পর্ব ১৬

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

জুলফিকার বাহিনী -এক সন্ত্রাসের নাম

সুন্দরবনের পশ্চিম দিকে যখন রাজত্ব করছিল রাজুবাহিনী, সেই সময় পূর্বদিকের ত্রাস ছিল জুলফিকারের অনুগামীরা।  জুলফিকারের বাড়ি মংলার জয়মনির ঘোলে। এটি একেবারে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়। শেলা নদীর এপারে লোকালয়— সেখানে জুলফিকারের বাড়ি, অন্যদিকে সুন্দরবন। রাজু আর জুলফিকার একসময়ে একসঙ্গে সুন্দরবনে গাছ চুরির কাজ করতো। পরে  ওদের ওস্তাদ নূর হাবিব ওদের আলাদা করে দেয়। পশুর নদীর পশ্চিম দিকের দখল নেয় রাজু আর পূর্বদিকে জুলফিকার। সুন্দরবনের মাছ ধরার মূল জায়গা কিন্তু পশুর নদীর পূর্বদিক। দুবলার চর থেকে শুরু করে একেবারে বঙ্গোপসাগর বিরাট এলাকা জুড়ে ডাকাতি করতো জুলফিকার। সুন্দরবনের বেশিরভাগ মাছ ব্যবসায়ীদের নিয়ে তার কারবার। খুলনার মাছচক্রের গডফাদাররা ছিল জুলফিকারের মূল সহযোগী। এর ফলে অস্ত্রশস্ত্র, কাঁচা টাকা সংগ্রহের যে লাইন—জুলফিকার সেটা একেবারে পাকাপোক্ত ভাবে করতে পেরেছিল। অল্পদিনের মধ্যেই জুলফিকার বাহিনী একটি বড় বাহিনীতে পরিণত  হয়।

জুলফিকার বাহিনী অত্যাচারী দস্যুদল হিসাবে পরিচিত ছিলো। মুক্তিপণ বা চাঁদা আদায়ের জন্য তারা যে কোনও পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারতো। কেউ কোনওদিন রেয়াত পায়নি জুলফিকারের হাত থেকে। বড় জেলে, মাছ ব্যবসায়ী, প্রান্তিক জেলে— সবাইকেই পূর্ব সুন্দরবনে মাছ ধরতে গেলে জুলফিকার বাহিনীকে টাকা দিতে হতো। আর এই বাহিনীর অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশি ছিলো যে এখনও সুন্দরবনের অনেক জেলে জুলফিকার বাহিনী বা জুলফু বাহিনীর নামে কাঁপে। এতটাই নৃশংস, অত্যাচারী ছিল এই বাহিনী। জেলেদের মেরে মুখ ভেঙে দেওয়া, হাত পা ভেঙে দেওয়া— এই বাহিনীর কাছে মামুলি ব্যাপার ছিল। আপনারা জানেন, সুন্দরবনের একটি গাছের নাম হল গরান। জুলফু বাহিনীর এক ধরনের অত্যাচারের নাম হয়ে গিয়েছিল গরান। ব্যাপারটা হল, এই গরান গাছ যখন ছোট থাকে, সেই গাছ কেটে লাঠি বানাতো তারা। আর এই গাছ কাঁচা অবস্থায় মারাত্মক। ওই গাছ দিয়েই লাঠি পেটা করতো জেলেদের। একটা গরানের বাড়ি! সেটা যে কতটা যন্ত্রনাদায়ক— তা বলে বোঝানো যাবে না। পুলিশের থার্ড ডিগ্রির কথা আপনারা অনেকেই শুনেছেন। জুলফু বাহিনীর অত্যাচার ছিল তার থেকেও বেশি। তারা এতো তীব্র অত্যাচার চালাতো যাতে পুরো এলাকা নিজেদের বশে থাকে। আতঙ্ক দিয়ে সুন্দরবনের পূর্ব এলাকার সমস্ত জেলেদের দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল জুলফিকার বাহিনী। হয়েছিলও তাই। কোনও জেলের সাহস ছিল না জুলফু বাহিনীকে টাকা না দিয়ে মাছ ধরার। তবে জুলফিকার নিজে কোনও দিন কারও গায়ে হাত দিত না। ওর দলে সেই কাজটি করতো বশির। জুলফিকারের মামা। একজন মূর্তিমান আতঙ্ক।  সুন্দরবনের প্রতিটি ডাকাত দলে এমন কিছু লোক থাকতো যারা নির্দয় ভাবে জেলেদের উপর অত্যাচার করতো। যেমন জুলফিকার বাহিনীতে বশির, সাত্তার বাহিনীতে কালু (আসল নাম জুয়েল) , মোতালেব বাহিনীতে মিলন— মিলন পাটোয়ারী । এদের নাম শুনলে সুন্দরবনের জেলে, মাওয়ালী,বাওয়ালীরা এখনও কাঁপতে থাকে। এদের কাজ ছিল জেলেদের উপরে অত্যাচার করা। জলদস্যুদের ভয় পেতে হবে, নইলে টাকা দেবে কেন জেলেরা? তাই এই লোকগুলিকে উৎসাহিত করা হতো যাতে তারা জেলেদের উপর চরম অত্যাচার করতে পারে। এমনও শুনেছি, একজন জেলেকে ধরে তাকে দিয়ে বাড়িতে ফোন করিয়ে চরম অত্যাচার চালানো হতো। যাতে বাড়ির লোক জেলেটির অসহায় চিৎকার শুনে মুক্তিপণের টাকা তাড়াতাড়ি জোগাড় করতে শুরু করে।  জুলফিকারের সঙ্গে ছিল তার ভাই মোর্তজা, মামা বশির, রেজাউল, আরও কিছু আত্মীয়স্বজন। তবে জুলফিকারের একটি গুণ ছিল যা সুন্দরবনের অন্য দস্যুনেতাদের মধ্যে বড় একটা দেখা যেত না। জুলফিকার কোনওদিন তার সঙ্গীদের ভাগের টাকা নিয়ে কোনও ছলচাতুরি করতো না। সেই কারণে জুলফিকার নিজের দলের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল। আমার সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য কথা হয়েছিল জুলফিকার আর ওর ভাই মোর্তজার সাথে। আমি তাদের দস্যু জীবন থেকে সরে আসার জন্য বুঝিয়েছিলাম, বলেছিলাম আত্মসমর্পণ করতে। জুলফিকার বলেছিল, আগে রাজু আত্মসমর্পণ করুক। তারপর আমিও করে ফেলবো।

