(আমের হাজারো জাত। অথচ পশ্চিমবঙ্গে বাণিজ্যিক ভাবে লাভজনক ৫/৭ টি মাত্র আম এখন বাগানে বসানো হচ্ছে। আমের বাজারেও নির্দিষ্ট কয়েকটি জাতেরই রমরমা। বিলুপ্তির পথে কয়েকশো জাতের আম । অথচ সেদিকে নজর নেই কারও। আমের এই সঙ্কট ও সম্ভাবনার বিভিন্ন দিককে তুলে ধরেছেন দীপককুমার দাঁ।)
আম ভারতের নিজস্ব সম্পদ— বলেছেন বিশিষ্ট আম-বিজ্ঞানী ড. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়। আগের তত্ত্ব ছিল আমের জন্ম মালয়েশিয়ায়। এখন বাতিল। আমের বয়স পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, ভারতে আমের উদ্ভব বা জন্মস্থান অসম থেকে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অবিভক্ত ভারত থেকে মালয়, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আম চাষ প্রসার লাভ করেছে। এখন মিশর, দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, হাওয়াই প্রভৃতি দেশে আম চাষ হচ্ছে। তবে, গুণমানে ভারতীয় ও বাংলাদেশের আমই সেরা।
তামিল ভাষায় আমকে বলে মাঙ্গা। ইউরোপীয় বণিকরা (১৫১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ) এখানেই প্রথম আমের সঙ্গে পরিচিত হয়। অবশ্য এর আগে স্থলপথে যে সব পরিব্রাজক (হিউয়েন সাঙ প্রমুখ) বা যুদ্ধের কারণে (যেমন, আলেকজান্ডার) যাঁরা এদেশে এসেছিলেন, তাঁরাও আমের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি অভিধানে ‘ম্যাঙ্গো’ কথাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। ম্যাঙ্গো-মানে আম। ভারতে আকর্ষণীয় ও গুণমানে শ্রেষ্ঠ আমের জাতবৈচিত্র্য (ভ্যারাইটি) সৃষ্টিতে মুসলমান শাসকদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। মরুভূমির রুক্ষ কঠিন পরিবেশ থেকে এসে এমন রসালো সুমিষ্ট ফল পেয়ে তাঁরা মুগ্ধ হয়ে যান। আকবর তৈরি করেন লাখবাগ। একলক্ষ আমের গাছের বাগান। অভিজ্ঞ মালীদের যত্নে ও চেষ্টায় তৈরি হয় নানা জাতের, নানা আকৃতির, নানান বৈশিষ্ট্যের গুণসমৃদ্ধ আম।
আম গাছ এক-দেড়শো বছর বাঁচে। ফলনও দেয়। পাঞ্জাবের চণ্ডীগড়ের বুলাইল গ্রামে ২৭০০ বর্গগজ দখল করে দাঁড়িয়ে আছে অতিকায় এক আমগাছ। আম দ্বিবীজপত্রী সপুষ্পক উদ্ভিদ। বর্গ—স্যাপিনডালস্। এই বর্গে রয়েছে চারটি গোত্র। আম হল অ্যানাকারডিয়েসি গোত্রের। গণ—ম্যাঞ্জিফেরা। প্রজাতি নাম—ইন্ডিকা, তাই বৈজ্ঞানিক নাম—ম্যাঞ্জিফেরা ইন্ডিকা। সব ভারতীয় আমই এই প্রজাতিভুক্ত। উদ্ভিদবিদেরা এ পর্যন্ত ২৫০০ আমের জাত (Variety) তালিকাভুক্ত করেছেন। এর বাইরে ৮ থেকে ৯ হাজার আমের জাত রয়েছে। আকবরের ‘লাখবাগ’ আমবাগান যেমন ইতিহাস প্রসিদ্ধ তেমনি পশ্চিমবঙ্গে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদে গড়ে ওঠে আম গবেষণা কেন্দ্র। এই জেলায় রয়েছে প্রায় ২০০টি আমের জাত। সারা পশ্চিমবঙ্গে এক-দেড় হাজার প্রায় আমের জাত থাকতে পারে।
এই সময়ে বহির্ভারতে আমের জনপ্রিয়তায় আলফানসো শীর্ষে। এই আম মহারাষ্ট্র, গোয়ার নিজস্ব। এতে জলের ভাগ কম। তাই দীর্ঘ সময় ভাল থাকে। ১০-১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় ও শুকনো জায়গায় রাখলে আলফানসো মাসখানেক ভাল থাকে। ব্যবসায়িক ভাষায় একে বলা হয়— ‘হাই কিপিং কোয়ালিটি’।
