বারো বছর পরে আবার বিশ্বকাপ ফুটবল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালের বিশ্বকাপ। এবারের বিশ্বকাপ ব্রাজিলে। যুদ্ধ-বিধস্ত ইউরোপে একটিও দেশ নেই যেখানে বিশ্বকাপ করা সম্ভব। তবে ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপের কথা বলার আগে একটু ঘুরে আসি ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে। প্রথমবার ভারতীয় ফুটবল দল অংশগ্রহণ করলো অলিম্পিকে। ক্যাপ্টেন তালিমেরেন আও (Talimeren Ao) বা টি আও। পরবর্তীকালে যিনি ডাক্তারি পাশ করে নিজের রাজ্য নাগাল্যান্ডে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করেছিলেন (ভারতীয় ফুটবলে এটি ব্যতিক্রমী, একমাত্র ঘটনা।) কেমন খেলেছিল ভারত ওই অলিম্পিকে? ইংল্যান্ডের প্রতিটি মাঠ কাদা স্যাঁতসেতে। অলিম্পিক শুরুর আগে ভারত কয়েকটি প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছিল। প্রতিটি ম্যাচে যথেষ্ট বড় মার্জিনে হারে। পাঁচটি প্র্যাকটিস ম্যাচে ৩৯টি গোল খেয়েছিল ভারত। অলিম্পিকে প্রথম রাউন্ডে ভারতের খেলা ছিল ফ্রান্সের সঙ্গে। ফ্রান্স তখন ইউরোপের সেরা না হলেও শক্তিশালী দল তো বটেই। ভারতের খেলোয়াড়দের মধ্যে কেউ কেউ ঠিক করলেন, তাঁরা খালি পায়ে মাঠে নামবেন। সেদিন মোট ৮ জন খালি পায়ে আর তিনজন, তাজ মহম্মদ, কে.পি. ধনরাজ, থান্মাদম ভার্গিস বুট পরে মাঠে নামেন। প্রথম ৩০ মিনিট গোল শূন্য। তারপর ফ্রান্স এগিয়ে এক গোলে। কিন্তু সেই গোলের ব্যবধান কমানোর সুযোগ নষ্ট করেন শৈলেন মান্না। পেনাল্টি মিস করেন তিনি। তারপর ভারত আবার একটি পেনাল্টি পায়। এবার মিস করলেন মহাবীর প্রসাদ। তবে খেলার ৭০ মিনিটে ভারতের হয়ে আহমেদ খানের পাস থেকে গোল শোধ করলেন সারাঙ্গাপানি রামন (Sarangapani Raman)। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। খেলার ৮৯ মিনিটে আবার গোল ফ্রান্সের। ২-১ গোলে জিতে ফ্রান্স গেল দ্বিতীয় রাউন্ডে।

