(বাংলা সাহিত্যের এক সেরা ব্যক্তিত্ব প্রমথ চৌধুরীর ভাই কুমুদনাথ চৌধুরী ছিলেন ভারতসেরা শিকারি। তবে শিকার সম্পর্কে তাঁর ভাবনা ছিল ব্যতিক্রমী। আজকের ভারতে সঙ্গত কারণেই এই ধরনের শিকার অভিযান নিষিদ্ধ। তবে থেকে গিয়েছে কুমুদনাথকে নিয়ে নানা গল্প। সেই কুমুদনাথ, ওড়িশার জঙ্গলে যাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল বাঘের মুখেই। লিখেছেন চণ্ডিকাপ্রসাদ ঘোষাল।)

পেশায় ব্যারিস্টার, নেশা শিকার। পেশার চেয়ে নেশাতেই তাঁর বেশি টান। কুমুদনাথ চৌধুরী। তাঁর এই নেশা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতেন কলকাতা হাইকোর্টের সহ-আইনজীবীরা। আর আড়াল-আবডালে তাঁর মক্কেলদের ভাঙিয়ে নিতেও কসুর করতেন না। মক্কেলদের বোঝানো হতো, ঝোপঝাড়-জঙ্গলই এরকম মানুষের সঠিক জায়গা, আদালতে তিনি বেমানান। অবশ্য এ নিয়ে বিশেষ ভাবিত হতেন না তিনি। কারণ ফুরসত পেলেই তিনি ছুটে যেতেন অরণ্যে।
প্রবোধকুমার সান্যাল, যিনি নিজে কদাচ শিকার না করলেও শিকারিদের সঙ্গে ছিল নিত্য ওঠাবসা, তিনি লিখেছেন:
একশত শিকারির ভিতরে একজনকে হয়তো পাওযা যায়, যে প্রতিভাবান – জানোয়ারের গতিবিধি, রীতিনীতি ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে যাঁর পরিচয় আছে, যাঁর আছে দুর্লভ সাহস, অজেয় প্রাণ, অসীম শক্তি ও বলিষ্ঠ স্নায়ুমণ্ডলী। সমগ্র ভারতবর্ষের শিকারিদের ইতিহাসে এইরূপ একজন মাত্র শিকারিকে দেখা গেছে, আমরা বাঙালিরা তাঁর জন্য গর্বিত, তিনি স্বর্গীয় কে.এন. চৌধুরি।
বাস্তবিক, বাঙালি জমিদারদের অপ্রশিক্ষিত, আদিম এলোমেলো শিকারচর্চার বিপরীতে মার্জিত, পরিশীলিত ‘স্পোর্ট’-য়ের আমদানি করেছিলেন কুমুদনাথ। জমিদারদের বেশিরভাগেরই শিকারের যথোপযুক্ত পাঠ ও প্রশিক্ষণে আগ্রহের বেজায় অভাব ছিল। সেটা তাঁরা আড়াল করে রাখতেন ক্ষমতা, বিত্ত আর মাঝেমধ্যেই সাহেব-সুবোদের নিজেদের এলাকায় শিকারে আমন্ত্রণ জানানোর দেখনদারি দিয়ে। সেই সময়কার সম্ভ্রান্ত দেশীয় শিকারিদের মধ্যে কুমুদনাথ ছিলেন ব্যতিক্রমী, অরণ্য-অন্তঃপ্রাণ আধুনিক-মনস্ক ব্যাক্তি। তার বিলক্ষণ প্রমাণ রয়েছে তাঁর বক্তব্যে:
‘‘যেমন খুশি গুলি চালিয়ে নিছক প্রাণীহত্যা করলেই স্পোর্টসম্যান হয়ে ওঠা যায় না। ভদ্রলোক হতে হয়। আমার বিশ্বাস, ভদ্রলোক তিনিই হতে পারেন, যিনি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের অধিকারী। জীবনের পথ সুগম নয়, নানান বাধা বিপত্তিতে ভরা, বিশেষ করে একজন ভারতীয়ের জীবন। আর, শিকার অভিযানে সাক্ষাৎ হয় ঈর্ষাপরায়ণ, অস্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা-প্রবণ এবং অখেলোয়াড়োচিত আচরণ ও মনোভাবসম্পন্ন লোকজনের সঙ্গে।’’
প্রযুক্তির অগ্রগতি শিকার ক্রীড়াকে যে অতীব সহজসাধ্য করে তুলেছে, এ নিয়ে কুমুদনাথের যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল। বন্দুক কাঁধে জঙ্গলে প্রবেশ করে যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়: ‘‘গুলিগোলার অপব্যয় করিয়া নৃশংসের মতো শিকারের ঝুলিটির অঙ্গস্ফীতি সাধনই মৃগয়াবিহারীর প্রকৃষ্ট পরিচয় নহে।’’ তাঁর সমকালীন শিকারিদের সম্পর্কে কুমুদনাথের ধারণা কেমন ছিল, এই বক্তব্যেই তা সুস্পষ্ট।

