বাইরের পাঁচিলের গ্রিলের গেটটা খুলে দু’জন লোক ভিতরে ঢুকে এসেছে। দু’জনের দু’হাতে দুটো বড় চটের ব্যাগ। ভুলু ভুকভুক করে ডেকে উঠেছে ওদের দেখে। দু’জনের জামাতেই সেফটিপিন দিয়ে কোন এক বন্ধ কারখানার শ্রমিক সংগ্রাম মঞ্চ লেখা। বন্ধ কারখানার শ্রমিক! ব্যাগ থেকে বড়ি, পাঁপড়, আচার বের করে দেখাচ্ছে। মা, ঠাকুমা, জেঠিমারা টুকটাক কিনছে কখনও কখনও। ছোটবেলার খুব পরিচিত দৃশ্য।
বেহালাতে তখন কত্ত কারখানা। কারখানাতে ঘণ্টা ধরে ভোঁ পড়ত।লোকে বলত কলের বাঁশি। আশেপাশের লোকেরা সেই শুনে ঘড়ি মিলিয়ে নিত আর শ্রমিকরা সাইকেলে টিফিনকৌটো ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ত। স্কুলে যাওয়ার সময় দেখতাম কোনও কোনও কারখানার গেটের সামনে লাল শালু দিয়ে মঞ্চ হয়েছে৷ অবস্থান বিক্ষোভ চলছে। অথবা ধর্না। স্ট্রাইক, লকডাউন, ধর্না এই শব্দগুলো লাল আলতা দিয়ে আঁকা হতো কাগজে। ক্ষেত্র বিশেষে তার আলাদা আলাদা অর্থ।
কোনও কারখানা খুলত, কোনটা কারখানা চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। গেটের সামনে তাঁবু খাটিয়ে আবছা অবয়বরা অপেক্ষায় থাকত দিনের পর দিন৷ পিছনে একটা টুকরো কাগজ পালটে পাল্টে যেত। তিরিশ… চল্লিশ… একশ… তার পর একদিন কাগজটা পাল্টাতে ভুলে যেত সবাই৷ তাঁবুটাও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ত। বটের চারা গজিয়ে উঠত কারখানায় শেডে। গেটের দু’পাশে গজিয়ে উঠত চায়ের দোকান৷ বন্ধ কারখানার একজন শ্রমিক চপের দোকান দিত। তার ঘোমটা দেওয়া জড়োসড়ো বউ বুগবুগ করতে থাকা গরম তেলে ছেড়ে দিত বেগুনি আর নারকেল তেলের সবুজ টিনের কৌটতে করে মুড়ি মেপে ঠোঙায় ভরে দিত।
বন্ধ কারখানা মানে কালিমাখা এক ঝুপসি আঁধার। রাতের অন্ধকারে কলকব্জা মেশিন চুরি৷ বহু বহু বছর পর ময়দানবের যাদু কলকাঠিতে সেখানে গজিয়ে উঠবে অট্টালিকা, আবাসন, ফ্ল্যাটের সারি।
মনে আছে, উষা ফ্যাক্টরির নাম পাকাপাকি বদলে গিয়ে সাউথ সিটি মল যেদিন খুলল, সেদিন সকাল থেকে পাকেচক্রে একদম পাশের একটা বাড়িতে ছিলাম। এডিটিং চলছিল। বিকেলে চা খেতে বেরোলাম। দেখি চায়ের দোকানে আজিজুল হক বসে আছেন। আমার সাথে ছিল বিজয়দা, ওনার পূর্বপরিচিত। কথায় কথায় উনি উষা ফ্যাক্টরির কথা বলছিলেন৷ লকডাউন, শ্রমিকদের লড়াই, শ্রমিক কোয়ার্টার আগলাতে গিয়ে লাঠি খাওয়া। কী মনে হল, ফস করে বলে ফেললাম, আসুন নতুন এই শপিং মলের সামনে আপনার একটা ছবি তুলি। উনি কিছুতেই রাজি হলেন না। ঝকঝকে আলোর উদযাপনের সামনে ভাঙাচোরা হেরে যাওয়া অতীত নিয়ে হয়তো দাঁড়াতে চাননি। অতীত মানেই তো ভূত। সমাজ যাকে ভয় পায়।
