(চিকিৎসার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপ্লব নিয়ে এসেছে লেসার। আগামী দিনে আরও অনেক কিছু দেখার জন্য অপেক্ষা। লিখেছেন সুবীর বিশ্বাস।)
গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে আয়ুর্বেদাচার্য মহর্ষি সুশ্রুতের আশ্রম। তিনি একদিকে শল্যবিদ্যার জনক অপরদিকে রসায়নবিদও। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শহর, উত্তর ভারতের কাশী তখন সারা ভারতের শিক্ষাকেন্দ্র। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এরকম অজস্র আশ্রম। আসলে এক একজন ঋষির গবেষণা কেন্দ্র।
গঙ্গায় অবগাহনের পর মহর্ষি আশ্রমে আসতেই বয়স্ক শিষ্য শাম্ব এসে বলল, “প্রণাম মহর্ষি, আপনার কথামত রুগীকে আঁরক খাইয়েছি। উনি এখন গভীর নিদ্রায়। তাহলে কি ওকে শল্যবেদীতে শোয়াবো?”
মহর্ষি, “ জান শাম্ব, লোকটা এখন প্রায় কিছুই দেখে না। ওর দৃষ্টি অনেকটা উন্নত করা যাবে ঠিকই, কিন্তু আগের মতো দেখতে পাবেন না। আবছা দেখবে। আমি এক ধরনের আঠা থেকে চোখের মণি (লেন্স) বানিয়েছি। তার আকার-সহ খুঁটিনাটি অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা এখনও বাকি। দরকার ছিল আরও কিছু শব ব্যবচ্ছেদ। যেমন নাক কাটা গেলে নিখুঁত ভাবে নাক বসিয়ে দিচ্ছি, তেমনি চোখের মণিও বসাতে পারতাম। পরিষ্কার দেখতে পেত। কিন্তু এখানে মনুবাদীদের নিদান— আমরা ব্রাহ্মণরা শব ব্যবচ্ছেদের মতো হাতেকলমে কাটাছেঁড়ার কোনও কাজ করতে পারব না। ওটা নিচু জাতের কর্ম। তার মানে আমাদের গবেষণার ইতি।’’
রাগে গজগজ করতে করতে মহর্ষি চললেন শল্যঘরে।
২৬০০ বছর আগে বিজ্ঞানী সুশ্রুতের আক্ষেপ, স্বপ্ন আজ পরিপূর্ণতা পেয়েছে। দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চোখের ছানি অপারেশন এখন জলভাত। সর্বাধুনিক ক্যাটারাক্ট অপারেশন হয় লেসার ছুরির সাহায্যে। কর্নিয়ায় লেসার বিমের সাহায্যে অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র করে (একটা চুলের ১০০ভাগের চেয়েও সরু, ১/২ মাইক্রোন) মাত্র দু-তিন মিনিটের মধ্যে কাজ শেষ। সম্পূর্ণ যন্ত্রণাহীন অপারেশন।
স্টার ওয়ার, স্টার ট্রেক, ব্যাটেল স্টার গ্যালাকটিকা মতো লেসারের কল্পকাহিনির সিনেমাগুলো এখন বাস্তবের মাটিতে নেমে এসেছে।। এখন মানব কল্যাণের বহু কাজে লেসার ব্যবহার করা হচ্ছে।
কিন্তু লেসার আসলে কি?
