বেঁচে থাকলে আজ রাজা রামমোহন রায়ের বয়স হতো ২৫০। ১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলি জেলার রাধানগরে জন্ম হয়েছিল ভারতের রেনেসাঁর জনক রামমোহন রায়ের। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা, নারী মুক্তি, শিক্ষার আধুনিকীকরণ, ধর্মের গোড়ামি ও সামাজিক কুসংস্কারের থেকে মুক্তি। এই সমস্ত আন্দোলনের পুরোধা পুরুষের জন্মদিনে একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য দিল মহারাষ্ট্র সরকার। 

মহারাষ্ট্র সরকারের গ্রামোন্নয়ন দফতরের তরফে জারি করা একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘‘কোলহাপুরের হেরওয়াড গ্রাম পঞ্চায়েত প্রস্তাব পাশ করে বৈধব্য সম্পর্কিত সব আচার নিষিদ্ধ করেছে। এখন রাজ্যের অন্য গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিরও উচিত একে মেনে চলা।’’ মহারাষ্ট্রের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী হাসান মুশরিফ তাঁর রাজ্যে একজন মহিলাকে বিধবা হবার পরে যে সব আচার মেনে চলতে হয়, সেগুলি বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই বিজ্ঞানের যুগে প্রাচীন প্রথাগুলির কোনও স্থান থাকা উচিত নয়।

ঘটনার সূত্রপাত মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর জেলার দু’টি গ্রামে। এগুলি হল, শিরোল তহসিলের হেরওয়াড গ্রাম ও হাটকানঙ্গলে তহসিলের মানগাঁও গ্রাম। এই মানগাঁও অবশ্য ঐতিহাসিক গ্রাম। ১৯২০ সালের ২১ মার্চ এখানেই বাবাসাহেব আম্বেদকর ও ছত্রপতি শাহু মহারাজ অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রথম যৌথ আন্দোলন শুরু করেন।

প্রস্তাব রাখছেন মুক্তাবাই সঞ্জয় পূজারী

এই দু’টি গ্রাম মহারাষ্ট্র দিবসের দিন (১লা মে) তাদের গ্রামসভায় বৈপ্লবিক প্রস্তাব পাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে— এখন থেকে গ্রামের কোনও নারী বৈধব্যের বেদনাদায়ক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে যাবেন না। প্রস্তাবে লেখা হয়েছে, ’’কোনও মহিলার স্বামী মারা গেলে তাঁকে সিঁদুর মুছে ফেলতে হয়, মঙ্গলসূত্র খুলে ফেলতে হয়, চুড়িগুলি ভেঙে ফেলা হয়, এমনকি পায়ের নথ পর্যন্ত খুলে ফেলা হয়। সেই সঙ্গে ওই মহিলাকে কোনও ধর্মীয় ও সামাজিক সমাবেশে যেতে দেওয়া হয় না। কেড়ে নেওয়া হয় সামাজিক মর্যাদা। এ ধরনের কাজগুলি তাঁকে তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। বিধবারা যাতে অন্য যে কোনও নারীর মতো জীবনযাপন করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে আমাদের গ্রামে এই ধরনের আচার-অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হল।”

হেরওয়াড গ্রামে কোভিডে ১২জন লোকের মৃত্যুর পরে বিষয়টি নিয়ে প্রথম ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। এই গ্রামের সরপঞ্চ সৌগন্ধ পাতিল বলেছেন, ‘‘যাঁদের স্বামী মারা গিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে আমরা ৫০০০ টাকা করে দিয়েছি। নিখরচায় তাঁদের শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। আর আমরা এমন একটা প্রস্তাব পাশ করেছি যাতে বিধবা-আচার নামের কুপ্রথা বন্ধ হয়।’’ গ্রাম পঞ্চায়েতের সামনে সর্বপ্রথম এই প্রস্তাব রাখেন মুক্তাবাই সঞ্জয় পূজারী। তাঁকে সমর্থন করেন সুজাতা কেশব গৌরব। মুক্তাবাই জানিয়েছেন, তিনি সবসময়েই বিধবাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বুঝতে পেরেছিলেন, কোনও পারিবারিক কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্বামীহারা মহিলাদের যেতে না দিলে তাঁরা কতটা মানসিক কষ্ট পেয়ে থাকেন। গোটা বিষয়টি উপলব্ধি করেই তিনি গ্রামের সামনে প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