পশ্চিমবাংলার জনপ্রিয় আম বলতে বোঝায়, বোম্বাই, হিমসাগর ও ল্যাংড়া। স্বাদে, গন্ধে ও গুণমানে অতুলনীয়। কিন্তু, প্রত্যেকটিতে জলের ভাগ বেশি থাকায় খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায় (লো কিপিং কোয়ালিটি)। ফলে, ব্যবসায়িক গুরুত্ব কম। বৈশাখের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পশ্চিমবাংলায় দক্ষিণবঙ্গের পাকা আম আসে। এরপর উত্তরবঙ্গের (প্রধানত মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার আম আসে দক্ষিণবঙ্গে)।
উত্তরবঙ্গের আমে বোল আসে দক্ষিণবঙ্গের পর, কারণ সূর্য ধীরে ধীরে উত্তরায়ণে প্রবেশ করে। একই কারণে ভারতে প্রথম আমে বোল আসে কেরল, তামিলনাড়ুতে। এজন্য, আম পাকেও এখানে সবার আগে। এরপর অন্ধ্র, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র। ফলে কম বেশি ৪/৫ মাস ধরে ভারতে আম পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের আম শেষ হলে বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে আম আসে। কারণও একই। অক্ষাংশ বেশি থাকায় সূর্যের তাপের হেরফেরে এই পরিবেশগত প্রাকৃতিক বিভিন্নতা।
ল্যাংড়া, হিমসাগর, কিষেণভোগ, মালদা ইত্যাদি আমে ছিবড়া নেই। বোম্বাই, গোলাপখাসে আছে। তবে খুব অল্প। বিভিন্ন জাতের আমে শাঁসের পরিমাণেও নানা হেরফের দেখা যায়। আবার, সব আমের মিষ্টত্ব সমান নয়। মানে চিনির পরিমাণে (সুগার কনটেন্ট) হেরফের দেখা যায়। ১.৩২ কিগ্রা হিমসাগর আমে শাঁসের পরিমাণ ৯২৭ গ্রাম, আবার ১.৭৯৪ কিগ্রা ফজলি আমে শাঁসের পরিমাণ ১.৪২৩ গ্রাম। হিমসাগর আমে চিনির পরিমাণ বেশি ফজলি বা অন্যান্য বেশির ভাগ আমের তুলনায়।
আমের শাঁসে ফ্রুকটোজ মিশিয়ে সংরক্ষণের জন্য গবেষণা হচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি বিভাগে। এই শাঁস থেকে ম্যাঙ্গো স্কোয়াশ, ম্যাঙ্গো স্প্রেড (জেলি), কাস্টার্ড, ক্যান্ডি, পিউরি ইত্যাদি নানা খাবার বানিয়ে প্যাকেট করে বাজারজাত করা যেতে পারে। বাজারে এখন ম্যাঙ্গো স্কোয়াশ পাওয়া যায়। এছাড়াও ম্যাঙ্গো পাই, ম্যাঙ্গো কেক, পিকলস্, আইসক্রিম—এসবও তৈরির নানাচেষ্টা চলেছে। আম-সন্দেশও এখন নাগালের মধ্যে। আমের গন্ধ-এর নির্যাস বাণিজ্যিক ভাবে তৈরির জন্য গবেষণা চলছে। এক আউন্স ম্যাঙ্গো ফ্লেভারের দাম ৬০০-৭০০ টাকা (ইউরোপে)। সুরার সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
এতো গেল ভাল ভাল কথা। কিন্তু এই সময়ে ভারতে আমকে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কারণে চরম সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এই সঙ্কট যেমন আমের জাতবৈচিত্র্য সংরক্ষণে তেমনি পরিবেশের ভারসাম্যগত কারণেও। অখচ এসব সঙ্কট কাটিয়ে আমকে ঘিরে ব্যাপক অর্থনেতিক কর্মকাণ্ড বিস্তারের সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে। যা আমরা ভেবেও দেখছি না।
আঁটির আম আর কলমের আম— এই দু’ভাবেই আম আসে পশ্চিমবঙ্গের বাজারে। কলমের আমের কদর যেহেতু বেশি, তাই আঁটির আম প্রতিযোগিতায় টিঁকতে পারছে না। কলমের আমের মধ্যে বাজার জাঁকিয়ে বসে রয়েছে—গোলাপখাস, বোম্বাই, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি ইত্যাদি। আর কিছু চালানি আম—তোতাপুরি, চৌসা, দশেরি, মল্লিকা ইত্যাদি। জনবসতির চাপে অসংখ্য বাগান নির্মূল হচ্ছে। সেই সঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে আমের জাতবৈচিত্র্য। নতুন আমবাগানে নির্দিষ্ট ৫/৭ টি মাত্র কলমের আমগাছ লাগানো হচ্ছে। আর এক-দশক পরে (২০৩০) আমের শতকরা ৯৫ ভাগ জাত-বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে ৩০ ভাগ প্রায় আমের জৈব বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যা ফিরিয়ে আনা কোনভাবেই সম্ভব না। আমের ব্যাপক ‘মনোকালচার’-এর (শুধুমাত্র ব্যবসায়িক গুরুত্বপূর্ণ ৫/৭ টি জাত) কারণে প্রকৃতিতে নানা সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
