দীপংকর ঘোষ

নিস্তব্ধ পাহাড়ি জঙ্গল। মাঝে মাঝে গাছের ডাল থেকে হঠাৎ কোনও পাখির ডাক সেই নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। রংবেরং-এর কত প্রজাপতি, ফড়িং ওড়াউড়ি করছে যত্রতত্র। পায়ের চাপে পাথরের খটাখট, ঘড়ঘড় আওয়াজ। পথ কোথাও চওড়া কোথাও সরু। ক্যামেরার সাটার টিপতে টিপতে পথের ধারের গুল্মলতা ডাল থেকে শরীর বাঁচিয়ে, পথের পাথর থেকে পা বাঁচিয়ে ধীরে ধীরে উঠে চলি। এই পথ এঁকেবেঁকে ঝোপঝাড় জঙ্গলের আড়াল নিয়ে উঠে যাবার ফলে সামনের লোকদের মাঝে মাঝেই হারিয়ে ফেলছি। দৃষ্টিপথের আড়ালে চলে যাচ্ছে ওরা। আর ঠিক এই সময়গুলোতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে। এক অচেনা অজানা, জনমানব শূন্য পাহাড়ি জঙ্গলে একা চলার অনুভূতি।

আমার সঙ্গী তখন ওই প্রজাপতিগুলো, বছরের পর বছর এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই গাছগুলো। ওরা যেন আমার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। আমিও নিশ্চিন্ত মনে সুন্দর রঙিন ফড়িং-এর পিছু ধাওয়া করি, ক্যামেরায় ওকে ধরব বলে। হঠাৎ থেমে গিয়ে, দেখতে থাকি গাছের কচি পাতা দিয়ে শুঁয়োপোকার ভোজনপর্ব। আদিগন্ত সবুজের মাঝে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে টকটকে লাল রঙের পাতার মুকুট পরা এক গাছ। যেন ডেকে বলছে, ও সব কি দেখছো! আমায় দেখো। আমার দৃষ্টি চলে যায় তার দিকে। বৃষ্টিস্নাত চকচকে কচি লাল পাতা আমার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এ যেন এক অন্য পৃথিবী। নির্মল, নিষ্পাপ এক পৃথিবী। এখানে কারও সাথে কারও বিরোধ নেই। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একফোঁটা চাহিদা নেই। এখানকার বাসিন্দারা সবাই সবার পরিপূরক। জীবন তো এমনিই হওয়া উচিত। নীচের দিকে তাকালে ওই যে দূরে দেখা যায় ধোঁয়াশাবৃত অঞ্চল, ইঁটে-কাঠ-পাথরের জঙ্গল, ওই জঙ্গলের দৈনন্দিন লোভ, লালসা, হিংসা, কুৎসা, জটিলতার ঘূর্ণিপাক থেকে ছিটকে বেরনো আমি যেন একটু একটু করে মুক্তির স্বাদ পেতে শুরু করেছি। বুক ভরে অক্সিজেন টেনে নেই। উপর থেকে ডাক আসে, দীপ্ত, তাড়াতাড়ি আয়!

আবার একই ভাবে উঠে চলা। আরও বেশ খানিকটা এগিয়েই চোখে পড়ে বড় বোল্ডার বিছানো পথের ধারে কিছুটা জায়গার জঙ্গল সাফ করে গড়ে তোলা হয়েছে একটি দোকানের কাঠামো। কয়েকটা বাঁশ পুঁতে তার ওপর ছাদের ব্যাবস্থা করছে একজন লোক। প্রশ্ন করে জানতে পারি, এও সেই আগামিকালের প্রস্তুতি। জানি না, নির্জন এই পাহাড়ি জঙ্গলের মাঝে কোন পূণ্যার্থী আসবে পূজোর সামগ্রী কিনতে! সবার দৌড় তো দেখছি ওই ঝর্না পর্যন্ত। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে এঁকেবেঁকে, পাথর টপকে উঠে আসি আরও খানিকটা। আমার চার বন্ধু আর কুকুরটা বড় বড় পাথরের চাঙরের উপর বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আমিও থামি। রোদ নেই। মেঘলা আকাশ। অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছি। বাড়িঘর, বন-বাদার, মাঠ-ঘাট, পুকুর সমেত গোটা শুশুনিয়া উপত্যকাকে কেমন যেন ধোঁয়াটে লাগছে। যেখানে বসে আছি তার পাশ দিয়ে আরও ওপরে উঠে গেছে আমাদের পথ। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে রূপন আর কুকুরটা ওই পথে উঠে গেছে একটু আগে। আমিও উঠে পড়ি। এবারের রাস্তাটা দেখছি আরও সরু হয়ে গেছে। আর আরও খাড়া। বড় বড় উঁচু স্যাঁতসেঁতে পাথরগুলো অনেকটা সিঁড়ির মতো উঠে গেছে, এঁকেবেঁকে। একটা পাথর থেকে আর একটায় পা ফেলতে গেলে পা অনেকটা তুলতে হচ্ছে। খুব সাবধানেই চলছি। জানি, এ জায়গায় কোনও আলগা পাথরে যদি পা পড়ে— তাহলে আর দেখতে হবে না! খুব ভাগ্য ভালো থাকলে হাসপাতাল, আর মাথায়টাথায় যদি বাড়ি খেয়ে যাই— তা হলে তো হয়েই গেলো! এ ভাবেই একটা পাথরে প্রায় হড়কাতে হড়কাতে বেঁচে গিয়ে যে জায়গায় উঠে এলাম সেখানে বড় গাছপালা খুব একটা নেই। খুব বড় বড় পাথরের চাঁই আর সেই চাঁইগুলো বাদ দিয়ে বাকি জায়গাগুলোতে অনেক বড় বড় চওড়া পাতাওয়ালা সবুজ শন ঘাসের জঙ্গল। চারপাশে কেউ কোত্থাও নেই। একটা বড় পাথরের উপর রূপনের হাতের নীল প্লাস্টিকের ব্যাগ আর ছাতাটা পড়ে রয়েছে। কিন্তু না, প্লাস্টিকের ব্যাগ আর ছাতার মালিক আর সেই কুকুরটা, কারোরই পাত্তা নেই। কোথায় গেলো রে বাবা!