কিন্তু জুলফিকার আত্মসমর্পণের সুযোগ পায়নি। তার আগেই মৃত্যু হয়েছিল তার। জুলফিকারের জলদস্যু জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা হল তার মৃত্যু। অনেক ধরনের মৃত্যুর কথা শুনি আমরা। দলীয় কোন্দলের ফলে নিহত হওয়া, প্রতিপক্ষ দস্যুদলের বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মারা যাওয়া। কিন্তু ‘স্ত্রী-র বিশ্বাসঘতকতায় জুলফিকারের প্রাণ হারানো’-র কথা এখনও সুন্দরবনের দস্যুদের মুখে মুখে ফেরে।

জুলফিকার অগুনতি কাঁচা টাকার মালিক ছিল। অগুনতি বলতে কোটি কোটি। জুলফিকার সেই টাকা নিয়ে কিছুদিনের জন্য সুন্দরবন ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। জুলফিকার সেই সময় দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিল। শুনেছি, কথাটি সে তার স্ত্রীকে জানিয়েছিল।

জুলফিকারের স্ত্রী বলেছিল, ঠিক আছে। কোথায় যাবো, কোথায় থাকবো সে সব নিয়ে আমরা পরে সিদ্ধান্ত নেবো।  কিন্তু বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে, তুমি এসো। স্ত্রী-র বায়না পূরণ করতে জুলফিকার রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে গহীন বন থেকে নদী পেরিয়ে খুলনায় তার স্ত্রীর বাড়িতে যায়। আমি যতটা জেনেছি, সেই সময় জুলফিকারের কাছে নাকি প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ছিল। জুলফিকার ওই টাকাটা এনে স্ত্রীর হাতে দেয়। তার কিছু পরে ওখানে হাজির হয় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলে তারা। শোনা যায়, জুলফিকারকে খুলনার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কয়েকদিন পরে খবর মেলে, ক্রসফায়ারে মারা গিয়েছে জুলফিকার।

এখানে একটা ছোট কথা না বললেই নয়। জুলফিকারের শ্যালক ছিল খুলনার মাছ ব্যবসায়ী সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি এখন একজন সম্পদশালী ব্যক্তি। একটি বড় মাছ আড়তের মাতব্বর…।

সকালের প্রথম রোদ্দুর সুন্দরবনে

যাই হোক, জুলফিকারের মৃত্যুর পরে জুলফু বাহিনীর দায়িত্ব নেয় তার ছোটভাই মোর্তজা। শোনা যায়, একই রকমের ফাঁদে ফেলে ধরিয়ে দেয়। একই ভাবে মারা যায় মোর্তজা। পরপর দুই ভায়ের মৃত্যুর পরে জুলফু দলের দায়িত্ব নেয় শীষ্য। সেও একসময় ধরা পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এরপর দলটি পুরোপুরি ভেঙে যায়।

জয়মনিতে পাশাপাশি জুলফিকার ও মোর্তজা—দুই ভায়ের কবর দেওয়া আছে। আমি গিয়েছিলাম সেখানে। সেইসময় জুলফিকারের মা আমার কাছে এসেছিলেন। কান্নাকাটি করলেন। আমাকে বলেছিলেন, তুমি যদি আগে আসতে বাবা, আমার দুই ছেলেকে এই ভাবে মরতে হতো না।

আমি বলেছিলাম, মা। আমি এদের অনেক আগে বলেছিলাম। সত্যি যদি ওরা আমার কথা শুনতো, হয়তো ওদের এভাবে মরতে হতো না।

একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন, জুলফিকার চেয়েছিল তার অগাধ সম্পত্তি নিয়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে। তাই সেই গোপন কথাটি স্ত্রীকে জানিয়েছিল। ব্যাপারটা এমন নয়তো যে সুন্দরবনের ডাকাতি ছাড়তে গেলেও তোমাকে জীবন হারাতে হবে!

যাই হোক, জুলফিকার বাহিনী সত্যি একটি সংগঠিত বাহিনী ছিল। তবে পরে এই বাহিনী ভেঙে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এদের অনেকে আত্মসমর্পণ করেছিল সরকারের কাছে।

আগামী পর্বে কথা হবে মাষ্টার বাহিনীকে নিয়ে। এক সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে জন্ম হয়েছিল সেই বাহিনীর।

(ক্রমশ)