দীপংকর ঘোষ
রানিগঞ্জমুখী হয়ে দাঁড়ালে শুশুনিয়া মোড় থেকে ডানদিকে একাটা রাস্তা চলে গেছে সোজা পাহাড়ের দিকে। ওই রাস্তা দিয়ে দশ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায় একদম পাহাড়ের গোড়ায় ঝর্নাতলায়। আমরা সেই রাস্তা ধরেই হাঁটা শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল, সংসারের জটিল ঘূর্ণাবর্তে পাক খেতে খেতে হাঁপিয়ে ওঠা কয়েকটা লোক সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে এসেছি। এখন আমরা মুক্ত। আমাদের বেঁধে রাখার কেউ নেই এখানে। ব্যাচেলার লাইফের সেই দিনগুলো যেন আবার ফিরে এসেছে আমাদের জীবনে। এখন যেন কোথাও আমাদের হারিয়ে যাবার নেই মানা।
দু-হাত দূরে পাহাড় আমাদের তার সর্বস্ব দিয়ে ডাকছে। সে ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা যায়! এই ডাকে স্ত্রী-পুত্র-পিতা-মাতা সবাইকেই উপেক্ষা করা যায়। এগিয়ে চলি খোলা মাঠের পাশ দিয়ে, সেগুন, ছাতিম, সোনাঝুরির ছায়ায় ঢাকা পথ দিয়ে। বর্ষার জল পেয়ে গোটা প্রকৃতি যেন খিলখিল করে হাসছে। সেগুন গাছের ফুলে ঢেকে গেছে তার পাতা। রাস্তার ধার ধরে বয়ে চলেছে উঁচু জায়গা থেকে নেমে আসা জলের প্রবাহ। চারপাশে কত চেনা অচেনা বড় বড় গাছের ভিড়ে সবুজ হয়ে রয়েছে গোটা এলাকা।
এটা শ্রাবণ মাস। গোটা মাস ধরে চলে শিবের ‘জলাভিষেক’ অনুষ্ঠান। কত দূর দূর গ্রাম-গঞ্জ থেকে ভক্তদের সমাগম হয় এখানে। শিবের মাথায় জল ঢালবে বলে পুণার্থীরা ঘটে করে সংগ্রহ করে পবিত্র ঝর্নার জল। চলার পথে আমাদের আশপাশে, দূরে এরকম প্রচুর ভক্তের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বাচ্চা নির্বিশেষে। রাস্তার দুই ধার ধরে প্রচুর অস্থায়ী চালা, বাঁক রাখার জায়গা তৈরি হয়েছে। শ্রাবণী মেলা চলছে নানা জায়গায়। তার জন্য দোকানের কাঠামো বানানো চলছে। আগামী কাল থেকে মেলা। আগামী কালই সবাই ঝর্নার জল সংগ্রহ করে হাঁটা লাগাবে দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে বাঁকুড়া জেলার বিখ্যাত এক্তেশ্বর মন্দিরে বাবার মাথায় জল ঢালার জন্য। ভক্তদের পরনের গেরুয়া-কমলা রঙের পোশাকের সাথে প্রকৃতির সবুজ মিলে রঙিন হয়ে উঠেছে গোটা শুশুনিয়া উপত্যকা। পায়ে পায়ে এগিয়ে আমরা এসে দাঁড়াই ঝর্নাতলায়।
ঝর্না বলতে যে ছবিটা আমার মনে ভেসে উঠেছিল, সামনে এসে দাঁড়াতেই কোথায় মিলিয়ে গেল সেই ছবি। এ আবার কেমন ঝর্না! ইট-বালি-সিমেন্টের তৈরি দেওয়ালে ঘেরা একটা জায়গা। সেই দেওয়ালের মাঝ বরাবর একটু উঁচুতে দেওয়ালে গাঁথা এক সিংহ মূর্তি। আর সেই মূর্তির পায়ের তলা দিয়ে জল এসে পড়ছে সেই ঘেরা জায়গার বাঁধানো চাতালে, যে ভাবে রাস্তার টাইম কলে জল পড়ে— ঠিক সেই রকম। ওখানে আর দাঁড়াই না।
