দিয়েছিলেন। এখন গায়ে নীল জামা চড়েছে। আমাদের দেখেই খুশি হয়ে আমন্ত্রণ জানালেন, ‘আমাগো ঘরে সলেন (চলুন)। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আর আমরা সম্মতি দিতে পারলাম না। কিন্তু বৃদ্ধ ছাড়ে না সহজে, একেবারেই নাছোড়বান্দা। অভিনব আন্তরিকতায় বললেন, ‘পুরা যাইতে লাগবো না। দুয়ারে এটু পাডা ঠেকাইয়া দেন, তাইতেই হইব। মোরা গরিব মানুষ, অতিথি ভগবান।’ এরপর আর অনুরোধ ফেরানো চলে? বসলাম ওঁর বাড়িতে। বসার স্থানটা বৃদ্ধের ছেলের ডাক্তারির চেম্বার, দু’দিকে ছোট দুটো বেঞ্চ পাতা রোগীদের জন্য।

ভদ্রলোকের নাম শ্রী রামপদ হালদার। পুত্র মিলনের দুটি পাশাপাশি দোকানঘর— একটায় রোগী দেখা হয় পল্লী চিকিৎসক হিসেবে, অন্যটায় চলে হারমোনিয়াম বানানো। স্থানীয় জীবনের প্রয়োজন মনে রেখে এরকম দ্বৈত পেশা স্বাভাবিক বৈকি। ডাক্তারবাবু টিমটিমে বাল্বের আলোয় কাঠে রাদা ঘষতে ঘষতে উঠে এসে আমাদের নমস্কার জানিয়ে গেলেন। রামবাবু ওনার স্ত্রীকে প্রতিবেশীর ঘর থেকে ডাকিয়ে আনালেন আমদের আপ্যায়ণের জন্য। বড় সুন্দর ভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওনার সহধর্মিনীর।

‘‘আইলে দ্যাখবেন কিরকম সাধাসিধা মানুষ। কিস্যু বোঝে না, ঘরের লক্ষ্মী। ভাইগ্যটাও ভালো, দুইটা বউমাও ভালো আইসে। ভক্তি ছেরেদ্দা (শ্রদ্ধা) আসে (আছে) খুব।’’

সত্যিই বউমারা খুব ভাল। আমাদের এক সঙ্গীর শৌচালয়ে যাবার প্রয়োজন ছিল, কী যত্নে ওঁর সাথে জলের বালতি বয়ে নিয়ে গেলেন। পুরুষ অতিথি বলে কোনো সংকোচ দেখলাম না। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হতে থাকলেও হালদার পরিবারের অকৃত্রিম আতিথেয়তায় সম্মান জানাতে কিছুটা বাড়তি সময় দিতেই হলো। খাবারের থালায় এল ছোট ছোট পাকা পেয়ারা ‘‘খাইয়া দ্যাহো (দেখ), সোডো (ছোট) হইলেও আমসত্ত্বার মতন মিডা (মিঠা)। বাজারের গুলা দ্যাখতে বড়, কিন্তু খাইতে এত ভালো না।’’

রামবাবুর স্ত্রী আরেকটা পাত্রে আনারস কেটে নিয়ে এলেন। অনেক কষ্টে তাঁকে চা বানানো থেকে নিরস্ত করা গেল। খাবারের চেয়েও বেশি উপভোগ করলাম রামবাবুর গল্প। আমাদের সঙ্গী তৌহিদা জিজ্ঞাসা করল, ‘’দাদু, এই এলাকার সব জায়গার নামে কাঠি কেন? অর্থ কি কাঠির?’ কফ জড়ানো গলায় একটা খাঁকারি দিয়ে রামবাবু বলে চলেন,
—হয় (হ্যাঁ), হেইয়া (সেটা) আমারও প্রেশ্ন। ঝালোকাঠি, স্বরূপকাঠি, বিনয়কাঠি, রায়েরকাঠি – ব্যাবাক কাডি গোনতে গোনতে পেরায় পঞ্চাশ কাডি গুন্নিয়্যা (গুনে) ফালাইসি, আর গোনা ছাড়ান দিসি।
প্রশ্ন অমীমাংসিত হলেও বেশ মজাদার উত্তর পেলাম।
—জানেন, ভীমরুলিতে ব্যাবাক জঙ্গল আসেলে (ছিল) মুক্তি যুইদ্ধের সময় এই গইয়া (পেয়ারা) বাগানে আমরাও পলাইসি আবার অইন্য জাগার মাইনষেও আইস্যা লুকাইসে। মিলিটারি কত যে গাছপালা কাইড্যা শ্যাষ করসে তার হিসাব নাই। লোক মারসেও অনেক, তবুও বেশীদূর আউগাইতে পারে নাই। এই বন-জঙ্গলই আমাগো পেরাণে বাঁচাইসে।
মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী বেশ জমে উঠেছে। তার উপর আবার সন্ধ্যার অন্ধকারে মৃদু লণ্ঠনের আলো— যথার্থ পরিবেশ। কিন্তু কব্জির দিকে চোখ চলে যায়— বেশি রাত করা চলে না। আগামিকাল অনেক রোগীর অপারেশন আছে। বেরিয়ে আসতে আসতে রামবাবু বলতে থাকেন,
—এহানে (এখানে) জঙ্গলে অনেক ভূত-পেরেত আসেলে। মানুষ আইসে, ইস্কুল হইসে, কলেজ হইসে— সব পালাইয়া গেসে।
ভূতের সম্পর্কে এরকম সিদ্ধান্ত কখনও তো শুনিনি। স্কুল, কলেজ হলে সত্যিই তো ভূত পালায়। কলেজের নাম আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাবিদ্যালয়— ভূত তাড়াতেও রবীন্দ্রনাথ!