Light Amplification by Stimulated Emission of Radiation-এর সংক্ষিপ্ত রূপ, LASER. উদ্দীপিত নিঃসৃত আলোর বিবর্ধন। লেসার প্রথম তৈরি করেন মাইম্যান, কালিফর্নিয়ার HRL ল্যাবে। এর তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়েছিলেন দুই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী— টাউনস ও শলো । তবে আসল জনক কিন্তু আইনস্টাইন। তিনি ম্যাক্স প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের কিছু সংশোধন আনেন। সেটা ছিল ইলেকট্রন ও ফোটনের সংঘাতজনিত। সেই সংশোধনীকে কাজে লাগিয়ে ভারতের সি ভি রমন তরলে আলোর বিক্ষেপণ (scattering) ব্যাখ্যা করে নোবেল পুরস্কার পান। আর সেই একই সংশোধনের সাহায্যে টাউনস ও শলো তাত্ত্বিক লেসার তৈরি করেন ও নোবেল পান।
কোয়ান্টাম তত্ত্বানুসারে বিকিরণ বা শোষণ ঝাঁক ঝাঁক শক্তির প্যাকেট বা কোয়ান্টা হিসাবে হয়। আলোর কোয়ান্টামের নাম ফোটন আর তাপের নাম ফোনন। আপতিত কোনও একটি ফোটন শোষণ করে পরমাণুর কোনও ইলেকট্রন উচ্চ শক্তি কক্ষে লাফিয়ে উঠে, আবার সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে উচ্চ কক্ষের উত্তেজিত কোন ইলেকট্রনের নিম্ন কক্ষে সংক্রমিণ হয়। সঙ্গে সঙ্গে একই কম্পাঙ্কের ফোটন নির্গত করে।
লেসার পাম্পিং শক্তির সাহায্যে গেইন মাধ্যমের পরমাণুর ইলেকট্রন উত্তেজিত অবস্থায় রাখা হয়। ফলে একই কম্পাঙ্কের সংক্রমণজনিত ও আপতিত দুই ফোটন মিলে তৈরি করে উদ্দীপিত নির্গমণ বা stimulated emission। আর তার বার বার প্রতিফলন ঘটিয়ে বিপুল শক্তিতে বিবর্ধিত (amplification) করা হয়। যা আউটপুট কাপলারের ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসে আমাদের লেসার বিম। সুসংহত, একবর্ণী, উদ্দীপিত, সমাবর্তিত, একমুখী সমান্তরাল অতি তীব্র বিকিরণ।
লেসারের শাখাপ্রশাখা এখন সর্বক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করছে। চিকিৎসা, শিল্প, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-গবেষণা, যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা— সবকিছুর উন্নতির উল্লম্ফন ঘটিয়েছে।
এখন শহরের যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে লেসার কাটিংয়ের দোকান।
সিঙ্গাপুরের একটা সাধারণ কোম্পানিই কত ধরনের লেসার গ্যাজেট বিক্রি করছে। বিভিন্ন ছোট শিল্পে (MSME) লেসার যন্ত্র এখন অপরিহার্য।
ডাক্তার অপারেশনে যতই রক্তপাত কম করানোর চেষ্টা করুন না কেন, এটা ঘটে এবং সবসময় জটিলতা তৈরি করে। রক্তপাতহীন লেসার ছুরি সার্জেনদের এতদিনে স্বস্তি দিয়েছে। কিডনির পাথর ভেঙে ফেলা, লিভার ফুসফুসের চিকিৎসা, এন্ডোস্কপি, টিউমার বাদ দেওয়া ইত্যাদি অনেক সহজ করে তুলেছে। আর কসমেটিকসের ক্ষেত্রে তো বিপ্লব ঘটিয়েছে। ত্বকের পূণর্গঠন, ব্রন, কালো দাগ, অবাঞ্জিত চুল তুলে ফেলা ইত্যাদিতে লেসারের জুড়ি নেই।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় অপটিকাল ফাইবারের হাত ধরে লেসারের মাধ্যমে তথ্য সংকেত পাঠানো হয়, বিশেষত সমুদ্রের নিচ দিয়ে সাবমেরিন আলোক তন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থায়। আসলে লেসার একধরনের আলো হওয়ায় প্রতিসরণের অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন মেনে চলে। লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার যাত্রাপথে সংকেতের তীব্রতা এতটুকু কমে না। এছাড়াও মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ যোগাযোগে, রাডার ইত্যাদিতে একে কাজে লাগানো হয়।
