(যে নদী কবিতায় মানুষের মুখে মুখে, আজ তারই বেহাল দশা। অঞ্জনাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, আশ্বিনে হাট বসে ভারী ধূম করে, মহাজনী নৌকায় ঘাট যায় ভরে—। রবীন্দ্র কবিতায় ঠাঁই পাওয়া নদী আজ নালাতে পরিণত হয়েছে আমাদেরই দোষে। অঞ্জনার দীর্ঘশ্বাসের কথা শুনিয়েছেন সুজিত সাহা।)

রবীন্দ্র – নজরুল-মাইকেল তিনজনেই একে দেখেছিলেন। একদিন অবলুপ্ত হয়ে গেলেও, অঞ্জনা অমর হয়ে থাকবে — ‘অঞ্জনা নদী তীরে চন্দনী গাঁয়ে…’ কবিতায় অথবা নজরুলের ‘নদীটির নাম সই অঞ্জনা …’ গানে।
কিন্তু, বর্তমানে কেমন আছে সে? কেউ খোঁজ সেভাবে রাখে না! অথচ এই অঞ্জনা-ই ২০০০ সালের বন্যায় কৃষ্ণনগরকে রক্ষা করেছিল। টানা ন-দশ দিন বন্যার জল আটকে থাকার পর, এই নদীখাত দিয়েই জমা জল বয়ে গিয়েছিল শহরের বাইরে। রক্ষা পেয়েছিল কৃষ্ণনগর। প্রতিদানে কৃষ্ণনগরের নাগরিকেরা অঞ্জনাকে কী দিয়েছে? কিছুদিন কমিটি গড়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। যথারীতি, সমস্ত উদ্যোগই একসময় স্থিমিত হয়ে গিয়েছে। ফেরানো যায়নি রুগ্ন অঞ্জনার স্বাস্থ্য। কৃষ্ণনগর শহরের ভিতরে অঞ্জনা এখন পরিণত হয়েছে নালায়।

বর্ষায় জলঙ্গির জলস্তর মোহনায় (নবদ্বীপ) ভাগীরথীর থেকে উপরে থাকে তখন জলঙ্গির (স্থানীয় নাম খোড়ে) জল পিছন দিকে প্রবাহিত হয়। এই ভাবেই সেই জলের ধারা উল্টোদিকে বেগে প্রবাহিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল অঞ্জনার। বর্তমানে নদীর উৎসমুখে গেলে দেখা যাবে— জলঙ্গির থেকে অঞ্জনা নদীখাত প্রায় সাত আট ফুট উপরে। ফলে জলঙ্গির এক বিন্দু জলও এখন অঞ্জনায় প্রবেশ করে না। উৎসমুখের নদীখাতে চলছে অবাধে চাষাবাদ। শহরের বর্জ্য নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে অঞ্জনায়। নদী খাত বুজিয়ে নির্মিত হয়েছে বহুতল। দোকানপাট এমন ভাবে গজিয়ে উঠেছে যে কোনও কোনও জায়গায় নদীর অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না। প্লাস্টিক ফেলে ফেলে নদীর শ্বাসরোধ হয়ে গেছে। আগাছা, কচুবন রীতিমতো ঢেকে দিয়েছে নদীর শেষ চিহ্নটুকু। কৃষ্ণনগর পরিবেশ বন্ধু-র মতো কিছু সংগঠন প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ও থার্মোকল সামগ্রী ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরসভা এলাকায় বর্জ্যের ব্যাপকতা বুঝিয়ে দিচ্ছে, পরিবেশ কর্মীদের সেই আর্তি কানে নিচ্ছেন না অধিকাংশ নাগরিক।
বেজিখালী মোড়ের হরিজন পল্লী থেকে শুরু করে শক্তিনগরের অঞ্জনা পাড়া, দোগাছি— সবাই অঞ্জনাকে যথেচ্ছ আঘাত করেছে। ব্যাসপুর, পাটুলির কাছে অঞ্জনা পরিণত হয়েছে চাষের জমিতে। যেখানে জল আছে, সেখানে নদী ভাগ করে চলছে মাছ চাষ। ফলে নদী চুরি নয়, হয়েছে ডাকাতি!

অঞ্জনার বয়স প্রায় ৪০০। জলঙ্গির শাখানদী। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পাশে ‘রাজারদিঘি’ আদতে অঞ্জনারই অংশ। শহরের উত্তর-পশ্চিমে শ্মশান কালীবাড়ি এলাকায় জলঙ্গি নদী থেকে অঞ্জনার উৎপত্তি। বেজিখালি, রাজবাড়ি, শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল, দোগাছি, চন্দনদহ হয়ে রানাঘাট মহকুমার ব্যাসপুরের কাছে চূর্ণীতে মিশেছে। মনে করা হয়, এই চন্দনদহই প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সেই চন্দনী গাঁ। শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল থেকে দোগাছি পর্যন্তই অঞ্জনাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু, নদীর গতিপথ রোধ করে চলছে মাছ চাষ। ২৭ কিলোমিটার লম্বা নদী। কৃষ্ণনগর শহরের মধ্যে ৭ কিলোমিটার পথ প্রবাহিত হয়েছে। অঞ্জনা আসলে জলঙ্গি এবং চূর্ণী নদীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপনকারী।

নদীর জলে ইতিহাস বয়ে চলে। অঞ্জনা দিয়ে একসময় বয়ে যেত বহু বাণিজ্যতরী। নদীপথে অঞ্জনা হয়ে পৌঁছে যাওয়া যেত মুর্শিদাবাদ। কিন্তু রাজবাড়ির পাশ ঘেঁষে মুর্শিদাবাদের নৌকো যাওয়া নিয়ে আঙ্গুল তোলেন রাজা রুদ্র রায় (১৬৮৩ – ৯৪)। মতান্তরে, মূলত বহিরাগতদের প্রবেশ রোধ করতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় অঞ্জনার মুখ। অঞ্জনা গতি হারানো শুরু করে তখন থেকেই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও শহর বাঁচানোর জন্য বাঁধ দেন জলঙ্গির পাশে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বারবার। আধুনিক সমাজও চরম স্বার্থপরতার পরিচয় দিয়ে সমানে আঘাত করেছে অঞ্জনাকে। এভাবে চলতে থাকলে অঞ্জনা একদিন শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় ঠাঁই নেবে। বাকিটা ইতিহাস হতে খুব বেশি দেরি নেই।