অন্ধকারটা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে, কোন তিথি জানি না। রাস্তাটা বেশ কয়েকটা জায়গায় ভাঙাচোড়া, গাড়ি চালাতে চালকের খুব পরিশ্রম হচ্ছে। তাই একবার চায়ের বিরতি নেবার সিদ্ধান্ত হল। রাস্তার ধারের দোকানে চা খাওয়ার মজাই আলাদা— নামা যাক। এতক্ষণ গাড়ির এসিতে— ঠান্ডায় ছিলাম, এখন বাইরেটা অপেক্ষাকৃত গরম লাগছে— তবুও খোলা হাওয়া তো। বেঞ্চে বসা গেল। একটু পরেই একজন অপরিচিত ভদ্রলোক এসে কথা বলতে চাইলেন।

—ডাক্তার সাহেব, অনেকদিন হইল ডাইন চোখটায় কোম দেহি (কম দেখি) আর ব্যথা— একটু দ্যাখবেন?
—হায়! কি করে চিনলেন যে আমি ডাক্তার? আমি তো এইখানে থাকিনা।
—আমার লাল চক্ষু দেইখ্যা আপনাগো ড্রাইভার বললো আপনার কথা। কিছু খারাপ পাইয়েন না সাহেব।
—না না খারাপের কোনও প্রশ্নই নেই। আসুন দেখি টর্চ দিয়ে।
দেখলাম চোখটায় জটিলতা আছে।
—কাল বরিশাল যেতে পারবেন?
—যামুনা ক্যান? কষ্ট পাইতেয়াসি খুব। কহন যামু?
পাশেই শাহরিয়ার ছিল। ওকে দেখিয়ে বললাম, হাসপাতালে গিয়ে এই ডাক্তার সাহেবের খোঁজ করবেন। ভাবলাম, লোকটা কেমন সরল ভাবে এল আমার কাছে। এ-ও আমার এক বিশেষ প্রাপ্তি বোধহয়— আমরা দুজনে একই ভাষায় কথা বলি বলে। জগৎটা কত বড়! তাই না? প্রায় আঁধারে বসে চা উপভোগ করছি আর মাথায় ঘুরছে আটঘর ও মুক্তিযুদ্ধের ছবিটা। ফিরে না আসতে হলে রামবাবুর কাছে আরও গল্প শুনতাম। সবে তো সন্ধ্যার আবহে রোমাঞ্চ শুরু হয়েছিল।
বরিশালের হাসপাতালে পৌঁছতে বেশ রাতই হয়ে গেল। আশরফ খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিল।
—রাইত হইসে, আগে খাইয়া নেন। আইজ কচুশাক রাঁধছি, আপনারই কথা মতো।
—হ্যাঁ, খেতে বসছি। খাবার দিতে থাক।
এবার আমার ছাত্রদের আব্দারে হাসপাতালের হস্টেলেই থাকতে হয়েছে। এতে বিশেষ লাভ আশরফের হাতের বিচিত্র লোভনীয় রান্না। রসিয়ে রসিয়ে খাবার মতন নানান পদ হলেও আজ একটু তাড়াতাড়ি খেলাম। কারণ মন পড়ে রয়েছে ইন্টারনেটের দিকে— তাতে খুঁজব মুক্তিযুদ্ধে আটঘর কুড়িয়ানার ইতিহাস, যদি পাই। লোকে এটাকে রমনীয় পর্যটন স্থান হিসেবে জানে, তাতে কোনো ভুল নেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো গৌরবময় ভূষণ, খুবই জানতে ইচ্ছা হচ্ছে।