আমের মঞ্জুরি বা বোল (Compound raceme or panicle) হল ফুলের আধার। ফুল ক্ষুদ্র, নিয়মিত, বেশিরভাগ আমের জাতের ফুল মিশ্রবাসী Polygamous । অর্থাৎ পুং, স্ত্রী, উভয়লিঙ্গ ও ক্লীবলিঙ্গ একটি মঞ্জুরি দণ্ডে দেখা যায়। কোন কোন আমের জাতের একলিঙ্গ ফুল থাকে। প্রতিটি ফুল সবৃত্তক। আমের এত জাতবৈচিত্র্য সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ ফুলের গঠনে। আমের শঙ্কর পরাগ সংযোগের বিধি থাকায় বহু জাত সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। মাটির গুণাগুণ, আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত— এসব কারণেও আমের অসংখ্য জাতবৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে। এগুলিকে রক্ষা করতে হবে। ব্যবসায়িক গুরুত্বের পাশাপাশি প্রকৃতি সংরক্ষণেও নজর দেওয়া জরুরি।
বাংলা ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে আম চাষের ‘হট স্পট’। এখানে আছে আমচাষে কয়েকশো বছরের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা। এখনও অনেক প্রাচীন আমবাগান আছে, যেখানে কয়েকশো জাতের আমগাছ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে মূল্যবান ফসল-বৈচিত্র্য। এদের বিষয়ে বেশিটাই অজানা। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। কম-বেশি ছয়মাস কর্মসংস্থান সম্ভব এই ক্ষেত্রে। আমের বর্তমান সঙ্কট কাটিয়ে সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরির জন্য কয়েকটি বিষয় ভাবা যেতে পারে। যেমন,
১) আম চাষ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্মকে বিশেষ বাণিজ্যিক প্রয়াস হিসাবে ঘোষণা করা। বাগান পরিচর্যা, প্রতি বছর প্রচুর আম ফলবে এমন উন্নতমানের কলম চারা তৈরির উদ্যোগ (এজন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন), আম চাষে জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার (এজন্য প্রশিক্ষণ জরুরি), পুরানো আম গাছ রক্ষায় আইন প্রণয়ন। জৈব-প্রযুক্তির আধুনিক প্রয়োগ কুশলতাকে কাজে লাগানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমের বোল থেকে গুটি বেশি পরিমাণে বের করা যেমন সহজসাধ্য, তেমনি অনেক বেশি ফলনও নিশ্চিত করা যায়।
২) কাঁচা ও পাকা আম থেকে অনেক ধরনের উপজাত খাদ্য তৈরি সম্ভব। পাকা আম সংরক্ষণে চাই পর্যাপ্ত হিমঘর। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় একাজে বহু কর্মসংস্থান হবে।
৩) সারা দেশে এমনকি বিদেশে পশ্চিমবঙ্গের আম রপ্তানিতে ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এজন্য পুঁজি চাই। চাই উপযুক্ত পরিকল্পনা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন SHG সংগঠন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে।
৪) পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়া ও রুচি-পছন্দের নিরিখে কোন ধরনের আমের চাহিদা বেশি, তার নিরিখে গবেষণা ভাবনা জরুরি। দক্ষিণবঙ্গের আম ও উত্তরবঙ্গের আমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। সেকথা মাথায় রেখে সারা ভারতে আমের ব্যবসায় পশ্চিমবঙ্গ সামনের সারিতে যেতে পারে।
সঙ্কট কোথায়?
