জেলায় জেলায় দুর্গোৎসবের রকমফের
দুর্গাপুজোই সম্ভবত একমাত্র উৎসব যেখানে দেবী পূজিত হন অজস্র অবয়ব ও উপচারে। স্থানকাল ভেদে তাঁর নানা রূপ, নানান বিধি-ব্যবস্থা, আচার অনুষ্ঠান। দেবী আসেন উৎসব মঞ্চ আলোকিত করে। তাঁর আসার প্রস্তুতি এখন দীর্ঘ পরিকল্পিত। কত যুগ আগে থেকে বর্তমানকাল অবধি দুর্গোৎসবের যে ধারাবাহিকতা তা বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য ও মানুষের সংস্কৃতিরই ধারাবাহিক ইতিহাস। কত সংস্কার কত বিচিত্র আচার অনুষ্ঠান একই পুজো ও উৎসবকে ঘিরে। এই বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন প্রকরণে দেবী পূজিতা। সর্বত্র তিনি দশভূজা নন, বিভিন্ন জেলায় রয়েছে তাঁর রূপভেদ। উপাসনা পদ্ধতিও বৈচিত্রে ভরা। অতীব চমকপ্রদ এই ঐতিহ্যের বিস্তার।
দেবীর আরাধনা ঘিরে জাতপাতের বালাই আজ আর নেই। বীরভূমের বাসোয়া গ্রামে অব্রাহ্মণেরাই, কিম্বা নদিয়ার হরিণঘাটায় বিবাহিতা মহিলারা পুজো করতে শুরু করলেও পুজোর দিনে পৈতেধারী ব্রাহ্মণ সন্তানেরই প্রয়োজন এখনও মণ্ডপে মণ্ডপে। এক ব্রাহ্মণ পুরোহিত তো ক’দিন আগে আক্ষেপ করছিলেন বাজারে পুজোর মন্ত্রের ক্যাসেট বেরিয়ে গেছে বলে। পূজারী ব্রাহ্মণের দিন গতপ্রায়। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মুসলমান বাড়িতেও দুর্গোৎসব হতে দেখা গেছে।
বর্ধমান জেলার সমুদ্রগড়ের কাছে বিবিরহাট গ্রামে বদরুল আলম খান, যিনি মুকুল ঠাকুর বা রাজাসাহেব নামে পরিচিত, তাঁদের বাড়িতে এক সময় দুর্গাপুজো হত। এখন বাড়ির পুজো বন্ধ। বদরুল আলম খানের মতে, তাঁদের বাড়ির পুজোই ধীরে ধীরে বারোয়ারী পুজোর রূপ পায়। বদরুল আলমের বয়স ষাটের কাছাকাছি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল তাঁদের বাড়ির আঙ্গিনায় বসে। বদরুল বলছিলেন ওঁদের পূর্বপুরুষ হিন্দু। ওঁরা ছিলেন বল্লাল সেনের উত্তরপুরুষ গৌতম সেনের বংশধর। সময় মতো রাজস্ব না দেওয়া এবং পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সহযোগিতা করায় গৌতম সেন নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ’র হাতে বন্দি হন এবং নবাব তাঁকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। যুদ্ধে নবাবদের হার হলে গৌতম সেন মুক্তি পান। তিনি তাঁর রাজ্য সমুদ্রগড়ে ফিরে এসে হিন্দুত্ব মেনেই চলতে চেয়েছিলেন কিন্তু সমাজ গ্রহণ করল না। বদরুল বলছিলেন তাঁদের পূর্বপুরুষরা ‘ঠাকুর’ পদবী ব্যবহার করতেন। টুঙ্কু ঠাকুর, যদু ঠাকুর, মধু ঠাকুর তাঁদের বংশেরই পূর্বপুরুষ। মধু ঠাকুরের ছেলে ইসামত খান নামে পরিচিত হন। বদরুলদের বাড়িতে এখন আর দুর্গাপুজো না হলেও বৈশাখী পূর্ণিমাতে গঙ্গার ধারে সিদ্ধেশ্বর ঠাকুরের পুজোয় বাড়ি থেকে পুজোর ডালা পাঠানো হয়।