ভারতের পারফরম্যান্স প্রশংসিত হল ব্রিটেনের সমস্ত কাগজে। সাক্ষাৎকার নেওয়া হল ভারতীয় খেলোয়াড়দের। একটি সাক্ষাৎকারে তালিমেরন আও বললেন -আমরা খেলি ফুটবল (FOOTBALL) আর আপনারা খেলেন বুটবল (BOOTBALL) । তারপর সারা ইউরোপ জুড়ে প্রচুর প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল ভারত। তার মধ্যে একটি ম্যাচে আজেক্স আমস্টারডামকে ৫-১ গোলে হারায় ভারত।
ভারত এরপর নাম দিল বিশ্বকাপের প্রাথমিক পর্বের খেলায়। প্রাথমিক পর্বে ভারতের গ্রুপের অন্য দেশগুলি— ফিলিপিন্স ,ইন্দোনেশিয়া ও বার্মা নাম প্রত্যাহার করে। এর ফলে সুযোগ এসে যায় ভারতের সামনে। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র পেল ভারত। কিন্তু সেই সুযোগ হারালো। যেতে অস্বীকার করলো ভারত। চালু গল্প হল, ভারতের খেলোয়ারেরা খালি পায়ে খেলতে অভ্যস্ত। কিন্তু ফিফার নিয়মে খালি পায়ে খেলা নিষিদ্ধ। ভারত তাই বিশ্বকাপে যায়নি। কিন্তু এই গল্পটি সত্যি নয়। অনেকগুলি কারণ দেখিয়েছিল AIFA — ঠিক টিম সিলেকশন না হওয়া ,মতবিরোধ ,পর্যাপ্ত প্র্যাকটিস ম্যাচ না খেলা ইত্যদি। সেই সময় ভারতীয় টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন শৈলেন মান্না। তাঁর কথা ধরলে বলা যায়, AIFA আসলে বিশ্বকাপ ফুটবলকে গুরুত্ব দেয়নি। তাদের কাছে অলিম্পিকের মহত্ব ছিল বেশি। ১৯৫০-এর পরে অতিক্রান্ত ৭২ বছর। আজও ভারত ফুটবল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে পারলো না। জানি না, কোনও দিন আমরা ভারতকে ফুটবল বিশ্বকাপে খেলতে দেখতে পারবো কিনা।
ফিরে যাই ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে। ঘটনার ঘনঘটা এই বিশ্বকাপে। সেবারই প্রথম সাসপেন্ড করা হলো দু’টি দেশকে। তারা হল জার্মানি ও জাপান। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু ইতালি নয় কেন? সে উত্তর অজানা। রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে সরে দাঁড়ালো রাশিয়া। সরি, রাশিয়া নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন, হাঙ্গেরি ও চেকোশ্লোভিয়া। আর্জেন্টিনার সাথে মতান্তর হলো ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের। আর্জেন্টিনা প্রাথমিক পর্যায় থেকে নাম তুলে নিলো। এছাড়া নাম তুলে নিলো ফ্রান্স ও ভারত। আর প্রথমবারের জন্য সংযোজিত হলো ইংল্যান্ড। মোট ১৩টি দেশ নিয়ে হল ১৯৫০ সালের চতুর্থ বিশ্বকাপ।
১৯৫০ সালের বিশ্বকাপের আগে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। ৪ঠা মে, ১৯৪৯। সেই সময় ইতালির সবচেয়ে নামী ক্লাব ছিল তুরিন ফুটবল ক্লাব। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি সেই সময় পাঁচবারের ইতালি লীগ চ্যাম্পিয়ান। ইতালির জাতীয় টিমের নয় নয় করে আটজন রেগুলার প্লেয়ার ছিল সেই টিমে। তুরিনের ক্লাবটি গিয়েছিল লিসবনে একটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে। ফেরার পথে তাদের প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে। মারা যায় প্লেনের ৩১ জন যাত্রী। তার মধ্যে ১৮ জন তুরিন ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড়। ভেঙে যায় ইতালির টিমের মেরুদণ্ড।

