প্রথম বাংলা ব্যাকরণ ছাপা হয়েছিল ইংরেজিতে। লিখেছিলেন এক সাহেব! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এটি বঙ্গে ছাপা প্রথম বই। ছাপা হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে। অচিরে এই প্রেস হয়ে উঠেছিল বাংলার বিদ্যাচর্চার আঁতুড়ঘর। সূচনা হয়েছিল বাংলার মুদ্রণ শিল্পের রেনেসাঁর। 

ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হলহেড ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ প্রকাশ করেন। বইটি ইংরেজিতে রচিত হলেও উদাহরণসমূহ বাংলা হরফে মুদ্রিত হয়। অর্থাৎ, বাংলা ছাপার প্রথম প্রসব এই পুস্তক। এক কথায় একটি মাইল স্টোন স্থাপিত হয়। 
বইটির ভূমিকায় হলহেড লিখেছিলেন, ‘The path which I have attempted to clear was never before trodden ……. the landmarks to be set up for the guidance of future travellers’. বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত হলহেড ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে বাংলায় এসে প্রথমে সংস্কৃত তারপর বাংলা শিখতে শুরু করেন। কিন্তু প্রাচ্যের এক আঞ্চলিক ভাষায় ব্যাকরণ বই লিখে ফেলাটা খুব একটা সহজ কাজ ছিলনা। কী কারণে সাহেবরা বাংলা ব্যাকরণ রচনার মত কাজে উৎসাহিত হয়েছিলেন? উত্তর পেতে হলে ইতিহাসের পথ ধরে একটু হাঁটতে হবে। 

পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনা হল (১৭৫৭)। কিন্তু ইংরেজরা সরাসরি প্রশাসনিক ক্ষমতা গ্রহণ না করে নবাবের কর্মচারীদের দ্বারা রাজস্ব আদায় করত। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। তার পরেও কোম্পানি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতিতে শাসন চালাতে থাকে। অর্থাৎ তখনও রাজস্ব আদায় করত নবাবের কর্মচারীরা। বিনা পরিশ্রমে অর্থ ভোগ করাই কোম্পানির নীতি হয়ে দাঁড়ায়। যা ইতিহাসে ‘দ্বৈত-শাসন’ নামে পরিচিত। 

এই অপশাসনের ফলে শুরু হয় প্রশাসনিক অরাজকতা। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরে লন্ডনে ইংরেজ সরকারের টনক নড়ে। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংসকে গভর্নর করে বাংলায় পাঠানো হয়। তিনি তখন মাত্র সতের। বয়সে নবীন হলেও বিচক্ষণ হেস্টিংস অবসান ঘটালেন দ্বৈত-শাসনের। কোম্পানি সরাসরি শাসনভার গ্রহণ করল। প্রতি জেলায় একজন কালেক্টর নিযুক্ত হল। গঠিত হল ‘রেভিনিউ বোর্ড’। হেস্টিংস অনুভব করেছিলেন শাসক ও শাসিতের মধ্যে দৃঢ় যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ। সেই সাঁকো হল দেশীয় ভাষা। কলকাতা ভারতবর্ষের রাজধানী হওয়ার পর (১৭৭৩) বাংলা হয়ে উঠল অতি প্রয়োজনীয় ভাষা। ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের বাংলা শেখানোর জন্য হেস্টিংস হলহেড সাহেবকে অনুরোধ করলেন বাংলা ব্যাকরণ রচনা করার জন্য। সূচনা হলো ঐতিহাসিক এক পদক্ষেপের। উদ্দেশ্য যাই হোক একটি ব্যাকরণ বই ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী আসন পেল। শুরু হল বাংলা হরফের ছাপার কাজ। হলহেড-মিত্র চার্লস উইলকিন্স প্রথম বাংলা হরফ তৈরি করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকারের সহায়তায়। সঞ্চালনযোগ্য বাংলা মুদ্রাক্ষর দিয়ে ছাপা হল হলহেডের ব্যাকরণ। উদাহরণ স্বরূপ ব্যবহৃত বাংলা উদ্ধৃতিগুলো অধিকাংশ নেওয়া হয়েছিল কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস ও ভারতচন্দ্রের রচনা থেকে। বইটি ইংরেজি হলেও এই বাংলা উদাহরণগুলো ছাপার জন্যই তৈরি হয়েছিল বাংলা হরফ। ২৪৫ পৃষ্ঠার এই বইয়ের প্রায় এক চতুর্থাংশ পরিষ্কার বাংলা হরফে ছাপা হয়েছিল। এরপর বাঙালির লেখা পূর্ণাঙ্গ বাংলা ব্যাকরণ পেতে দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায়ের লেখা ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ ‘ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। 

1 COMMENT

Comments are closed.