কয়েকটা সূত্র পেলাম। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা লিখছে, ‘১৯৭১ সালের ১৫ জুন ছিল আষাঢ়ের প্রথম দিন। দুপুর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে গানবোট ও লঞ্চের শব্দ শুনে শঙ্কিত হয়ে ওঠে গ্রামবাসী। তারা ভাবতেও পারেনি, দুর্গম কুড়িয়ানা গ্রামেও ঢুকে পড়বে পাকিস্তানি সেনারা। সেনারা এসে ক্যাম্প ফেলে কুড়িয়ানা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তারপর শুরু করে এক ভয়াবহ গণহত্যার অভিযান। প্রথম দিনেই গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ১০ থেকে ১২ জন নারী ও পাঁচজন পুরুষকে। ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নারীদের ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনারা। আর দুইদিন পর গুলি করে হত্যা করা হয় পুরুষদের।’
যতই পড়ি ততই করুণ সব কাহিনীতে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সেনাদের লক্ষ্য ছিল পেয়ারা বাগানগুলো। স্থানীয় গুপ্তচরেরা খবর দিয়েছিল পেয়ারা বাগানে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের ধরতে গন্ধ শুকে শুকে সেখানে হাজির হয়েছিল পাকিস্তানি মিলিটারি। মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে পায়নি সেনারা, কিন্তু পেয়েছিল অনান্য জেলা থেকে আসা অসহায় মানুষগুলোকে— যারা নিরাপদ আশ্রয় ভেবে এই পেয়ারা বাগানগুলো বেছে নিয়েছিল। নিহত হয়েছিল তিন শতাধিক মানুষ।

ঘুমোতে অনেক রাত হয়ে গেল। সকালে উঠলাম এক অন্য মনের অবস্থা নিয়ে। গতকাল বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল প্রকৃতির অনন্ত রূপের মাঝে মুক্তি উপভোগ করা আর রাতটা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার পর মন তোলপাড় করা এক অনুভবে ডুবে যাওয়া। প্রাতরাশের টেবিলে আশরফ খাবার বেড়ে দেয়, কিন্তু খাদ্যে মন নেই।
—সার, ডিমের কি দিমু হেইয়া তো কইলেন না, ওমলেট না পোচ?
—যা হয় দাও না।
—আগে খাওয়া শ্যাষ করেন। পরে মোবাইল দ্যাখবেন।
—দেখ নজরুল, ইতিহাস কী বলছে?
—ঠিকই স্যার, কত কষ্টে আমরা আমাদের দেশ পেয়েছি।
—সেটা আর ভাবে কতজন? আবার ইচ্ছা রইল আটঘর কুড়িয়ানা যাবার।
—আপনার পা আর বুকের ব্যথা কেমন আছে?
—এত শিগগীর কি কমবে? ডাক্তার হয়ে বোঝ না? তবে সহ্যের মধ্যে আছে।
—ওষুধ কি কিছু আনিয়ে দেবো?
—ওরে, ব্যথা তো মনের ব্যাপার। ভাবো, কালকের দিনের কথা। শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে কেমন কয়েক ঘণ্টা প্রকৃতি আর ইতিহাসকে ছুঁয়ে এলাম। কত লোকের সাথে কথা হল। কাউকে কি আপনজন নয় বলে মনে হয়েছে?
—তা ঠিক বলেছেন।

মাঝে আর একটা দিন কাটল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছি, পাশ ফিরতে গেলে বুকের ডানদিকে একটু ব্যাথা লাগছে। তবে কলকাতা অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারব সেই ক্ষমতা আছে। ক্লিনিকে ছাত্রদের পড়ানোয় যতটা না মন, তার থেকে বেশি কান পড়ে আছে রোগ দেখাতে আসা সব মানুষগুলোর কথোপকথনে। অন্য বাংলার ডাক্তার পেয়ে ওরা বেশি আগ্রহে কথা বলে। বৃহস্পতিবার আশরফের বিশেষ মধ্যাহ্নভোজন সেরে ঢাকার উদ্দেশে যাবার জন্য তৈরি হলাম। একটু বেশি সাবধানেই চেয়ারে বসলাম মোজা পরতে। র‍্যাক থেকে নিজের জুতোটা হাতে নিতেই ফারুক বলে,
—ওটা থাক।
—মানে?
—এই জুতাটা পায়ে দেন।
—এ তো নতুন জুতো। এসব আনতে গেলে কেন?
—কারণ আছে। পুরনোটা ছাড়েন।
—কেন? অসুবিধা কোথায়?
—ওটার সোল কি আর সোল আছে? সব সমান হয়ে গেছে। ওই দিন নৌকায় পিছলে পড়ার পর আমরা ঘরে এসে লক্ষ্য করলাম জুতোর খুব করুণ অবস্থা। এভাবে চলাফেরা করবেন না স্যার।

আপত্তি আর করলাম না। আছাড় খেলে লোকে হাত ধরে টেনে তোলে; কিন্তু তার কারণ খুঁজতে জুতো উল্টে দেখে কে? তারপর আবার সাইজ দেখে নতুন কিনেও আনে, অকল্পনীয়! এর উত্তরে ধন্যবাদ দেওয়া চলে না, শুধু সমপ্রাণদের সাথে একাত্মতা অনুভব করা যায়। নীরব কৃতজ্ঞতায় আপনজনদের দিকে তাকিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখলাম। চোখ পড়ল রাস্তার উল্টোদিকে কবি জীবনানন্দের বসতবাড়ির দিকে। মনে হলো প্রবেশপথে লেখা বাড়ির নাম ‘ধানসিঁড়ি’ যেন আমার দিকে তাকিয়ে কতকিছু বলছে।

আবার আসিব ফিরে…।

অলংকরণ – রাতুল চন্দরায়