(প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র। নদী প্লাবন থেকে শুরু করে জীবনের নানান সমস্যায় জর্জরিত সুন্দরবনের মানুষকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। এখানে খুঁজে পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের কথাও উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।)

ভূ-তাত্ত্বিকেরা মনে করেন, গঙ্গা,পদ্মা ও হুগলি নদীর মধ্যবর্তী এই বঙ্গভূমি পাঁচ হাজার বছরের আগে ছিল বঙ্গোপসাগরের মধ্যে। সুন্দরবনের জনবসতির প্রাচীনত্ব নিয়েও গবেষকদের বিতর্ক আজও থামেনি। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, একসময় বর্তমান ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলার রাজমহল পাহাড়ের কাছে ছিল বঙ্গোপসাগর। ক্রমশঃ ভূ-গঠনের নিয়মে বাংলার ব-দ্বীপ ক্রমশ দক্ষিণে প্রসারিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে নিম্নবঙ্গের আলোচ্য অঞ্চলটিকে ‘বুড়োনিয়ার দেশ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বুড়োনিয়ার দেশই বর্তমানে দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরপ্রতিমা থানার জি-প্লট গ্রাম পঞ্চায়েত অধীন ‘বুড়োবুড়ির তট’। জি-প্লটের অন্যান্য গ্রাম সীতারামপুর, পার্বতীপুর, ইন্দ্রপুর, গোবর্ধনপুর, সুরেন্দ্রনগর। এই এলাকা যে প্রাচীন জনপদ ছিল তা এখানে মাটির গভীরে খনন করতে গেলেই বোঝা যায়। কারণ, খননের সময়ে দালান, মন্দির, প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ও পুরাসামগ্রী পাওয়া যায়।

যহ্মিণী মূর্তি, চন্দ্রকেতুগড়

গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের দক্ষিণের এই বিস্তীর্ণ এলাকায় জমি জরিপ করে (১৮২৬-১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে) ড্যাম্পিয়ার ও হজ নামে দুই মানচিত্র বিজ্ঞানী সুন্দরবনের সীমা নির্দিষ্ট করেন। সাগরদ্বীপ থেকে মেঘনা পর্যন্ত এই সীমা রেখা ‘ড্যাম্পিয়ার ও হজেস লাইন’ নামে পরিচিত। তবে ভারতের সুন্দরবন রয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার ৯৬৩০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল। এই এলাকার মধ্যে রয়েছে দুই জেলার মোট ২১টি ব্লক। অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা রয়েছে বাংলাদেশে। ২১টি ফরেস্ট ব্লক নিয়েই পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন। এর মধ্যে ১৫টি বসিরহাট, গোসাবা ও ক্যানিং রেঞ্জের আওতায়। এগুলি ব্যাঘ্র প্রকল্পের এলাকাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। প্রথমটি হল কোর এলাকা। যার আয়তন ১৩৩০ বর্গ কিলোমিটার। এখানে মানুষের প্রবেশ নিষেধ। কোর এলাকার মধ্যে রয়েছে চামটা, গোনা, মায়াদ্বীপ, ছোট হরদি, গোসাবা, মাতলা, বাঘমারা প্রভৃতি। দ্বিতীয় এলাকাকে বলে বাফার এলাকা। এই ৮৮৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জেলে, মউলে ও কাঠুরেদের ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়। পাখিরালয় নামে পাখি সংরক্ষ‌ণের জন্য ৩০০ একর বনাঞ্চল নির্দিষ্ট করা আছে। পাথরপ্রতিমা থানার ভগবতপুর কুমীর প্রকল্প ব্যাঘ্র প্রকল্পের বাইরে রয়েছে।

