সেদিন অবধি ছিল অজ-পাড়াগাঁ। এখন সেখানে বিপুল জনস্রোত। গায়ে গায়ে সেঁটে রয়েছে ঘরদোর, বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি, দোকান-বাজার। আর, যান-জনতার ঢেউ অবিরাম আছড়ে পড়ছে নজরুল ইসলাম অ্যাভেনিউ অর্থাৎ ভিআইপি রোডের ওপর। সেই স্রোত আর জনবিস্ফোরণ প্রতিনিয়ত মুছে দিতে চায় তার আশ্চর্য ইতিহাস। উল্টোডাঙ্গা থেকে দমদম বিমানবন্দরের পথে লেকটাউন, বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ, দমদম পার্ক ছাড়ালেই কেষ্টপুর বা কৃষ্ণপুর। সেখান থেকে রাজপথ ছেড়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে অপ্রশস্ত পথের উপচে পড়া ভিড় ঠেলে এগোতে হবে কিলোমিটার তিনেক দূরত্বে এক জনপদে, লোকমুখে তার নাম কেষ্টপুর বাজার। পোষাকি নাম ক্রিশ্চিয়ান মিশন বাজার। আর এই নামের আড়ালেই আত্মগোপন করে রয়েছে কেষ্টপুরের ঘটনাবহুল ইতিহাস। বুঝতে অসুবিধে হয় না গ্রাম্য জনপদের খোলস ছাড়িয়ে শহরের ভেক ধরেছে সে অদূর অতীতে। আজকের কেষ্টপুরের অতীত জেগে রয়েছে সেখানে। সেই অতীত, যখন এ অঞ্চল পরিচিত ছিল খ্রিষ্টপুর নামে। আর সেই ইতিহাস আঁকড়ে আজও মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক গির্জা যার ফটকে লেখা Immanuel Church, under the Church of North India, established in 1829 ।

খ্রিষ্টপুর কীভাবে কেষ্টপুরে উপনীত হল তার আনুপূর্বিক ইতিবৃত্ত বেশ ঘটনাবহুল। তবে মহিষবাথান এলাকার এই ছোট্ট অঞ্চলটি খ্রিষ্টপুর নাম ধারণ করেছিল কোন সুবাদে তা জানতে হলে ইতিহাসের আরও উজান বাইতে হবে।

সে ঘটনার সূত্রপাত ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে। প্রায় ৪০-৪৫টি বাণিজ্যপোত সারবেঁধে চলেছিল বঙ্গোপসাগর বেয়ে। আচমকা আছড়ে পড়ে সামুদ্রিক ঝড়। মাত্র ছ’টি জাহাজের পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজ নাবিকেরা বিপর্যয় থেকে কোনক্রমে রক্ষা পায়। তারা উঠে আসে মহিষবাথান এলাকার একটি ছোট্ট দ্বীপে। সে দ্বীপ ঘিরে বইতো বিদ্যাধরী নদী। সে নদী এখন পিছিয়ে গেছে অনেক দূর। অজস্র নারকেল গাছ, ঘন জঙ্গল আর নানা জীবজন্তু দিয়ে ভরা ছিল সে দ্বীপ। জল-জঙ্গল সাফ করে আগন্তুক নাবিকেরা গড়ে তোলে বসতি। সেই থেকে তারা সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা।

এদের মধ্যে এক পর্তুগিজ সাহেবের ক্যাথরিন নামে এক কিশোরী কন্যা ছিল। ঘটনাচক্রে স্থানীয় এক হিন্দু যুবকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। গির্জার নথি অনুযায়ী তার নাম ‘নরপিত সিং’। এখানকার বাঙালি খ্রিস্টানদের মতে তা ‘নরপতি’ কিংবা ‘নৃপতি’ হবে। খ্রিস্টান সম্প্রদায় এই প্রণয় নিয়ে মাথা বিশেষ না ঘামালে কী হবে, স্থানীয় হিন্দুসমাজ গেল বেজায় চটে। ক্ষিপ্ত এতটাই যে ক্যাথরিনকে হত্যা করার পরিকল্পনাও নাকি তৈরি হয়েছিল। ‘অনার কিলিং’ আর কি! প্রেমিক নরপতির কানে এ খবর পৌঁছোতেই সে সটান খ্রিস্টান সমাজের শরণাপন্ন হল। তারা বিপদ বুঝে আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে রাতারাতি নদীপথে তাদের পাঠিয়ে দিল সুদূর বেনারসে।

বেনারস থেকে নরপতি ও ক্যাথরিন ফিরে আসে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। তখন তারা স্বামী-স্ত্রী তো বটেই, চার সন্তানেরও জনক-জননী। ইতিমধ্যে গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। সেই দম্পতি প্রতি রবিবার ধর্মতলার ‘ইউনিয়ন চ্যাপেল’এ প্রার্থনায় যোগ দিতে যেতেন। এক সময়ে তাঁদের মনে হল, নিজেদের এলাকাতেই একটি গির্জা গড়ে তুলতে পারলে এতটা পথ যাতায়াতের সমস্যা থাকে না। গড়ে উঠল গির্জা। সেটির উদ্বোধন হয় ১৪ফেব্রুয়ারি ১৮২৯। স্থানীয়েরাই উদ্যোগী হয়ে উদার হাতে জমি ও অন্যান্য সম্পদ দান করেন গির্জার জন্য। চব্বিশ পরগণার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ম্যাকগ্রোভার ১৮৩৮-এ গির্জাকে স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন। স্থানীয় শিশুদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও খোলা হয় গির্জার অধীনে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে।