আমবাগানে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে সেচ ও সার প্রয়োগের কোনও চেষ্টা দেখা যায় না। প্রকৃতির দানে বিনা আয়াসে যা ফলন দেয়, আমরা তাতেই সন্তুষ্ট। উপযুক্ত কৃষিপ্রয়াস থাকলে পশ্চিমবঙ্গে আমের ফলন বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব। এখন আমবাগান বিক্রি একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক প্রয়াস। বাগান মালিকেরা ১/২/৩ বছরের জন্য বাগান বিক্রি করে দেয় নগদ অর্থের বিনিময়ে। এবার ব্যবসায়ীর স্বার্থ— আমপাড়া/আম বিক্রি। এজন্য, লোকনিয়োগ—বাগান পাহারা, আমপাড়া, কার্বাইড দেওয়া, বাজারে নিয়ে যাওয়া, পাইকারি বিক্রি— এসব কাজে বহু মানুষ যুক্ত। সারা পশ্চিমবঙ্গে কয়েক লক্ষ ভেন্ডার এবং খুচরা আম বিক্রেতা আছে। যারা বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত আম কেনাবেচা ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। আমের ব্যবসা থেকে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। অথচ, এই পরিমাণ দ্বিগুণ করা সম্ভব।
পাকা আম—কিছুটা ক্ষারীয় (অ্যালকালাইন) কাঁচা আম টক, মানে অ্যাসিডিক। বাইরের রাজ্য থেকে প্রভূত পরিমাণে আম পশ্চিমবঙ্গে আসে। জুলাই মাস-চৌসায় বাজার ছয়লাপ। মার্চ-এপ্রিল–দক্ষিণ ভারতের আম। পশ্চিমবঙ্গের আম কতটা পরিমাণে রাজ্যের বাইরে যায়? বেকার ছেলেরা (৮/১০ জনের এক-একটি সমবায় ভিত্তিক SHG গঠন করে) বাইরে আম পাঠানোর ব্যবসায় নামতে পারে। এজন্য বিপণন ব্যবস্থা (মার্কেটিং) সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি।
পাকা আম সংরক্ষণে জেলায় জেলায় আরও হিমঘর গড়ে তোলা প্রয়োজন। কাঁচা ও পাকা—দু’ধরনের আমের যথাযথ বাণিজ্যিক ব্যবহারে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের আমের ব্যবসায় নামার জন্য প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা করা জরুরি।
পশ্চিমবাংলায় ‘পূর্ণাঙ্গ আম গবেষণা কেন্দ্র’—গড়ে তোলা প্রয়োজন। আলফানসো, চৌসা, দশেরি এসব আম একমাসের বেশি সময় ভালো থাকে। সারা ভারত জুড়ে এদের বিক্রির বাজার। গুণমানে বোম্বাই, হিমসাগর, লক্ষণভোগ, ল্যাংড়া অনেক শ্রেষ্ঠ হলেও অল্পদিনেই পচে নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য এমন গবেষণা প্রয়োজন, যাতে এইসব আম আরও দীর্ঘ সময় তরতাজা রাখা যায়, তার পদ্ধতি উদ্ভাবন।
আমের খোঁজে
১) আড়াইসেরি— খুব বড় আকারের আম। কাঁচায় ভাঙে। আচারের কারখানায় চলে যায়। সুস্বাদু নয়। বিলুপ্তির পথে।