মহারাজ রুদ্র রায়ের (১৬৮২ খ্রিঃ) কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে যে রাজরাজেশ্বরী প্রতিমা গড়ে পুজোর সূচনা হয় সম্ভবত নদীয়ার প্রাচীনতম পুজো সেটিই। ১০৮মণ গঙ্গা মাটি দিয়ে তৈরি হত মায়ের মূর্তি। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে রাজরাজেশ্বরীর পুজো হত খুব ধুমধাম করে। ১০৮টি পদ্মফুল দরকার হত সন্ধিপুজোয়। বলি হত ১০৮টি পাঁঠা, ১০৮টি ঢাকের বাজনায় দেবীর আরতি হত। সোনা, হীরে মুক্তোয় দেবীর গা ঢেকে দিতেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। সন্ধিপুজোর ঘণ্টা বাজতো কামানের তোপধ্বনিতে, নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে এসে বসত রাজরাজেশ্বরীর চূড়ায়। পুজোর ক’দিন কৃষ্ণনগরবাসী রাজবাড়িতে নিমন্ত্রিত। প্রসাদ পেতো। পুজোর একদিন কৃষ্ণনগর পতিতালয়ের পতিতারা নিমন্ত্রিত হতেন রাজার নির্দেশে। অতিথি-মর্যাদায় প্রাসাদে তাঁদের আহারের ব্যবস্থা হত। সকলকে নতুন কাপড় উপহার দেওয়া হত। বিসর্জনের সময়ও দেবীমূর্তিকে ১০৮ জনে ধরাধরি করে নিত। রাজরাজেশ্বরীর পুজো প্রতিবছর হয়। কিন্তু সেই জৌলুস আর নেই। এখন সবাই অনাহুত। নীলকণ্ঠ পাখিও তাই বোধ হয় আর আসে না। কৃষ্ণনগরের আরও একটি উল্লেখযোগ্য পুজো হল নাজিরাপাড়ার নীল দুর্গার পুজো। দুর্গার গায়ের রং এখানে নীল। ১৯৫১ থেকে এই পুজো হয়ে আসছে এখানে। রাজা-জমিদারদের সঙ্গে তখন পাল্লা দিয়ে পুজোর অনুষ্ঠান হত। পাঁচশ ভরি সোনা দিয়ে দুর্গার শরীর মুড়িয়ে দিয়েছিলেন হুগলি জেলার বৈঁচি গ্রামের গঙ্গাধর কুমার। জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ একবার প্রতিমা সাজাতে প্যারিস থেকে হীরে, মুক্তোর গয়না আনালেন, বিসর্জনের সময় তা অবশ্য খুলে রাখলেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ টেক্কা দিলেন শিবকৃষ্ণকে। তিনি যে সমস্ত সোনা, হীরে মুক্তো পরালেন তা বিসর্জনের সময়ও খুলে রাখলেন না। বিসর্জন দিতে যারা প্রতিমাকে নিয়ে যেতো তারাই সে সব নিয়ে নিত।
পাঁচশ বছরেরও বেশি প্রাচীন কোচবিহার রাজের দুর্গাপুজো। দুর্গাকে এখানে বলা হয় দেবী। তাই দুর্গাপুজো নয়, দেবীপুজো। দেবীবাড়ির দুর্গোৎসব এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন। দেবী এখানে একাকী। পুত্র-কন্যা বিহীন। দু’পাশে শুধু জয়া ও বিজয়া। মাথায় সাড়ে সাত হাত। রাজবংশী শিল্পীদের হাতে গড়া দেবী। পুজো করেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত। এই পুজোর বৈশিষ্ট্য অষ্টমীর রাতে গুপ্ত পুজো। আগে নরবলি হত। সেই ধারা অনুসরণ করেই এখনও একজন রাজবংশী সমাজের লোক রক্ত দেন। অষ্টমীর রাতে দেবীর পাশের ঘরে আরও একটি পুজো হয়। দেবীর ভোগের যারা জোগান দেন তারাই এই পুজোর উদ্যোক্তা। পুরোহিত রাজবংশীয় কোনও যুবক। ভোগকে এরা বলে হালুয়া। এই বিশেষ পুজোর একটি নাম আছে। রাজবংশীদের ভাষায় এর নাম ‘চালিয়া বাড়িয়া পুজো’। দশমীর দিন বিসর্জনের আগে নদীর ঘাটে ঘটপুজো হয়। এটি ফুল মালিদের পুজো। মন্ত্রও আলাদা। শাপলা ফলের দানা দিয়ে ভোগের ভাত তৈরি হয়। শুয়োর আর টুনটুনি পাখির মাংস লাগে পুজোয়।