মহারাষ্ট্রের  গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী হাসান মুশরিফ

তবে এই পুরো কাজটি প্রথম শুরু করেন মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলার কারমালা তহসিলের পোথরে গ্রামের প্রমোদ জিনজাদে। তিনি বলেছেন, ” আমার একজন সহকর্মী যখন মারা যান এবং তাঁর স্ত্রীকে সামাজিক ভাবে অস্পৃশ্য করে দেওয়া হয়, তখন আমি ভাবতে শুরু করি এসবের পরিবর্তন দরকার।”  প্রমোদ জানান, তিনি একটি ১০০ টাকার  স্ট্যাম্প পেপার কিনে এনেছিলেন এবং আইনি ভাবে জানিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে বৈধব্য পালন করতে হবে না। কিন্তু প্রমোদ জিনজাদে শুধু নিজের স্ত্রীকে বৈধব্যের যন্ত্রনাদায়ক আচার থেকে মুক্তি দিয়ে থেমে থাকেননি। তিনি সমাজে তাঁর বার্তা ছড়িয়ে দেন। কথা বলেন বিভিন্ন গ্রামের সরপঞ্চদের সঙ্গে। সেই সময় তাঁর সাথে পরিচয় হয় হেরওয়াড গ্রামের সরপঞ্চ সৌগন্ধ পাতিলের সঙ্গে। ২০১৯  সালে কোলহাপুর জেলায় বন্যাত্রাণের কাজের সময় তাঁদের পরিচয় হয়। সৌগন্ধ পাতিল বলেছেন, “আমি প্রমোদ জিনজাদের চিন্তাভাবনায় ভীষণ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম এবং আমাদের গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। তাঁরা সবাই একে সমর্থন করেছেন। ফলে আমরা প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ একই ভাবে মানগাঁওয়ের রাজু মগদুমও জিনজাদের কাজ দেখেছিলেন। এখানকার গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য সন্ধ্যাতাই যাদব তাঁর বাড়িতে সদ্য  বিধবা হওয়া বৌদিকে সমস্ত বৈধব্য আচার পালন করা থেকে বিরত করেন। তার পর মানগাঁও গ্রামেও একই ধরনের প্রস্তাব পাশ হয়।

বন্ধ হবে বিধবা প্রথা

হেরওয়াড ও মানগাঁও গ্রামের এমন উদাহরণ মহারাষ্ট্র সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাজ্যের মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী যশোমতী ঠাকুর ১৯ মে  হেরওয়াড গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁদের জানিয়ে দেন, এই নীতি গোটা রাজ্যে চালু করার চেষ্টা করা হবে। শরদ পাওয়ারের কন্যা ও এনসিপি-র সাংসদ সুপ্রিয়া সুলেও এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। মানগাঁওয়ের সন্ধ্যাতাই যাদব বলেছেন, ‘’স্বামী মারা যাওয়ার কারণে একজন মহিলাকে উপেক্ষা করা হলে তাঁর কী অনুভূতি হয়, সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি। তাই ঠিক করলাম, কোনও ভাল কাজ বাড়ি থেকেই শুরু করা উচিত। অন্যরা যাকে অনুসরণ করতে পারবে। সেজন্যই আমরা প্রস্তাব পাশ করেছি।’’

রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর প্রায় দেড়শ বছর পরেও যে দেশে রূপ কানোয়ারের মতো সতীদাহের ঘটনা ঘটে, আর আজও প্রতিনিয়ত সামাজিক-শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে দিন কাটাতে হয় মহিলাদের, সেই ভারতের ছোট্ট দু’টি গ্রামের বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নারী স্বাধীনতার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।