পর্ব ৩৬

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

ভদ্রা নদীতে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেল। পাশাখালী থেকে সবাই মিলে রওনা দিয়েছি ঘণ্টা দুই আগে। সঙ্গে জলদস্যূদের ট্রলার-সহ মোটা চারটি ট্রলার। আমি ছিলাম বেলায়েত সরদারের ট্রলারে। সবাই মিলে সোজা চলে গেছিলাম ভদ্রা নদীর ঠোঁটায়। ভদ্রা নদী, পশুর নদীর পশ্চিম পাড় থেকে শুরু। নদীতে ঢোকার পথে একটা বাড়ানো অঞ্চল আছে। ওটাকে ঠোঁটা বলে। সুন্দরবনের জঙ্গল এলাকা। গরান, গেওয়া গাছে ভর্তি সে অঞ্চল। সেই গাছগুলির আড়ালে গিয়ে আমরা আমাদের ট্রলারগুলো রাখলাম। আমাদের উল্টো পাশে ভদ্রা ফরেস্ট অফিস। ট্রলারগুলো এমন ভাবে রাখা হল যাতে ফরেস্ট অফিসের লোকজন দেখতে না পায়। আবার পশুর ধরে ভদ্রার এই জায়গায়টি অতিক্রম করলে হারবাড়িয়া অঞ্চল শুরু। হারবাড়িয়া হল জাহাজের একটি বন্দরের মতো। মংলা সমুদ্র বন্দরের অনেক জাহাজ এখানে নোঙর করা থাকে। সেই রাতে অনেকগুলো জাহাজ ছিল। লাইটারেজ জাহাজ, স্পিডবোট, ট্রলারের লোকের আনাগোনা খুব বেশি, তারপর জাহাজ থাকার ফলে চব্বিশ ঘণ্টা আলো জ্বলছে। এছাড়া কোস্টগার্ডের প্রহরা সেখানে চলে সারা রাত। তাই ওই দিকটাও আমাদের জন্য সুরক্ষিত নয়। সবটা ভেবে ট্রলারগুলোকে লুকিয়ে রাখা হল জঙ্গলের আড়ালে।

এদিকে মাস্টার-সহ যে সাতজন আত্মসমর্পণ করবে, তারা সবাই সশস্ত্র। সবাই দস্যুদের মূল ট্রলারে। আর একটা ট্রলারে আছে তারা, যারা আত্মসমর্পণ করবে না আর কিছু সাধারণ জেলে যাদের অপহরণ করা হয়েছিল। মাস্টার  আর সোহাগের সাথে ছিল তাদের পরিবার। পলিন ,রাজীব আর ইয়ামিন ভাইকে সেই ট্রলারে থাকতে বললাম। আমি ছিলাম বেলায়েত সরদারের ট্রলারে।

শুরু হলো আমাদের অপেক্ষা। ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। ৱ্যাবের আসার কথা রাত ১২টায়। কিন্তু তাদের কোনও খোঁজ নাই। ফোনেও পাচ্ছি না। তার মানে বনের ভিতরে ঢুকে পড়েছে তারা। ৱ্যাবের দেরি দেখে উৎকন্ঠা বাড়ছিল। কি হবে? তারা আসার আগে যদি প্রশাসনের অন্য কোনও দল চলে আসে? যদি অন্য কোনও দস্যু দলের মুখোমুখি হয়ে যাই? নানা দুশ্চিন্তা বাসা বাধলো আমার মনে। তবে আদনানের উপর আমার পুরো ভরসা ছিল।  নেটওয়ার্ক সমস্যায় আমরা ঠিক করে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। এদিকে জোয়ার শুরু হয়েছে। সেটাও তাদের দেরি হওয়ার কারণ হতে পারে। ৱ্যাবকে আসতে হবে স্রোতের বিপরীতে।

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। রাত আড়াইটে তিনটে হবে। সেই সময় পশুর নদীর মাঝ বরাবর একটা লঞ্চ দেখতে পেলাম।  ছোট লঞ্চ। এই সময় অন্য কোনও লঞ্চের এদিকে আসার কোনও কারণ নাই। আমি নিশ্চিত ওটা ৱ্যাবের লঞ্চ। কিন্তু লঞ্চটি আমাদের পেরিয়ে বড় নদী ধরে এগিয়ে গেল। তা দেখে আমি টর্চ দিয়ে তাদের ইশারা করলাম। কিন্তু লঞ্চটি থামলো না। কয়েকবার ইশারা করার পর একটু পরে লঞ্চটি মাঝ নদীতে থেমে গেল। এর পরের মুহূর্তটাই সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত। ৱ্যাব  ও দস্যুদলকে মুখোমুখি করাতে হবে আমাকে। লঞ্চটি থেমে যাবার পরে আমি সবাইকে সেখানে থাকতে বললাম।  বেলায়েত সরদারের ট্রলার নিয়ে গেলাম সোজা ৱ্যাবের লঞ্চের কাছে। লঞ্চের পাশে গিয়ে দেখি চারপাশে ৱ্যাবের সদস্যরা অত্যাধুনিক অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত করতেই এমন সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন তারা।