উত্তরবঙ্গের আর একটি প্রাচীন পুজো জলপাইগুড়ির রাজা রায়কতদের। নরবলির পরিবর্তে ময়দার তৈরি নরমূর্তির বলি দেওয়া হয় এখন। তিন পুরুষ আগে রাজা ফনীন্দ্রদেবের মৃত্যুর পরই নরবলি প্রথা উঠে গেছে। এই রাজপরিবারের পুজোর বৈশিষ্ট্য হল দেবতাদের আলাদা আলাদা অবস্থান। দুর্গা, কার্তিক ও গণেশ একচালে। লক্ষ্মী, সরস্বতী আলাদা। সিংহ, অসুর, মোষ, ইঁদুর, বাঘ ছাড়াও দুর্গার দুই সখী জয়া ও বিজয়া রয়েছেন। আগে সন্ধিপুজোর সময় নরবলি হত। নরবলির জন্যে প্রতিবছর কোনও সদবংশের সুদর্শন বালককে নির্বাচন করা হত। পুজোর সময় রাজা ও পুরোহিত ছাড়া আর কেউ মন্দিরের ভিতরে থাকতে পারতেন না। রক্তবসন জোড় পরে অসি হাতে রাজা মন্দিরে ঢুকলেই দুয়ার বন্ধ করে দেওয়া হত। নরবলি হয়ে গেলে কাঠের উনুনে রান্না হত কলজে ভোগ। দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গ হওয়ার পর ‘কারণ’ সহ ওই মহাপ্রসাদ খেতেন রাজা ও পুরোহিত মিলে। নবমী পুজোর দিন বলি হত ১০৮টা পাঁঠা, দু’টো মোষ। দশমীর দিন রথে চাপিয়ে দেবীকে আনা হত করলা নদীর ধারে। শেষ পাঁঠাবলিটি সেখানে। প্রতিমার গায়ে আগে ছিল রক্ত রং। রাজকুমারী প্রতিভাদেবীর সময় থেকে তা পাল্টে যায়। এখন নীলাভ হলুদ রং প্রতিমার গায়ে।
মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জের কাছে এক গ্রাম গদাইপুর। এই গ্রামের পুজো বহু প্রাচীন। এই দুর্গার নাম পেটকাটি। এখানে দুর্গার পেট কাটা। তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। একচালা প্রতিমা। দুর্গার ডান দিকে রাম, বাঁ দিকে লক্ষ্মণের মূর্তি। আছে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী। জনশ্রুতি, একবার সন্ধিপুজোর সময় দেবী ঝুঁকতে ঝুঁকতে পড়ে যান। সেই থেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার প্রচলন এবং একবার পুজো মণ্ডপ থেকে একটি বাচ্চা মেয়ে হারিয়ে যায়। মা-বাবা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মেয়েটির হদিশ পায় নি। কিংবদন্তী আছে, রাতে মেয়ের বাবা স্বপ্ন দেখেন। দেবী দুর্গা জানান, মেয়েটি তাঁর পেটে। পেট কেটে যেন মেয়েকে বের করে নেওয়া হয়।
পরদিন সকালে তা-ই করা হল। মেয়েটি অবশ্য দু’চার দিন বাদেই মারা গেল। দুর্গার নাম হয়ে গেল পেটকাটি দুর্গা। মুর্শিদাবাদ জেলার আর একটি বিচিত্র পুজো হয় রানীনগরের কাছে ইসলামপুর গ্রামে। বাইশ মূর্তির দুর্গা পূজিত হন এখানে। দশভূজা দুর্গার সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ ছাড়াও রয়েছেন মহাদেব, নারায়ণ, ব্রহ্মা, নন্দী – ভৃঙ্গী, জয়া, বিজয়া। এছাড়াও কিছু পৌরাণিক মূর্তি।