আমার মেজোজ্যেঠু কাজ করতেন অশোক লেল্যান্ড কোম্পানিতে। মাধ্যমিক দিয়েই কাজে ঢুকে পড়েন। অভাবের সংসারে অনেকগুলো ভাইবোন তাই বেশিদূর পড়াশোনা করার বিলাসিতা জোটেনি। আজীবন হাতা গোটানো বাংলা শার্ট আর ধুতি পরতে দেখেছি৷ বিয়ে থা করেননি। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ছোট ভাইপো ভাইঝিদের নিয়ে যেতেন নিজের কর্মক্ষেত্রে। সেদিন সেখানে ঢালাও খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত। বিকেল থেকে শুরু হয়ে যেত ফাংশন। মঞ্চের দখল নিত রফি, কিশোর, লতা, মুকেশ কন্ঠীরা। সেদিন শিল্পীরা এই কারখানা থেকে ওই কারখানা খেপ খেলে বেড়াতো। বেহালায় তখন একসে বড়কর এক ফ্যাক্টরি। রিকেট এন্ড বেনসার, সিমেন্স, আয়ার্স, ফিলিপস, পোলার। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন কারখানার গেট সবার জন্য খোলা৷ এখন ভাবলে কেমন দূরের আবছা স্বপ্নের মতো মনে হয়। সাউথ সিটি মলের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ যদি আজ উষা কারখানা খুঁজতে চায় তাকে যেমন আবছা, ভুবোম্বুল অতীতের ভূত মনে হবে অনেকটা তেমনই।
একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো কারখানা মানে দেশের উন্নতি৷ দেশ স্বাবলম্বী হবে, মানুষ কাজ পাবে৷ উন্নয়ন হবে। তাই কারখানার জন্য একলপ্তে প্রয়োজনীয় জমি সরকার জোগাড় করে দিত। কারখানা করার জন্য শিল্পপতিদের প্রয়োজনীয় জমি জোগাড় করে দেওয়ার কাজ সরকার নিজের কাঁধে নিয়ে নিত। কারণ, কারখানা হলে অনেক লোক কাজ পাবে৷ বড় রাস্তা, যাতায়াত, জল, বিদ্যুতের সুবিধাযুক্ত জমি সরকার অধিগ্রহণ করত। যাদের জমি যেত, তারা সরকারি হারে ক্ষতিপূরণ পেতেন হয়তো৷ হয়তো পেতেনও না। কারখানার জন্য যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হতো, তাদের পরিবারের কাউকে সেই কারখানায় চাকরি দেওয়া হতো। এমন অনেক পরিবারকে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি।
আচ্ছা, এই যে বন্ধ কারখানাগুলোর জমিতে বিশাল বিশাল হাউজিং কমপ্লেক্স, শপিং মল হচ্ছে আর কোটি টাকায় একটা ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে যাদের জমি সরকার বৃহত্তর স্বার্থে অধিগ্রহণ করে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ ছুঁড়ে দিয়েছিল তারা কেন কিছু পাবে না? অবশ্য এই দাবি করতে গেলেও কোমরের জোর থাকা চাই৷
বন্ধ কারখানার শ্রমিক কারখানায় জমিতে গড়ে ওঠা ফ্ল্যাটে সিকিউরিটি গার্ড হবে, তার ছেলে মেয়ে ঠিকে কাজ পাবে। অটো চালাবে, রিক্সা টানবে আর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন গলা অব্ধি মদ খেয়ে দেদার নাচবে। কারখানার গেট থেকে রিক্সা স্ট্যান্ড, বিশ্বকর্মা পুজোর এই বিবর্তনটা এক জীবনেই দেখে যেতে পারলাম।
বন্ধ কারখানার ছবি: ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের টুইটার থেকে।
খুব ভালো লেখা, আমারও এরকমই কারাখানা, জুটমিল এলাকায় বড় হওয়া তাই খুব relate করতে পারলাম। দারুণ লাগলো।
আবেগমথিত লেখা, মানস।