আমি আমাদের ছোট্ট ট্রলারটা ৱ্যাবের লঞ্চের পাশে দাঁড় করালাম। ওখানে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তারা কেউ আমাকে চিনতেন না। অনেকেই জানতেন না যে আসলে কী হতে যাচ্ছে! আমি পরিচয় দিয়ে বললাম আমার আসার খবর অফিসারদের দিতে। এরপরে তাঁরা আমাকে তুলে নিলেন লঞ্চের উপরে। ওখানে বসে রয়েছেন মেজর আদনান, এছাড়াও আছেন অন্য দুই অফিসার। সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে বসলাম। আমাকে চা দেওয়া হল।

—কি অবস্থা ভাই? আপনি ঠিক আছেন তো? মেজর আদনান আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন।

—অবস্থা! যা কথা হয়েছিল তাই। সাতজন আছে আপাতত। আরও দুই-তিনজন ইতস্তত করছে। হয়তো আত্মসমর্পণ করতেও পারে। তবে ২৫-২৬জন দস্যু আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয়। তারা ওখানে আলাদা ট্রলারে আছে, আর আছে কিছু সাধারণ জেলে।

—আর অস্ত্রশস্ত্রের কি হলো?

—৫১টি অস্ত্র আর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গুলি।

কথাটা শোনার পর ওখানে উপস্থিত অফিসারদের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আসলে এতদিন এতো অভিযান হয়েছে , কিন্তু কোনও অভিযানে এতগুলি অস্ত্র একসঙ্গে পাওয়া যায়নি। আমার কথা শুনে তারা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। একটু পরে নীরবতা ভেঙে মেজর আদনান বললেন, তা হলে কাজ শুরু করা যাক। ভাই, আপনি ওদের নিয়ে আসেন।

আমি এরপর ফিরে এলাম মাস্টারদের কাছে। তখন রাত তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে। ট্রলার চালিয়ে পৌঁছে গেলাম দস্যুদের ট্রলারের কাছে, ভদ্রার ঠোঁটায়।

—চলেন ভাই, এবার চলেন।

আমি মাস্টারকে বললাম। দেখলাম তারাও প্রস্তুত। আর প্রস্তুত আমাদের পুরো টিম। পুরো যন্ত্রপাতি নিয়ে তারা রেডি। মাস্টারদের এই আত্মসমর্পণ লাইভ টেলিকাস্ট হবে যমুনা টিভিতে।

ভাসলো মাস্টারের ট্রলার। সুন্দরবনের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ যে দস্যুদলকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় ৱ্যাব বা অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেই দস্যুদলের মূল সদস্যরা তাদের ট্রলার ভেড়াল ৱ্যাবের  লঞ্চ ঘেঁষে। সাত জনের হাতে সাতটি অস্ত্র। সব লোড করা।  বাকি অস্ত্রগুলি সমস্তটাই বেঁধে ট্রলারের ভিতরে রাখা। তারা সেই অস্ত্রগুলি আমার কাছে জমা দিয়েছে আগেই। তারপরেও যদি কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, তার জন্যেই তারা সশস্ত্র অবস্থায়।

ট্রলার ভেড়াতেই  ৱ্যাবের সদস্যরা কৌতূহলী হয়ে পড়লো মাস্টারকে দেখার জন্য। এত বড় একজন দস্যু ! তাকে দেখার আগ্রহ ছিল ৱ্যাবের সদস্যদের মধ্যে। তবে মাস্টারকে দেখে তারা বুঝতে পারেনি, চিনতে পারেনি। আসলে মাস্টার একজন ছোটখাটো চেহারার মানুষ। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল আমার পাশে। পরিচয়ের পরে  ৱ্যাবের সদস্যরা অবাক— এই লোকটা মাস্টার! যার নামে  সুন্দরবনে এতো আতঙ্ক।

যাই হোক, মাস্টার-সহ দস্যুরা ৱ্যাবের হেফাজতে চলে গেল। আমার মাথা থেকে যেন পাহাড় নেমে গেল। ট্রলারগুলো লঞ্চের সাথে বাধা হল। দু’টি স্পিডবোট নিয়ে ৱ্যাবের সশস্ত্র সদস্যরা দুই দিক থেকে পাহারায় থাকলো। আমরা এগিয়ে চললাম  হাড়বাড়িয়ার দিকে। সেখানেই হবে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।

(ক্রমশ)

1 COMMENT

Comments are closed.