পর্ব -২

(‘সব খেলার সেরা’ ফুটবলকে নিয়ে বাঙালির উৎসাহ, আবেগের শেষ নেই। আর সেই উত্তেজনার পারদ চড়বে এবছরেরই নভেম্বর মাসে। শুরু হবে কাতার বিশ্বকাপ-২০২২। তার আগে হাতে কিছুটা সময়। এই সময়ে জেনে নেওয়া যাক বিশ্বকাপকে ঘিরে অনেক অজানা, চমকে দেওয়ার মতো গল্প। ‘বিশ্বকাপের ইতিহাস’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে প্রতি বুধ ও শনিবার। লিখছেন অনিন্দ্য শর্মা।)

ফিফা ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেয় উরুগুয়েকে। কারণ, ১৯৩০ সালটি ছিল উরুগুয়ের সংবিধানের প্রথম শতবর্ষ। আরেকটি কারণ, ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে সোনার মেডেল পেয়েছিল উরুগুয়ে।
বিভিন্ন ফুটবল-খেলিয়ে দেশকে আমন্ত্রণপত্র পাঠালো ফিফা। কিন্তু সাড়া মিলছে না। ১৯৩০ ইউরোপ জুড়ে মন্দার সময়। অনেক দেশ অথনৈতিক ভাবে ধুঁকছে। এমন অবস্থা, একটা গোটা ফুটবল টিম পাঠানোর ক্ষমতা নেই তাদের। আবার অনেক খেলোয়াড় ফুটবল খেলতে যেতে চাইছে না। ভাবছে, খেলার পরে ফিরে এসে যদি দেখে, মালিক চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে! এদিকে ব্রিটেন আগেই বলে দিয়েছে তারা ফিফার ওই পেশাদারি খেলায় তারা অংশ নেবে না। একই পথের পথিক ডেনমার্ক ও জার্মানি। একসময় মনে হয়েছিল, ইউরোপ থেকে বোধহয় কোনও দেশ যাবে না। ইউরোপ ছাড়া কি বিশ্বকাপ হয়? সেই সময় না আফ্রিকা, না এশিয়া— দুই মহাদেশের কোনও দেশই ফুটবলে নাম করতে পারেনি। ফুটবল বলতে লাতিন আমেরিকা আর ইউরোপ। আর যদি ইউরোপই না যায় তবে বিশ্বকাপের আয়োজন বৃথা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

আসরে নামলেন জুলে রিমে। রাজি করালেন নিজের দেশ, ফ্রান্সকে। রাজি হল বেলজিয়াম, রোমানিয়া ও যুগোশ্লাভিয়া (আজকের দিনে এই দেশটি ভেঙে গিয়েছে)। মোট চারটি দেশ। তবে এই দেশগুলির অংশগ্রহণের আর একটি কারণ শোনা যায়। সেটা হল, উরুগুয়ে তখন ধনী দেশ। তারা এইসব ইউরোপীয় দেশগুলিকে অর্থ সাহায্য করতো। লাতিন আমেরিকা থেকে অংশ নিল ৭টি দেশ (আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বলিভিয়া, চিলি, পেরু, প্যারাগুয়ে এবং উরুগুয়ে) এবং উত্তর আমেরিকার দু’টি দেশ—আমেরিকা আর মেক্সিকো। এই ১৩টি দেশ নিয়ে হবে প্রথম বিশ্বকাপ। ইউরোপের মূল ফুটবল খেলিয়ে দেশগুলি বিরত রইল প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ থেকে। সেই দেশগুলি হল, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ইতালি ও স্পেন।
যাই হোক, শুরু হল প্রথম বিশ্বকাপ। ১৩ জুলাই। চলবে ৩০ জুলাই পর্যন্ত। প্রথম বিশ্বকাপে নিঃসন্দেহে প্রথম দু’টো দেশ উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা। উরুগুয়ে দু’বার পরপর অলিম্পিক জিতেছে। আর্জেন্টিনা ১৯২৯ সালের সাউথ আমেরিকান ফুটবল চ্যাম্পিয়ন। তবে ব্রাজিলের টিম তত শক্তিশালী ছিল না। অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জেরবার ব্রাজিল শুধু ক্যারিওকা(Carioca) থেকে প্লেয়ার নিয়ে এসেছিল।