এতক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে চলতে চলতে হঠাৎ করে একটা খোলা জায়গায় এসে পড়েছি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, উপরে তাকিয়ে মনে হচ্ছে এই পাহাড়ের প্রায় মাথায় চলে এসেছি। গলা ছেড়ে রূপনের নাম ধরে ডাক দিলাম। কোনও সাড়াশব্দ নেই। মিনিট দুই- তিনেক অপেক্ষা। তারপরেই উপর থেকে সাড়া, “এই যে, এখানে। ওই পথ ধরে চলে আসুন।” ইতিমধ্যে বাকিরাও উঠে এসেছে। বড় বড় ঘাসে প্রায় ঢেকে দেওয়া কয়েকটা পাথরের চাঙর টপকে উঠে সবাই মিলে যেখানে উঠে এলাম, জায়গাটা প্রায় সমতল। এদিকে ওদিকে কিছু ঝোপঝাড়, ঘাসের জঙ্গল। বড় গাছপালা সবই নীচের ঢালের দিকে। রূপন দাঁড়িয়ে হাসছে আর কুকুরটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমরা একটা পাহাড়ের মাথায় এসে উঠেছি। এখান থেকে পথ এবার উৎরাইয়ে নেমেছে। খানিকটা ঢালের দিকে নেমে গিয়ে সেই পথ আবার উঠে গেছে সামনের ওই আরও উঁচু পাহাড়টায়।

মাটি থেকে কতটা উপরে আমরা উঠে এসেছি সে সম্বন্ধে সঠিক ধারণা না থাকলেও আমরা যে অনেকটাই উঠেছি সেটা বেশ ভালো বুঝতে পারছি। চারদিকে কেমন যেন একটা কুয়াশার ভাব। আকাশের ওই কালো কালো মেঘগুলো যেন হাতের নাগালের মধ্যেই বলে মনে হচ্ছে। আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বড় বড় কয়েকটা পাথরের চাঁইয়ের উপর সবাই বসে পড়ি। বেলা বেশ খানিকটা গড়িয়ে গেছে। সামনের পাহাড়টার মাথা ঢেকে দিয়ে কালো মেঘের দল কোথায় চলেছে কে জানে। যে কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে। চারপাশে এক অদ্ভুত থমথমে নিস্তব্ধতা। নিচ থেকে উঠে আসার পরিশ্রমে বেশ গরম লাগছে। আবার, গৎ বাঁধা জীবনের থেকে ছিটকে বেরিয়ে বহু দূরের এক পাহাড়ের মাথায় নিস্পাপ প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাবার উত্তেজনায় প্রায় ছেলেমানুষ হয়ে গেছি। টুটুদা গেঞ্জি গায়ে বসে আছে। খালি গায়ে পাথরের উপর শুয়ে পড়েছে শানু। হুইস্কির থেকেও এই প্রকৃতির মাদকতা অনেক বেশি। তাই বোধহয় ও আজ অনেক বেশি চার্জড। আমি ভাবতেই পারিনি ও এত দূর উঠে আসতে পারবে।

আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রূপনও উত্তেজিত। অবশ্যই এই প্রথম এই ধরনের একটা সফরে আসার আনন্দে। আর আমি এবং গোরা, দুই ফটোগ্রাফার, দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছি গোটা ভ্রমণ বৃত্তান্ত ক্যামেরায় ধরে রাখার। তবে আমাদের এত আনন্দের মধ্যেও মুস্কিলে পড়ে গেছে একজন। ওই কুকুরটা। কী মনে করে উঠে এলো আমাদের সাথে, আর কী হলো। মনে মনে হয়তো ভাবছে, কী সব পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে। নিজেরা কিছু খায়ও না, খাওয়ায়ও না। কী কুক্ষনে যে উঠে এলাম এদের সঙ্গে! এখন মানে মানে ঘরে ফিরতে পারলেই বাঁচি। সত্যি কথা বলতে কি, কুকুরটা যে আমাদের সঙ্গে এতদূর উঠে আসবে সেটাই তো বুঝিনি। বুঝলে সঙ্গে কিছু খাবার রাখা যেত। এই ফাঁকে চুপি চুপি একটা কথা বলি, গলা ভেজাবার জন্য ওকে সামান্য একটু হুইস্কি দেওয়া হয়েছিল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই গন্ধ শুঁকে ছেড়ে দিয়েছে। খায়নি। বরং কেমন যেন ভড়কে গেছে বলেই মনে হলো। মনে মনে আমাদের কী বলেছে কে জানে। ভাগ্যিস ওর ভাষা আমরা বুঝি না!

(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়