২) আনারসে— আনারসের স্বাদ। সাইজ এক-দেড় কেজি, পাকায় লাল হলুদ।
৩) আষাঢ়ে— আষাঢ় মাসে পাকে।
৪) এঁসে— খুবই আঁশ। খুব বড়ো, মোটা। শাঁস কম, রস বেশি। আমসত্ত্বের জন্য ভাল।
৫) কানাইবাসি—দু’টো জাত। একটা সবুজ; আর একটা সবুজাভ লাল-হলুদ, ভিতরের শাঁস লালচে। প্রথমটি হালকা-হলুদ। ফলন ভালো। গাছ মাঝারি আকৃতির। প্রতি বছরই কম বেশি কিছু ফলন হয়। দেখতে ল্যাংড়ার মতো।
৬) কাঁচামিঠে— কাঁচা খায়। জনপ্রিয়। টক কম হওয়ায় কাঁচায় খায়। প্রতিটি ৫ টাকা—৭ টাকা দামে বিক্রি হয়। ছোটো গাছ। পাকলে পানশা। এ গাছে আম কেউ পাকায় না। গাছ খুব কম।
৭) কিসানভোগ— দু’তিনটে জাতবৈচিত্র্য আছে। কেউ পাকলে হলুদ-লাল; কেউ বা গাঢ় পীত রং। খুব মিষ্টি। পাকায় শক্ত ভাব থাকে। ফলন ভালো। বাজারে ভালো দাম মেলে। আমচাষির বন্ধু। সুস্বাদু, রসাল, আঁশ নেই। বর্তমানে জনপ্রিয়। বাগানে প্রচুর লাগানো হচ্ছে। গাছ খুব বড়ো হয়। ঝাঁকড়া গোছের। শাঁস-লালাভ হলুদ। খোসা মোটা।
৮) কাকুড়ে— পাকায় সিঁদুর। তলায় পড়লে কাকুড়ের মত ফেটে যায়। আঁটি আলাদা হয়ে যায়। ওজনে ২০০-৫০০ গ্রাম একটি।
৯) কাকুড়ে (অন্য জাত) — কাঁচায় কাঁঠামিঠে আমের মতো। পাকায় পানশা। ফলন ভাল। গাছ খুব কম। বিলুপ্তির পথে। কাঁচামিঠের বিকল্প হিসাবে বাজারে চলছে।
১০) খাসকেল— প্রকাণ্ড বড় গাছ। ৩-৪ জন লাগবে গাছের গোড়া জড়িয়ে ধরতে। প্রতি তিন বছরে একবার ফলন। কিন্তু প্রচুর ফলন। পাকায় সবুজ। ভেতরটা হলদে। অসম্ভব মিষ্টি এবং প্রচুর রস। আঁশ নেই। বঁটিতে কাটলে ভাল চাকা হয় না। দাঁত দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে কামড়ে খাওয়াই সুবিধা। বর্তমানে বিলুপ্ত।
১১) খিসাপাতি— আঁশ ভর্তি। পাকায় টক ভাব। শাঁস হলুদাভ। ফলন কম। বিলুপ্তির পথে। বড় গাছ।
১২) গোলখাস— গোলাপখাসের মতো রঙ হয়। গোল, আঁশ কম। সুস্বাদু, ফলন কম। বিলুপ্তির পথে।
১৩) গোলাপখাস—বাজারের অন্যতম আদরের আম। বেশ শক্ত। পাকায় অনেকদিন ভাল থাকে। গাছ মাঝারি। একটা বিশেষ সুগন্ধ আছে। আম খুব মিষ্টি নয়; আঁশ আছে। ফলন-মাঝারি। বাজার দর ভাল। এর রঙের বাহার আমাদের বিশেষ আকৃষ্ট করে।
১৪) চোষণকাঠি—আকারে লম্বাটে। পাকলে হলুদ। পাকায় টক। সাইজ ছোটো। ফলন ভাল। বিলুপ্তির পথে।
১৫) ছোটো সাঁই— বিলুপ্তির পথে।
১৬) ফুরফুরে— সামান্য হাওয়া দিলেই ৮-১০ টা আম পড়বে। বোঁটা খুব শক্ত। ছোট সাইজ। থোকায় ৮-১০ টা আম থাকে। স্বাদ ভাল।
১৭) টরজেল— বিলুপ্ত। সাইজ বড়। আপেলের মতো রং। সুস্বাদু। ফলন কম।