ক্রমে এই গির্জা অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। এতটাই যে স্থানীয় প্রশাসনও তার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। গির্জা কর্তৃপক্ষেরই প্রদত্ত নাম ‘খ্রিষ্টপুর’। স্থানীয় একজন বিশিষ্ট খ্রিস্টান সুশান্ত মালাকার। দীর্ঘদিন তিনি গির্জার সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। চার পুরুষের খ্রিস্টান সুশান্তবাবুর বাবা ছিলেন গির্জা-পরিচালিত প্রাইমারি স্কুলটির হেডমাস্টার। তাঁর মুখেই শোনা, একবার পুলিশ স্থানীয় কয়েকজনকে চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু গির্জার তৎকালীন প্রধান রেভারেণ্ড সত্যেন্দ্রনাথ সরকার পুলিশকে হুকুম করেন তাদের ছেড়ে দেবার জন্য। কারণ, তাঁর দাবি, এরা নির্দোষ। অকাট্য প্রমাণ থাকলেও তারা ছাড়া পেয়ে যায়। এরকম বহু অপরাধীই গির্জার বদান্যতায় বেকসুর ছাড়া পেয়ে যেত। গ্রামবাসী ছিল অত্যন্ত গরিব। মাছধরাই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। চুরি-ডাকাতি করেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করতো। এই সব চোর ডাকাতদের কারুর কারুর নাম এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে, যেমন যোহান (John), পিতোর (Peter) ইত্যাদি।

খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য গির্জা কর্তৃপক্ষকে কখনও জোরজুলুম করতে হয়নি। এখানে এখনও রয়েছে খ্রিস্টান পাড়া। এই অঞ্চলে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান পরিবারের সংখ্যা ছিল ৩৪২। ক্রমে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০। প্রসঙ্গত, সারা দেশে খ্রিস্টান জনসংখ্যা এখন দু কোটির কিছু বেশি। ১৯০৫-এ এক ভয়াবহ ভূকম্পে গির্জাটি ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন নাজারেথ এনজিনিয়ারিং কোম্পানি মেরামতের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু সেই পুরনো আদল তারা আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি। মূল গির্জার চূড়া ছিল মাত্র একটি। গির্জার সে সুদিনে গ্রহণ লাগে। তার বিরাট সম্পদের অনেকটাই বেহাত হয়ে গেছে। পুরনো ইতিহাস টিঁকে রয়েছে শুধু গির্জার চৌহদ্দি, খ্রিস্টানপাড়া, মিশন বাজার নামের মধ্যে। তবে কিছু বছর আগে গির্জা নব কলেবরে সজ্জিত হয়েছে। তার সেই প্রাচীন জরাজীর্ণ চেহারা বদলে গেছে। এসেছে চোখ ধাঁধানো জৌলুস। আশপাশে আরও গির্জা রয়েছে। সেসব অবশ্য অনেক পরে গজানো, তবে গির্জাগুলির নথিপত্র, বিজ্ঞপ্তি সর্বত্র এই সেদিন অবধি স্থান নাম ইংরেজিতে লেখা হত Christopur (খ্রিষ্টপুর)।

এ তল্লাটের পরাক্রান্ত জমিদার ছিলেন লক্ষীকান্ত প্রামাণিক। সে অবশ্য অনেক পরের কথা। এই প্রামাণিক মশাই-ই খ্রিস্টপুর নাম পালটে কৃষ্ণপুর রাখার প্রস্তাব দেন। কেন কৃষ্ণপুর, তার প্রকৃত কারণ স্পষ্ট নয়। সম্ভবত বিপ্লবী আন্দোলনে সহযোদ্ধা কৃষ্ণপদ বন্দ্যোপাধ্যাযের স্মৃতিরক্ষার জন্যই তাঁর এই প্রস্তাব। তারই অপভ্রংশ আজ ‘কেষ্টপুর’। খ্রিস্ট এবং কৃষ্ণের এই সম্মিলন একরকম ভাবে এখানকার মিশ্র সংস্কৃতিরই প্রতীক।

2 COMMENTS

  1. অসাধারণ। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বিদ্যাধরী নদীর এই বহতা দেখে অবসক হলাম। বর্তমান সল্টলেক মহিষবাথান অঞ্চল থেকে পাথরঘাটা মৌজার কাদা, গোষালা, আকন্দকেশরী পঞ্চায়েত জুড়ে এর বিস্তার ছিল। বালির স্রোত আর দীর্ঘতল বাড়ির তলেে আজও জল বয়ে যায়। মাটির নিচে বিদ্যাধরীর একই মায়াময় খেলা বোঝা বড় দায়।
    এই নদীর দ্বীপ গুলোতে দাঁড়িয়ে থাকা নতুন শহরগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ বিত্তবান।
    কেষ্টপুরের মতো পুরনো ইতিহাস খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে।

  2. In spite of living in kestopur for last 40 years, This history was unknown to me, Thank you for giving me a wide range of Knowledge about my own Kestopur. Keep postings many more history about My Kestopur.

Comments are closed.