ফাইনালে উরুগুয়ের প্রথম গোল

প্রথম বিশ্বকাপে সবাইকে চমকে দেয় যুগোস্লাভিয়া আর আমেরিকা। আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের সাথে তারাও ওঠে সেমিফাইনালে। সেমিফাইনালে উরুগুয়ে হারালো যুগোস্লাভিয়াকে। আমেরিকাকে বিধ্বস্ত করল আর্জেন্টিনা— ৬-১। এর আগেও ১৯২৮ সালের অলিম্পিকে আর্জেন্টিনা ১১-২ গোলে হারিয়েছিল আমেরিকাকে। কিন্তু ১৯৩০ বিশ্বকাপে খেলার শুরুতে চোট পায় আমেরিকার দুই খেলোয়াড়। চোট এতটাই গুরুতর যে তারা খেলা চালিয়ে যেতে পারে না। সেই সময় পরিবর্তের নিয়ম ছিল না, তাই নয়জনকে নিয়ে খেলতে হয় আমেরিকাকে। উরুগুয়েও যুগোস্লাভিয়াকে হারায় ৬-১ গোলে। তবে সেই খেলায় ঘটে বেশ কিছু বিতর্কিত ঘটনা। খেলার চার মিনিটে যুগোস্লাভিয়া এগিয়ে যায়। কিন্তু তারপর আসে প্রথম বিতর্কিত মুহূর্ত। একটি গোল বাতিল হয় যুগোস্লাভিয়ার। আবার উরুগুয়ের প্রথম দুটি গোলও বিতর্কিত। তার মধ্যে দ্বিতীয় গোলটি তো সাংঘাতিক। এই গোলটির ক্ষেত্রে অবদান ছিল মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশের। বল যখন থ্রো লাইন ক্রস করছে, সেই সময় সে বলটি কিক করে মাঠে উরুগুয়ের খেলোয়াড়ের পায়ে দিয়ে দেয়। সেই পাস থেকে দ্বিতীয় গোল।
ফাইনালে আর্জেন্টিনা বনাম উরুগুয়ে। ফুটবলের দুই চিরশত্রু দেশ। ১৯২৮ সালে অলিম্পিকে তারাই ছিল ফাইনালিস্ট। তখন ফলাফল ২-১। উরুগুয়ে বিজয়ী।

এবার উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওর এস্তাদিও সেন্টেনারিও স্টেডিয়ামে ফাইনাল। ৯০০০০-এর বেশি লোক খেলা দেখতে এসেছেন (পরিসংখ্যান বিতর্কিত: অফিশিয়াল উপস্থিতি ৬৮৩৪৬)। খেলার ১০ মিনিটের মধ্যে উরুগুয়ে একটি গোল দিয়ে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর গোল শোধ করে আর্জেন্টিনা। তারপর একসময় এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা, ২-১। তবে খেলার শেষে গৌরবের হাসি হাসে উরুগুয়ে। প্রথমবার জুলে রিমে কাপ জিতে নেয় তারা। ৪-২ গোলে হারায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনাকে।
খেলার পরের ঘটনা
আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের আগে থেকেই ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছিল মাঠে থাকা উরুগুয়ের সমর্থকরা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে দর্শক আর্জেন্টিনার এক খেলোয়াড়কে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেয়। এছাড়াও মাঠে উপস্থিত আর্জেন্টিনার সমর্থকদের নিগ্রহ করা হয়। প্রতিশোধ নিতে বুয়েনস আইরেসে উরুগুয়ের দূতাবাস আর্জেন্টিনার নাগরিকেরা ভাঙচুর করে। ফলে দুই দেশের সরকার পরস্পরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।