উরুগুয়ে ব্রাজিল ফাইনাল

১৯৫০ সালের উপলক্ষে ব্রাজিলে তৈরি হল একটি স্টেডিয়াম। মারাকানা স্টেডিয়াম। সেই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। ব্রাজিল দাবি করে, ওই মাঠে বসে এক সঙ্গে দুই লক্ষ লোক খেলা দেখতে পারে। গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বলছে, সংখ্যাটি এক লক্ষ আশি হাজার। এই স্টেডিয়ামটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৩ সালে।
টুর্নামেন্টের শুরুতে হট ফেভারিট ব্রাজিল। ব্রাজিলের ফুটবলে তখন মজেছে দুনিয়ার দর্শক। ১৯৪৯ সালে কোপা আমেরিকা কাপে ৭ ম্যাচে ৩৯ গোল দিয়ে কাপ জিতেছে ব্রাজিল। বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেছে, এই ব্রাজিলকে হারাবে সে সাধ্য কারও নেই। আর তাদের শুরুটাও চমৎকার। সুইডেনকে তারা হারালো ৭-১ গোলে আর স্পেনকে ৬-১ গোলে। আর একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছিল এই বিশ্বকাপে। শক্তিশালী ইংল্যান্ড হেরে যায় আমেরিকার কাছে। একটি ব্রিটিশ পত্রিকা লিখলো আমাদের কাছে যে সংবাদটি এসেছে সেটা ভুল। হয়তো কোথাও ১ সংখ্যাটি পড়েনি। রেজাল্ট ০-১ নয় ওটা ১০-১ হবে।
১৯৫০ সাল বাদে বাকি সমস্ত বিশ্বকাপে দুটি টিমের মধ্যে ফাইনাল হয়। ১৯৫০ সালে ফাইনাল হয়েছিল চারটি দলের মধ্যে। ব্রাজিল, উরুগুয়ে, স্পেন ও সুইডেন। এই চারটি টিমকে নিয়ে রাউন্ড রবিন লীগ খেলা হয়। চূড়ান্ত খেলা হয় ব্রাজিল ও উরুগুয়ের মধ্যে। গ্রুপ লীগের শেষে ব্রাজিল, সবার উপরে। উরুগুয়ের থেকে এক পয়েন্টে এগিয়ে। পরিস্থিতি এমন যে ব্রাজিল ড্র করলে বিশ্বকাপ জিতবে, আর উরুগুয়েকে জিততেই হবে।
ফাইনালে ব্রাজিলের সামনে উরুগুয়ে। ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে ব্রাজিল জিতবেই ধরে নিয়ে পর্তুগীজ ভাষায় আগেই তাঁর বিজয়-ভাষণ তৈরি করেছিলেন। ব্রাজিলিয়ান কনফেডারেশন সোনার পদকগুলিতে তাদের দলের প্লেয়ারদের নাম লিখে ফেলেছিল। ব্রাজিলের পত্রিকা ‘ও মুন্ডো’ (O Mundo) আগেই ব্রাজিলের ফুটবল দলের ছবি ছাপিয়ে লিখে দিলো— এরা হল নতুন চ্যাম্পিয়ন।

১৯৫০ সালের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে

ফাইনাল হল মারাকানা স্টেডিয়ামে। অফিশিয়াল রেকর্ড বলছে, ম্যাচে দর্শক ছিল এক লক্ষ তিয়াত্তর হাজার আটশো পঞ্চাশ জন। আর আনঅফিসিয়াল রেকর্ড বলছে, সংখ্যাটি দুই লক্ষ। খেলার প্রথম পঁয়তাল্লিশ মিনিট শুধু ব্রাজিল। ক্রমাগত আক্রমণ উরুগুয়ের গোলে। কিন্তু ক্যাপ্টেন ওবদুলিও ভারেলা (Obdulio Varela) এবং ভিক্টর অ্যান্ড্রেড (Victor Andrade) সেই আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। প্রথম ৪৫ মিনিট গোলশূন্য। বিরতির দুই মিনিট পরে ব্রাজিল এগিয়ে গেল এক গোলে। তারপর আবার ব্রাজিলের আক্রমণ। কিন্তু গোল হলো না। অপর দিকে ৬৭ মিনিটে ও ৭৯ মিনিটে দুটি গোল করলেন ঘিঘিয়া। উরুগুয়ে ম্যাচ জিতলো ২-১ গোলে। ১৯৩০ সালের পর উরুগুয়ে মাঝের দুটি বিশ্বকাপ খেলেনি। ১৯৫০ সালে এসে আবার চ্যাম্পিয়ন। দু’বার বিশ্বকাপ পেল উরুগুয়ে।
এই বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে উরুগুয়ে ক্যাপ্টেন ওবদুলিও ভারেলা (Obdulio Varela) যতগুলো সম্ভব ব্রাজিলিয়ান দৈনিক পত্রিকা কিনে নিজেদের ড্রেসিং রুমে নিয়ে এলেন। তারপর এগুলি বিছিয়ে দেন টয়লেটে, বাথরুম ফ্লোরে সব জায়গায়। তারপর তার টিমের সমস্ত খেলোয়াড়কে বললেন সেখানে মূত্রত্যাগ করতে। আর একটি কথা সবাইকে বললেন – ‘‘বয়েজ, বহিরাগতরা খেলবে না। চলো শো শুরু করা যাক।”
১৯৫০-এর বিশ্বকাপ হারার পরে ব্রাজিল তাদের সাদা জার্সি পাল্টে ফেলে নতুন রং নিলো হলুদ আর সবুজ।

2 COMMENTS

Comments are closed.