১৮) তিলে— গায়ে কালো তিলের দাগ। এক বোঁটায় ১৫-২০ টা আম হয়। গাছ ভেঙে পড়তো, এত ফলন। স্বাদ ভাল।
১৯) দলদলে— পাকায় বোম্বাই-এর মতো। সাইজে বোম্বাই-এর থেকে বড়।
২০) নেকো—আমের শেষ অংশ বাঁকা। পাকায় হলুদ। আঁশ আছে। স্বাদে – মিষ্টি। বিলুপ্তির পথে।
২১) পিটুলে— গাছে পাকত। সাইজ খুব বড়। এক— দেড় কেজি এক একটা। আঁশহীন। স্বাদ মোটামুটি। আমসত্ত্বের আম। দেরিতে পাকে।
২২) পিয়ারাফুলি— ছোট আকারের। প্রচুর ফলন হয়। গাছে ভীষণ লাল পিঁপড়ে ও কাঠ পিঁপড়ে থাকে। পাকলে হলুদ। খুব মিষ্টি। আঁশ আছে। বিলুপ্তির পথে। খুব বড় গাছ হয়। শাঁস হলুদ।
২৩) পেঁপেতলি— পাকায় হলুদ, স্বাদে পেঁপের মতো। আঁশ নেই। ২০০-৩০০ গ্রাম। জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকে।
২৪) ফজলি— বেশ বড় আকারের আম। স্বাদে সামান্য টক রস ও পানশা। ফলন ভাল। গাছ খুব বড় হয় না। ২ টি জাত আছে। দেরিতে পাকে। শাঁস-সাদাটে হলুদ।
২৫) বড়ো সাঁই— ফলন কম। খেতে সুস্বাদু নয়। কেমন একটা গন্ধ যুক্ত। গাছ ছোট।
২৬) বর্ণচোরা— কাঁচা ও পাকায় রং কালো। মিষ্টি।
২৭) বোম্বাই— বিশাল গাছ। বৈশাখের তৃতীয় সপ্তাহেই বাজারে আসে। হিমসাগরের আগে পাকে। বাজার দর ভাল। অল্প হলেও, সব বছরই ফল দেয়। রসালো। মিষ্টি, তবে সামান্য টক ভাব আছে। গন্ধ সুন্দর। শাঁস লালাভ। ২/৩ দিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়।
২৮) বোম্বাই(গ্রেট) — আকারে খুব বড়। একটা-এক কেজি প্রায়। গাছও বড়। ফলন মাঝারি। খেতে পানসে। সব বছর ফল দেয় না।
২৯) বোম্বাই (চ্যাটা)— চ্যাপ্টা আকৃতির। চওড়া বেশি, লম্বা কম। বোম্বাই-এর কাছাকাছি। ফলন কম। বিলুপ্তির পথে।
৩০) বোম্বাই (নিধির)— গাছ মাঝারি সাইজ। লতানো মতো। বোম্বাই-এর থেকে গুণমানেকম। ফলন কম। বিলুপ্তির পথে।
৩১) বোম্বাই (লম্বা)— ঐ। প্রচুর রস। আমসত্ত্ব দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত। সাইজে বড়।
৩২) বোম্বাই (ভুতো)— বিশাল গাছ। আম সুস্বাদু। মিষ্টি, কিন্তু হালকা টক রস আছে, যেটা এর আভিজাত্যের প্রকাশ। একটু দেরিতে পাকে। আকারে বড়, লম্বাটে। আঁশ নেই। ফলন ভাল। গাছ খুব কম।
৩৩) বৈশাখী— বৈশাখ মাসেই পাকে। পাকায় রং হলুদ। সাইজ- ১০০-১৫০ গ্রাম। আঁশ নেই। স্বাদ মোটামুটি।
৩৪) বৌপাগলি— গোলাপখাসের খুব কাছাকাছি।
৩৫) বৃন্দাবনী – ফলন ভাল। খোসা পুরু। ঝাঁকড়া গোল গাছ। পাকায় হলুদ। বিশেষ একটা সুন্দর গন্ধ আছে। বাজার ভাল নয়। বিলুপ্তির পথে।
৩৬) বোতলমুখী আম— ফজলির মতো, বড় সাইজ, চ্যাপটা। স্বাদে মিষ্টি, তবে পেঁপের মতো। ফলন মাঝারি। ওজন বেশি। আমে পোকা লাগে। বিলুপ্তির পথে।
