(সাজানো নেই রাশি রাশি বই। বরং এখানে মানুষই একেকটা বই। পৃথিবীর আশিটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মানব গ্রন্থাগার (Human Library)। চালু হয়েছে গুজরাতের জুনাগড়েও। লিখেছেন সঞ্জয় চক্রবর্তী।)
যখন ছোট ছিলাম, দিদিমা, ঠাকুমা, অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যাওয়া পিসি, যিনি সময়ের দানে অকালেই বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছিলেন, বড় দাদা, দিদিরা গল্প শোনাতেন। বৃষ্টির রাতে বা খুব গভীর কালো রাতে লণ্ঠনের আলোয় ভূতের গল্প জমতো ভাল। আর,ঘুমোবার সময় ভয়হীন গল্পেরা ভিড় জমাতো। তখন রাজপুত্তর,রাজকন্যার জয়। দুষ্টু দানবের পরাজয়।
সেই দিনকালও গিয়েছে, গল্প বলাও গিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। কোন চুলোয়, কে জানে! একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে এখন সিঙ্গল ইউনিট। কারও কাছে সময় নেই। জীবন পরিবর্তনশীল। সেই পরিবর্তনের হাত ধরে গল্পের বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে নিয়েছে অডিয়ো ভিসুয়াল মিডিয়া। রেডিয়োর নাটক থেকে, রেকর্ড প্লেয়ারে ভানুর কমিক থেকে, ক্যাসেটের শেষের কবিতা সেরে, সিডির কর্ণ কুন্তী সংবাদ হয়ে এখন আমরা টিভি ফিল্মের সঙ্গে পেয়ে যাচ্ছি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। কথক ঠাকুরের কথকতাও খুঁজে নিতে হবে।
অথচ একসময়ে মা মাসিরা দুপুরের আহার সেরে, মুখে একখিলি পান পুরে হাতে নিতেন বই। কিছু কেনা, কিছু গ্রন্থাগার থেকে আনা। টিভি আসার আগে এই লাইব্রেরিগুলির দারুণ রমরমা ছিল। অনেক সময়ে পছন্দমতো বই পাওয়াও যেত না। অপেক্ষা করতে হতো— যে নিয়েছে, সে ফেরৎ দিলে তবেই পড়া। অনেকের তো নেশাই ছিল রোজ লাইব্রেরিতে যাওয়া।
বই এখনও লোকে পড়ে। আজকাল মাধ্যম বেড়েছে। আন্তর্জালে অনেকরকম বইয়ের ফ্রি পিডিএফ পাওয়া যায় ও ডাউনলোড করা যায়। স্যোশাল মিডিয়ার সৌজন্যে অনেক বইয়ের পিডিএফ, কষ্ট না-করেই পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে কিন্ডেল এবং অডিয়ো বুকও। অনলাইনে পছন্দমতো বই কিনতে পারা যায়। এসবের কারণে লাইব্রেরির চাহিদা কমেছে। পুরনোকে বর্জন করে নতুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ। এটা তো হওয়ারই কথা। সব সময় নতুনকে আহ্বানই সময় ও জীবনের সারসত্য।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নিত্যনতুন ভাবনারও ক্রমবিকাশ ঘটছে। সেই ভাবনা থেকেই এক অভিনব পরিকল্পনা রূপায়িত হয়েছে এক স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশে। ২০০০সাল। ডেনমার্কের কোপেনহাগেন শহরে, একটি সংগীতের উৎসব চলছিল, যার নাম,রস্কিলড ফেস্টিভ্যাল। এখানেই জন্ম নিয়েছে বিশ্বের প্রথম মানব গ্রন্থাগার। এই অভিনব গ্রন্থাগারের পরিকল্পনা যাঁদের মাথায় আসে, তাঁরা হলেন, রনি,ড্যানি আবারগেল,আসমা মৌনা ও ক্রিস্টোফার এরিকসেন। পরবর্তীতে তাঁরা Danish Youth NGO Stop Golden— মানে হিংসা বন্ধ করার NGO র সঙ্গে যুক্ত হয়ে একসাথে এই মানব গ্রন্থাগার চালিয়ে যেতে থাকেন। এই সংগীত উৎসবে মানব গ্রন্থাগার, দিনে আট ঘণ্টা করে মোট চারদিন কথাবার্তা চালু রেখেছিল এবং এখানে এক হাজারেরও বেশি মানুষ যোগদান করেন। প্রতিটি সেশনের সময় ৩০ মিনিট। এই সময়ে শেষ না-হলে যে কেউ আরও ১০ মিনিটের জন্য আবেদন করতে পারেন।
আসুন, এবার দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে কাজ করে এই মানব গ্রন্থাগার?
অন্যান্য লাইব্রেরির মতো আপনি গিয়ে যদি বলেন, ‘গোরা’ দিন তো বা ‘পথের পাঁচালি’ আছে? পাবেন না। গল্পপাঠ বা সাহিত্যের রসাস্বাদনের জন্য এই গ্রন্থাগার নয়। কারণ, এখানে বই নয়, রয়েছে মানুষ— যাকে আপনি সদস্য কার্ড দেখিয়ে বাড়ি বয়ে আনতে পারবেন না। এবং সময়ও বেধে দেওয়া রয়েছে ৩০ মিনিট। এখানে বই, গল্প,প্রবন্ধ শোনাবে না, মানুষের তাঁদের জীবনের কথা শোনাবে। একজনের মুখ থেকে অন্যরা শুনবে বক্তার জীবনের ওঠাপড়ার কথা। মানুষের মানসিক চাপ কমাতেই এই উদ্যোগ। সমাজে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মানুষেরা রয়েছেন, যা আমাদের অজানা। সেই অভিজ্ঞতা জেনে নিজেদের উন্নত করার চেষ্টা।
মানব গ্রন্থাগারের একটি বোর্ডে প্রোগ্রাম লেখা রয়েছে। OCD, PTSD, LONELY, VICTIM OF INCEST, SEXUALLY ABUSED, DEEF BLIND, BISEXUAL, RARE HANDICAPED, BULLIED, HIGH IQ ইত্যাদি। অর্থাৎ এইসব সমস্যায় ভোগা মানুষেরা নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা শোনাবেন। তাঁরা হলেন একেকটি বই— জীবন্ত মানব, গ্রন্থের ভূমিকায়। আপনি তাঁদের কথা শুনবেন, আপনি পাঠক। তাঁদের অভিজ্ঞতা শুনে নিজের জীবনকে উন্নত করবেন। মানসিক চাপ মুক্ত হবেন। ভাল থাকবেন।
কোপেনহাগেনের মানব গ্রন্থাগার এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে আজ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে তার আদর্শ নিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। ভারতের জুনাগড়ে তৈরি হয়েছে দেশের প্রথম মানব গ্রন্থাগার। গুজরাতের জুনাগড়ে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরেটের অফিসে।
মানুষের মন ভাল রাখতে এই অভিনব পরিকল্পনাটি আরও বিকশিত হোক।