বাঁকুড়া জেলার মল্লভূমের পুজো সম্পর্কে শোনা যায় কামান দেগে মূর্তি মন্দিরে আনা হত। বিষ্ণুপুর থেকে খানিক দূরে তীরবক গ্রামের একটি সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে এই কামান দাগার কাজ করে। এরা রাজার দেওয়া মহাদণ্ড উপাধীধারী। মূর্তি নির্মাতারা মালাকার আর পুরোহিতগণ মহাপাত্র। কামান দাগার কাজ যে করে তাকে পুজোর দিন নির্জলা উপোস থাকতে হয়। এদেরই হাতে তৈরি পাতায় মায়ের ভোগ দেওয়া হয়। অন্য পাতায় চলবে না। রাজার ধারণা, মৃন্ময়ী তাঁদের মেয়ে, তাই নিজ হাতে অঞ্জলি দিতেন না। পুরোহিত মহানবমীর পুজো করেন পেছন ফিরে। দশমীর দিন মুখোশ পরে চলে রাবণ কাটা উৎসব। রাবণ বধ হয়। যে লোকটি রাবণ বধ করে, তার স্পর্শ পাওয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। ধারণা, যে পাবে তার হাতের ছোঁয়া, সে রোগমুক্ত হবে। বিষ্ণুপুরের রাজবাড়ির পুজো চলে উনিশ দিন। কুশের ঘাস আর গঙ্গামাটি দিয়ে নির্মিত হয় প্রতিমা ও পটে আঁকা দেবীমূর্তি। বড় ঠাকরুণ, ছোট ঠাকরুণ, পিতৃপক্ষের নবমী থেকে দেবীপক্ষের দ্বাদশ তিথি পর্যন্ত চলে এই পুজো।
সুরুল গ্রামে সরকার বাড়ির পুজোই বর্তমান বীরভূমের প্রাচীনতম পুজো। জমিদার সরকার বংশের জনৈক শ্রীনিবাস সরকার ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে যে পুজোর সূচনা করেন তা আজও চলে আসছে। প্রতিদিন ২৯টি নৈবেদ্য সাজিয়ে পুজো দেওয়া হয় এবং কুমারী মেয়েদের ময়দার লুচি খাওয়ানোর রেওয়াজ আছে। হেতমপুরের মুন্সীদের বাড়িতে মাটির মূর্তি তৈরি করে পুজো হয় না। এখানে পট পুজোর প্রচলন। তাই নাম হয়েছে পাতিঠাকুর। পুজোর পরও পাতিঠাকুর মন্দিরে থাকেন একবছর।
মেদিনীপুর জেলার মহিষাদল রাজবাড়ির পুজো জেলার প্রাচীনতম বলে অনুমান। এই বংশের রাণী জানকীবাঈ ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে বিধবা হওয়ার পর ১০৮টি দেবদেউল প্রতিষ্ঠা করে পুজো করেন। আগে সপ্তমীতে সাতশো, অষ্টমীতে আটশো এবং নবমীতে নশো জন লোক খাওয়ানোর বরাদ্দ ছিল। কাঁথি শহর থেকে মাইলখানেক দূরে কিষণনগর গড়। রাজা যাদব রায়ের সময় থেকে দুর্গা পুজোর শুরু। একশো মোষ বলি হত। এখন রাজা নেই, বলিও নেই, পুজোটা আছে।
নামকরণেও বৈচিত্র দেবী দুর্গার। কোথাও তিনি শ্বেতদুর্গা, কোথাও কৃষ্ণদুর্গা, কোথাও বা নীলদুর্গা, রক্তদুর্গা আবার কোথাও বুড়িমা, বগলামুখী নামে পরিচিত। গড়নেও রয়েছে বৈচিত্র। সর্বত্র তিনি দশভূজা নন। কোথাও দ্বিভুজা, কোথাও ত্রিভুজা কোথাও চতুভুর্জা, কোথাও অষ্টভুজা আবার কোথাও অষ্টাদশভুজা। উত্তরবঙ্গের মেখলিগঞ্জের ভাণ্ডারণী দুর্গাপুজোর প্রতিমা দ্বিভুজা। এখানে দুর্গার বাহন বাঘ, সিংহ নয়। বনগাঁয় ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো যথেষ্ট প্রাচীন। এখানে দুর্গা দশভুজা হলেও এর দুটি হাত বড়। বাকী আটটি হাতই অত্যন্ত ছোট আকারের। ছোট হাতগুলিতে কোনও অস্ত্র নেই। এখানকার দুর্গা প্রতিমার পরিচয় ‘বিড়াল হাতি দুর্গা’ নামে। জলপাইগুড়ির বনদুর্গা পুজোর প্রতিমা চতুর্ভুজা। জনাইয়ের চৌধুরী পরিবারের দুর্গার নাম বগলামুখী। দেবী এখানে চতুর্ভুজা পীতবর্ণা। শ্বেত সিংহ এখানে দুর্গার বাহন। মেদিনীপুরের চিল্কিগড় রাজার দুর্গার নাম কনক দুর্গা। দুর্গা এখানে অশ্বারূঢ়া চতুর্ভুজা। আগে নরবলি হত, এখন ছাগবলি হয়।