কুমুদনাথের আধুনিক ভাবনা ও ভাষ্যের সবিস্তার ছবি পাওয়া যায় ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘স্পোর্ট ইন ঝিল অ্যাণ্ড জাঙ্গল’ নামে বইটিতে। শিকার-কথার সঙ্গে কীভাবে সাহিত্যের মেল বন্ধন ঘটানো যায়, তার অনবদ্য নজির এই বইটি। মূলত, নিজের দুই সন্তানকে লেখা চিঠিপত্রের সংকলন এটি। কুমুদনাথ যে একজন ব্যতিক্রমী শিকারি হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রেক্ষাপটে রয়েছে তাঁর পারিবারিক সংস্কৃতি। পূর্ববঙ্গ, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামের সুখ্যাত চৌধুরী পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর ভাই প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে ‘বীরবল’ নামে খ্যাত। সংস্কৃত থেকে ইংরেজি সাহিত্য অবধি কুমুদনাথের অনায়াস ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ বিস্ময়কর। তার সরস ছাপ পড়েছে শিকার বিষয়ক লেখাগুলিতেও। শিকারি হিসেবে তাঁর মুন্সিয়ানা যেমন, শিকার-লিখিয়ে হিসেবেও তার চেয়ে কম নয়।
কুমুদনাথের বইটি কোনও অ্যাডভেঞ্চার-আখ্যান নয়। শিকারের নিয়মকানুন, বন্য জীবজন্তুর মনোভাব, আচার-আচরণ ইত্যাদি ছাড়াও শিকার অভিযাত্রীর দৃষ্টিতে অরণ্যের রোমান্টিকতা কী মায়াজাল বিস্তার করতে পারে, তারই বিবরণ। শিকার শিক্ষা এবং অরণ্যপাঠ – এ দুয়ের সমাহার এই বই। গড়পড়তা শিকারিদের মতো বন্দুকবাজ হিসেবে নিজের নৈপুণ্য ও বীরত্ব প্রকাশের কোনও অভিলাষ তাঁর ছিল না। প্রকৃত অর্থেই অরণ্যচারী হয়ে উঠেছিলেন বলেই তিনি ঘোষণা করতে পেরেছিলেন, ‘সত্যিকারের আনন্দ জীব হত্যায় নয়, প্রকৃতি ও তার সন্তানদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে সুন্দর সময় যাপন করে।’ এই ভাষ্য কোনও রক্তপিপাসু শিকারির নয়, বরং এক গভীর অরণ্যপ্রেমীর।
ওড়িশা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জের জেলাশাসক ও প্রাক্তন বিচারপতি অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন জাঁদরেল শিকারি। কুমুদনাথ সম্পর্কে তাঁর সম্ভ্রমবোধ ছিল প্রবোধকুমার সান্যালেরই মতো। তিনি লিখেছেন:
তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ শিকারি ছিলেন বলে আমি চিরকাল তাঁকে মনে মনে দূর থেকে বড়ই শ্রদ্ধা করতাম। শিকারি মানে হত্যাকারী নয়। যথার্থ শিকারি বলতে যা বোঝায়, তিনি তা-ই ছিলেন, অর্থাৎ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা এবং অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে তাঁর বীরের মন ও কবির অনুভূতি ছিল। যখনই তাঁর লেখা আমার হাতে পড়তো তখনই এ কথা বলতে পারতাম।’