আর তুমি না থাকলে সেমিকন্ডাক্টর চিপস্ তৈরিই হত না। যা আধুনিক বিশ্বের প্রাণ ভ্রমর। সিলিকন ওয়েফারারের জালিতে লেসারের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের লক্ষ লক্ষ ট্রানজিস্টারের গেট বর্তনী প্রিন্ট করা হয়। ধাতুর মোটা পাত, কোয়ার্টজ, কাচ কাটতেও লেসার এক্কেবারে নিখুঁত।
ডিফেন্সে লেসারের ব্যবহার এতদিন ছিল পর্দায় বা ভিডিও গেমসে। এখন এটা আকাশকুসুম কল্পনা নয়। লেসার অস্ত্রে আমেরিকা অবশ্য সবার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে। ভারতও একটা পর্যায়ে রয়েছে। শত্রুর আক্রমণকারী বিমান, মিসাইল, ড্রোন নিমেষে ধ্বংস করবে লেসার বিম।
আগামী দিনে যুগান্তকারী প্রয়োগ আসতে চলেছে বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন সাপ্লাই ব্যবস্থায়। সারা দেশব্যাপী চৈতন্যদেবের মতো দু-হাত তোলা উঁচু বিদ্যুতের খুঁটিগুলো সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে্। তার থেকে ঝুলছে জোড়ায় জোড়ায় মোটা সঙ্কর ধাতুর, ACCC (Aluminum Conductor Composite Core) তার, যার মধ্যে দিয়ে ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সরবরাহ চলে। তার জন্য কী বিপুল খরচ করতে হয়। অথচ লেসার বিমের সাহায্যে দু’একটা খুটির সাহায্যেই দুর দুরান্তে কোনও তার ছাড়াই বাতাসের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেত। এখন অবশ্য আলোক তন্তুর মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে। অ্যালয় তারের মতো অত দামী নয়, আবার হাল্কাও। এ ব্যাপারে আমেরিকার পাওয়ার লাইট টেকনোলজি ব্যবসায়িক ভাবে অনেকটা সফল। এটা তন্তুবাহিত শক্তি বা power-over-fibre পদ্ধতি নিয়ে এসেছে।
সেমিকন্ডাক্টর ডায়োড তড়িৎ থেকে আলো আর সোলার সেলের মতো কোষের সাহায্যে আলো থেকে তড়িৎ তৈরি হয়। সমস্যা অনেক। বিদ্যুৎ থেকে আলোর রূপান্তর দক্ষতা ৮৫%, কিন্তু আলো থেকে বিদ্যুতের ৫০%। গবেষণা চলছে কিভাবে শূন্যে বা অপটিকাল ফাইবার ছাড়াই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। টানেলের শেষের আলো দেখা যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী।
গত কাল থেকে সুবীর বিশ্বাসের লেখাটা কয়েক বার পড়লাম। খুব ভাল লাগল। বিষয়ের ওপর সুবীর বিশ্বাসের দক্ষতা প্রশ্নাতীত।তবে দুই একটা পশ্ন রাখতে চাই। সুবীর উত্তর দিলে সমৃদ্ধ হব:
১। বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা সাহিত্য রসে জারীত করে লেখা যায় কিনা ? তাহলে আমাদের মত সাধারণ লোকের কাছে আকর্ষণীয় হবে ।
২। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যে সব লেখা পড়েছি তা থেকে মনে হয়েছে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্বে বিশ্বাসি ছিলেন না। এ বিষয় একটু আলোকপাত করলে ভাল হয়।
৩। লেসার ছুরি বা রশ্মি সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে অথবা বিজ্ঞানের অগ্রগতি প্রাচীন গ্রন্থে যা বলা আছে সেগুলিকে হাইপোথিসিস ধরে এগোচ্ছে ধরে নেব ।
[email protected]