৩৭) ভেজা— আমের স্বাদ কষা। পাকায় একেবারে হলুদ। স্বাদ মিষ্টি। তবে কষা ভাব। ফলন ভাল। আকার মাঝারি, গোল। বিলুপ্তির পথে।
৩৮) ভূগোল— দেরিতে পাকে। আকারে বেশ বড়। ফলন কম। বাজার দর কাঁচায় ভাল নয়। খুব কম দেখা যায়।
৩৯) মধুমালতি— সাইজ ছোট। খেতে খুব মিষ্টি। মধুর চেয়ে মিষ্টি। পাকায় রং লাল (এক পিঠ)। উল্টো দিক সবুজ।
(৪০) মালসাভোগ— দেরিতে পাকে। বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।
৪১) মালদা— ২/৩ জাত আছে। পাকলে কেউ হলুদ, কেউ সবুজ। স্বাদেও পার্থক্য আছে। ছোট গাছ। প্রতি বছর ফলন দেয়। আঁশ নেই। স্বাদ ভাল, মিষ্টতা কম। বাজার দর মাঝামাঝি। জ্যৈষ্ঠের শেষে পাকে। ফলন কম। শাঁস ফিকে হলুদ।
৪২) মোহনভোগ— বিলুপ্তির পথে। বাজার দর ভালো, খেতে সুস্বাদু। ফলন কম।
৪৩) মধুকুলকুলি— খুব ছোট আকারের আম। পাকায় মিষ্টি। স্বাদে ভাল। ফলন – বেশি। পোকা লাগে না। স্প্রে করতে হয় না। বিলুপ্তির পথে।
৪৪) মিছরি দমদম— গোলাপখাসের জাত ভাই। পাকলে সবুজ-হলুদ, সামান্য লাল।
৪৫) রসগোল্লা – আকারে ছোট, গোল। স্বাদে টক। পাকলে সবুজ। বিলুপ্তির পথে।
৪৬) লংজাম— বিলুপ্ত। আকারে ছোট। পাকলে সবুজাভ হলুদ। সুস্বাদু। ফলন কম।
৪৭) ল্যাংড়া— দু’টি জাত। জলদি ও নাবি। দেশি ল্যাংড়া স্বাদে ভাল বেনারসি ল্যাংড়ার থেকে। বড় গাছ। ফলন ৩/৪ বছরে একবার। তা-ও খুব বেশি নয়।
৪৮) সরিখাস— সিজনে (মরসুমে) প্রথম পাকে। বাজারে আসে। মেটে লাল রং। টক রস। ফলন ভাল। গাছ মাঝারি আকৃতির। পাকায় অনেক দিন ভাল থাকে।
৪৯) সিঙে— বাঁকা, শিং-এর মতো। পাকায় এক পাশে হলুদ, অন্য পাশে সবুজ।
৫০) সিঁদুর কোটো— সাইজ ছোট, ১০০-১৫০ গ্রাম প্রতিটি।
(৫১) স্বর্গসুধা— খেতে খুব ভাল। পাকায় হলুদ। ২৫০-৩০০ গ্রাম। প্রতি বছর ফলে।
৫২) হিমসাগর দিশি— বড় গাছ। ফলন কম। আমের আকার ফজলির মতো। স্বাদ ভাল। আঁশ নেই। বিলুপ্তির পথে।
৫৩) হিসমাগর— লালাভ হলদে। ২৫০-৩০০ গ্রাম। সুস্বাদু মিষ্টি। জনপ্রিয়। ভাল দামে বিক্রি হয়।
আমের আরও কিছু নাম :- চিনিখাস, হারিবাড়ি, মালতি, কলা, পাঁচনম্বর, বাতাসাভোগ, রুইমুড়ো, দোফলা, কলামোচা, টার্জেন, পুতুলে, খোড়া, বালিশ, কাস্তে, টোকো ফজলি, ঠাকুরে, মুণ্ডমালা, কেটো ফজলি, আঁটির ল্যাংড়া, পচামানিক, বেনারসি গোলাপখাস, সাঁইভোগ, কেলেপাহাড়, লঘুজাম, দুর্গাভোগ, সবজা, লেবু, পাটালি, হাঁড়ির বাটি, দুধে মালদা, সিপি ল্যাংড়া, টুরটুরি, সুর্মা ফজলি, পাথুরে বোম্বাই, মানিকআশ, তালতুলি, যদুদাস, রাজভোগ, শিবভোগ।