নিজের বইটিতে কুমুদনাথ বারংবার শিকারিদের অতি সতর্কতার সঙ্গে অরণ্যে চলাফেরার উপদেশ দিয়েছেন। হিংস্র জন্তুদের স্বভাব ও আচরণ সম্পর্কে প্রতিমুহূর্তে হুঁশিয়ার থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে মুহূর্তের ভুলে সেই মানুষটিরই অপমৃত্যু ঘটেছিল অরণ্যের অন্ধকারে ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ১৯ চৈত্রে। ওড়িশার কালাহাণ্ডি জেলার এক জঙ্গলে তিনি গিয়েছিলেন হাঁকোয়া শিকারে। মাচানে বসে থাকা অবস্থায় কুমুদনাথ একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে নিশানা করে গুলি চালান। বাঘটি আহত হয়ে গর্জাতে গর্জাতে তাঁর নজরের আড়ালে হারিয়ে যায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তিনি মাচান থেকে নেমে আসেন বাঘটিকে খুঁজে বের করার জন্য। খুব সন্তর্পণে এগোতে থাকেন ঝোপঝাড় লক্ষ্য করে। আহত বাঘটি একটু দূরেই গাছের আড়ালে বসে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে শিকারির ওপর নজর রেখে যে প্রতিশোধস্পৃহায় বসে রয়েছে, সে খেয়াল তাঁর হয়নি। তার কাছাকাছি যাওয়া মাত্র প্রচণ্ড উন্মত্ততায় অতর্কিতে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুমুদনাথের ওপর। দ্বিতীয়বার গুলি চালানোর সুযোগ সে আর দিতে চায়নি। তীব্র আক্রোশে তাঁকে টেনে নিয়ে লাফিয়ে পড়েছিল গভীর জঙ্গলের অন্ধকারে।
অথচ কুমুদনাথই অজস্রবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তাড়াহুড়োয় কখনও কোনও আপাতদৃষ্টিতে মৃত মনে হওয়া বাঘ কিংবা চিতাবাঘের কাছাকাছি যাওয়া বা তাকে ছোঁয়া মারাত্মক হঠকারিতা। এই মূর্খামি করে বহু মানুষ নিজের জীবন দিয়ে খেসারত দিয়েছে। এক নির্মম আয়রনির মতো শোনায় যখন এই দুঁদে শিকারি লেখেন, ‘‘শিকারের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা শব্দটির প্রয়োগ একেবারেই ঠিক নয়, বরং এটিকে বলা যায় কোনও অজ্ঞতা, মূর্খামি বা হঠকারিতার অনিবার্য পরিণতি।’’ নিয়তি এই যে নিজের জীবনেই সেই হঠকারিতার পরিচয় দিয়ে তাঁকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের এক নামী শিকারি লিখেছেন, ‘‘শিকারকে আহত করে চলে আসা— শিকারিদের দুনিয়ায় এর চেযে লজ্জাকর কিছু নেই।এই লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আহত জানোয়ারের পিছনে বন জঙ্গলে ঢ়ুকে অনেক ভাল শিকারি চিরজন্মের মতো পঙ্গু হয়েছেন, অনেকে জান দিয়েছেন।’’ এই রকম এক ঘটনারই মর্মান্তিক নজির হয়ে রয়ে গেছেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিকারি কুমুদনাথ চৌধুরি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দিনলিপির ৩ এপ্রিল ১৯৩৪ তারিখের পৃষ্ঠায় আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘‘কাগজে পড়লুম বিখ্যাত শিকারি কে.এন.চৌধুরী কালাহাণ্ডি ফরেস্টে শিকার করতে গিয়ে বাঘের হাতে মারা গিয়েছেন কাল।’’
তথ্যসূত্র
১. K.N.Chaudhuri: Sport in Jheel and Jungle.
২. অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায়: শিকারের কথা
৩. চণ্ডিকাপ্রসাদ ঘোষাল: ঝিল-জঙ্গলের কুমুদনাথ