বালান্দা প্রত্ন সংগ্রহশালা, হাড়োয়া

ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিকদের মতে খ্রীষ্টপূর্ব তিনশো থেকে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও জলদস্যুদের আক্রমণ বা ভূমি অবনমনের কারণে সুন্দরবন জনশূন্য হয়ে যায়। তবে সুন্দরবনে প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদের অস্তিত্বের সন্ধান মূলত দেখা গিয়েছে আদিগঙ্গা সংলগ্ন গ্রামগুলিতে। আদিগঙ্গা তীরবর্তী বিভিন্ন গ্রামে জৈন-বৌদ্ধযুগের মৃৎপাত্র ও দেব-দেবীর মূর্তির সন্ধানও পাওয়া গিয়েছে। বেশ কিছু হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির সন্ধানও মিলেছে। জৈন তীর্থংকর আদিনাথ ও পার্শ্বনাথের মুর্তি পাওয়া গিয়েছে কাকদ্বীপের কাছে ঘাটেশ্বরা ও কাটাবেনিয়া  এই গ্রামে বাসুদেব ও গণেশ মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে। জয়নগর থানার কাশীপুর গ্রামে ষষ্ট শতকের সূর্যমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। সাগরদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির নীচে ভগ্নগৃহ মন্দির, মুদ্রা, বিষ্ণুমুর্তি, জৈনমূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ১১৬ নম্বর লটে রায়দিঘির জটা গ্রামে পাল যুগের জটার দেউলটির স্থাপত্য বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। রত্নাংশু বর্গী তাঁর ‘সুন্দরবন’ পুস্তিকায় (১৯৮৪) উল্লেখ করেছেন, ‘রাক্ষ‌সখালি দ্বীপ ও বকুলতলা গ্রামে প্রাপ্ত দ্বাদশ শতকের দুটি সুন্দরবন লিপি থেকে জানা যায়, শ্রীমদ্ ডোম্মন পাল নামে এক সামন্ত পূর্বখাড়িতে রাজত্ব করতেন দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে।’ ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থের লেখক বিনয় ঘোষের মতে, ‘ডোম্মন পাল দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক বিদ্রোহী সামন্ত।’

হাড়োয়ার খাসবালান্দায় অবস্থিত লাল মসজিদে পাথরের স্তম্ভ ও ভিতরে লৌহ শলাকা।

সুন্দরবনের বর্তমান জনবসতির বয়স প্রায় তিনশো বছরের কাছাকাছি। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সুন্দরবনে নতুন করে বসতি স্থাপন শুরু হয়। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে সুন্দরবনের জঙ্গল এলাকা সাধারণের মধ্যে বিলির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার পরের পাঁচ বছরের মধ্যে ১০০টি লাটের ৫ লক্ষ‌ ৫১ হাজার ৫২০ একর জমি বিলি করা হয়েছিল। ১৮৫৩ সালে সুন্দরবনের অনাবাদী ও জঙ্গল এলাকা বিলির জন্য নতুন আইন পাশ হয়। এরপর ১৭৮টি লাট ইউরোপীয় আর্মেনিয়ান, খ্রিষ্টান, মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল। ১৮৬৩ সালে ওয়েস্ট ল্যান্ড রুল জারি হওয়ার মধ্যে আরও ১৩টি লাট বিতরণ করা হয়। সমুদ্রের নোনা জলের হাত থেকে সে জমিকে বাঁচাতে তাঁরা গতর খেঁটে ৩৫০০ কিলোমিটার (১২ শতাংশ ভাঙনে তলিয়ে যাওয়ায় ৩১১৬ কিলোমিটার-সূত্র স্টাডিজ অন এমব্যাংকমেন্ট এন্ড ভালনারবিলিটি অফ সুন্দরবনস, ওয়েস্ট বেঙ্গল, ড. সুগত হাজরা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওসনোগ্রাফির অধ্যাপক ও অধিকর্তা,২০০৫) মাটির বাঁধ দিয়ে তা রক্ষা করেছে। এরপরেও ক্রমাগত ভাঙনে বর্তমানে এই বাঁধের দৈর্ঘ্য আনুমানিক ২৫০০ কিলোমিটার। বহু বাঁধের অবলুপ্তি হয়েছে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও ভাঙনের ফলে। নদীতে ও উপকূলবর্তী এলাকায় বাঁধ দেওয়ার ফলেই সুন্দরবনের সমস্যা শুরু বলা যায়। স্বাধীনতার আগে বা পরে মাটির বাঁধ, কংক্রিট কিংবা বোল্ডারের বাঁধ— কোনওটাই টেকেনি। টেকার কথাও নয়। বাঁধ ভেঙে মানুষের প্রাণহানি থেকে সহায়সম্বল হারানোর রোজনামচা প্রকৃতি লিখে চলেছে তার নিয়মেই। বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, বিশ্ব উষ্ণায়নে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বৃদ্ধি, জোয়ার-ভাঁটা, কোটালে অত্যাধিক পলি পরিবহণ, ভূমির অবনমন, কখনও ভূ-আলোড়নে জমির ঢালের পরিবর্তন। ফলে বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনের নদীর গতিপথও পরিবর্তিত হয়েছে । বহু শতাব্দী ধরে জনবিরল একটি এলাকা গত তিন শতাব্দীতে বিশ্বের সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ ক্রান্তীয় ব-দ্বীপ অঞ্চল বলে আজ স্বীকৃত।