বর্ধমানের কুলীন গ্রামের মালাধর বসুর বাড়ির পুজোয় শাক্ত ও বৈষ্ণবের সমন্বয়। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার শিবালয় গ্রামের দুর্গার নাম বুড়িমা দুর্গা। শোনা যায় পলাশীর যুদ্ধের ৩৪ বছর আগে ১৭২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই পুজোর শুরু। শ্যামনগরের ঘটকবাড়ির পুজো ৩০৭ বছরের প্রাচীন। পলতার দাশগুপ্তদের বাড়ির পুজো এবারে ৪৭৬ বছরে পড়ল। হুগলির একটি বারোয়ারি পুজো বেশ প্রাচীন। এখানে মহাদেব সিংহের পিঠে শুয়ে আছেন। দুর্গার ১২টি হাত ও ৬টি মাথা। দেবী এখানে পুত্র কন্যাহীন। হুগলি জেলার বলাগড়ের মিত্র বাড়ির পুজোর বয়স ২৯৭ বছর। এখানে দুর্গার বাহন বাঘ-সিংহ নয়, ড্রাগন। শান্তিপুরের চাঁদুনী বাড়ির পুজো ৫০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। এই পুজোর প্রবর্তক ছিলেন চৈতন্যদেবের গৃহশিক্ষক কাশীনাথ সার্বভৌম। এই পুজোয় দেবীকে পান্তা ভাতের ভোগ আর ইলিশ ঝোল উৎসর্গ করা হয় নবমী তিথিতে। পাকুড় গাছের নীচে রঙ্কিনী দুর্গার পুজো হয় বাঁকুড়ার পাত্রসায়রে। এই জেলারই দ্বারকেশ্বরের কাছে তপোবন গ্রামে বিজয়ার দিন রথ বেরোয়। রাবণ-কাটা রথ। উদ্দেশ্য, রাবণ বধ। কাঁসাই নদীর তীরে পুরুলিয়ার দেউলঘাটে পুজো হয় কৃষ্ণবর্ণ সিংহবাহিনী দশভুজা দুর্গার। মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দির নবগ্রামের পুজোয় দেবী দুর্গা পদ্মাসীনা। বীরভূমের বক্রেশ্বরে পূজিতা হচ্ছেন অষ্টাদশভূজা দেবী দুর্গা।
সর্বজনীন পুজোর প্রথা আসে খুব সম্ভবত উনিশ শতকের প্রথম দিকে। চাঁদা তুলে শান্তিপুর, গুপ্তিপাড়া, চুঁচুড়া, চন্দননগরে পুজো হত। পুজোকে ঘিরে প্রতিযোগিতাও চলতো। শান্তিপুরে একবার এত উঁচু প্রতিমা হল যে বিসর্জনের সময় কেটে কেটে ঠাকুর বিসর্জন করতে হল। পরের বছরই গুপ্তিপাড়ায় দেখা গেল থান পরানো গলায় কাছা দেওয়া গণেশ। কেন? না, শান্তিপুরে মায়ের অপঘাতে মৃত্যুর জন্যে পুত্র গণেশের অশৌচ। হাওড়া শিবপুরে জনৈক ব্যক্তি এক টাকা দামের লটারির টিকিট বিক্রি করে পুজো শুরু করেন। লটারিতে যার নাম উঠবে তার নামেই সংকল্প হবে। বারো জন বন্ধুর জল্পনা কল্পনা থেকে উত্তর কলকাতার তেলিপাড়ায় যে পুজোর সূচনা, বলা যায় কলকাতায় সর্বজনীন পুজোর শুরুও তখন থেকেই। কলকাতায় বহু বনেদি ঘরে দুর্গোৎসব আগেও হত, এখনও হয়। কলকাতার পুজোর বিশিষ্টতা অন্যখানে। মননে ও নতুনত্বের প্রতিফলনে।