ঝর্নার পাশ দিয়েই রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ে। বড় বড় গাছপালা, ঝোপঝাড়, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছোট বড় নানা আকারের বোল্ডার বিছানো রাস্তা। সোজা এঁকেবেঁকে উঠে গেছে পাহাড়ের অনেক উপরে। সাবধানে পা ফেলে উঠতে থাকি। এই ধরনের রাস্তায় প্রচুর আলগা পাথর থাকে, যেগুলোর ওপর পা পড়লে হড়কানোর সম্ভাবনা! চারপাশের বৃষ্টি ধোয়া সবুজ প্রকৃতির রূপ দেখার সাথে সাথে নিজের পায়ের নীচের ওই স্যাঁতসেঁতে পাথুরে পথের দিকেও তাই নজর দিতে হয়। কোন পাথরটার পর কোন পাথরে পা দিয়ে উঠলে পরিশ্রম কম হবে ভাবতে হয় সেটাও। বেশ চড়াই রাস্তায় পরপর পাঁচজন আমরা উঠে চলেছি। নীচে ঝর্নাতলা থেকেই আমাদের সঙ্গী হয়েছে একটা কুকুর। ভেবে দেখলাম, দ্রৌপদী-ই শুধু কম পড়েছে। সে থাকলে আমাদের এই যাত্রাকে নিশ্চিন্তে ছোটখাটো একটো মহাপ্রস্থানের রূপ দেওয়া যেত।
আমাদের এই দলে আমার আর গোরার-ই শুধু ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতা আছে। এর থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক রাস্তায়, অনেক বেশি কষ্টসাধ্য পথে আমরা হেঁটে এসেছি। তাই আমাদের দুজন নয়, আমার চিন্তা ছিল টুটুদা আর শানুকে নিয়ে। রূপনকে নিয়ে ভাবি না। ওর অল্প বয়স। পুরো জোশ রয়েছে ওর মধ্যে। কিন্তু ওই দু’জন! টুটুদার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আমার সেরকম ধারনা নেই। এই প্রথম ওর সঙ্গে বেরিয়েছি। কিন্তু যতই সুস্থ থাকুক বয়সটাতো পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। তাই এই ভাঙাচোরা পাহাড়ি চড়াই কতটা ভাঙতে পারবে তা নিয়ে আমার মনে সন্দেহ ছিল।
কিন্তু শানুকে জানি। ও একটু অদ্ভুত ধরনের বেপরোয়া চরিত্র। এই যে ও আমাদের সঙ্গে এসেছে, এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে ট্রেন ধরার মিনিট কুড়ি আগে। ওর একটা রোগ আছে, যাকে মোশন সিকনেস্ (Motion Sickness) বা হাই অলটিচ্যুড সিকনেস (High Altitude Sickness) বলে। উঁচু জায়গা থেকে, যেমন পাহাড় বা অনেক উঁচু বাড়ির উপর থেকে নীচের দিকে তাকালে মাথা ঘোরে। মনে হয়, এই বুঝি পড়ে গেলাম। এছাড়াও ওর কোমরে একটা চোট আছে, অনেক ছোটবেলার। তবু এত প্রতিকূলতা কেটে বেরোনো আর সেখান থেকে নিজেকে চার্জ করার জন্য ওর প্লাস্টিকের ব্যাগে নিয়েছে হুইস্কির বোতল। কিন্তু তবু আমার মনে প্রশ্ন ছিলো, ওকি পারবে?
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখলাম আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ফিট রূপন সবার আগে উঠে চলেছে। এবং তার পরেই রয়েছে চার্জড শানু। এরপর একে একে টুটুদা, গোরা আর আমি। ক্রমশ উঠেই চলেছি। আমাদের দুপাশে বড় বড় গাছ, ঝোপঝাড়, জঙ্গল। বেশির ভাগ গাছই আমার অচেনা। মাঝে মাঝেই দেখা পাচ্ছি সুন্দর সুন্দর জংলি ফুলগাছের। মাথার উপর গাছের ডাল, পাতা ছাদ তৈরি করে রেখেছে। আমরা ছাড়া এ পথে আর কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।
(ক্রমশ)
অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়