খনা মিহিরের ঢিপি, বেড়াচাপা, দেগঙ্গা

সামুদ্রিক প্রভাবে ও নদীর ব-দ্বীপ গঠনের নিয়মে এই অঞ্চলের বিরাট ভূ-খণ্ড যেমন তৈরি হয়েছে তেমনি বিশাল পরিমাণ উপরিভাগের পলিতে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ঘটে চলেছে পরিবর্তনের ধারা। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে উপকূল থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত সমতল ভূমিতে ৩-৫ মিটার পর্যন্ত উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে ব্যাপক ভূমিক্ষ‌য় করে নদীর প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। গত ৬০ বছরে ২১টি তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়েছে সুন্দরবন। নদী তার প্লাবনভূমি বাঁধ ভেঙ্গে ছিনিয়ে নিচ্ছে। এখানে শক্তপোক্ত বাঁধ বা কংক্রিটের বাঁধ কিংবা নেদারল্যান্ডের প্রযুক্তির বাঁধ কোনওটাই চিরস্থায়ী হবে না। কারণ, বাঁধের ভাঙন উপর থেকে যা হয়, তার তুলনায় নীচে থেকে নদীর সর্পিল গতির জন্য মাটি সরে গিয়ে ধ্বসে গিয়ে বা ভেঙে বেশি ক্ষ‌তি করে থাকে। বিচিত্র ও খামখেয়ালি বঙ্গোপসাগরের তাণ্ডব তো রয়েছেই।

পরিশেষে বলব, মানুষ যখন থেকে কৃষিকাজকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে তখন থেকেই সে তাঁর বসতি ও ফসলকে বন্যা, প্লাবন, জোয়ার-ভাঁটা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে রক্ষা  করতে বাঁধ দেওয়ার কাজ শুরু করে। আর্যদের ভারতে আসার বহু আগে বাংলা ব-দ্বীপের এই অংশে অনার্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। অনার্যরাও বাঁধ প্রযুক্তি বিষয়ে অবহিত ছিল। তার নির্দশনও সুন্দরবনে মিলেছে। ফলে সুন্দরবনে সমৃদ্ধ অনার্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল বহু আগেই। বর্তমান জনবসতির ইতিহাস মাত্র তিন শতাব্দীর। তবে প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সুন্দরবন স্বতন্ত্র, সুন্দর অথচ চরম অনিশ্চয়তার এক প্লাবনভূমি।

4 COMMENTS

  1. […] অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী মিলেছে … Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous articleবৈদিক যুগের পরেই মেয়েদের শিক্ষার জগৎ সংকুচিত হলNext articleস্বজনরাই ধরিয়ে দেয় দস্যুনেতা জুলফিকারকে… চণ্ডিকাপ্রসাদ ঘোষালhttps://balihas.com/ […]

  2. সুন্দরবন এখন বাংলাদেশের কাছে মুক্ত বাতাস।

Comments are closed.