না, তোমার কোনও যোগ্যতা নেই ইভাকে বিয়ে করার। 

ইভার পরিবার প্রত্যাখ্যান  করল জিম থর্পের(Jim Thrope) অনুরোধ। 

কেন ?  আমার কি ইভাকে বিয়ে  করার  কোনও যোগ্যতাই নেই— পাল্টা প্রশ্ন ছিল জিমের।

প্রমাণ করো নিজেকে! তা হলেই তোমার হাতে তুলে দেব আমাদের মেয়েকে। 

প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরলেন জিম থর্প। যোগ্যতা দেখাতে হবে?  ঠিক আছে। জিম রওনা দিলেন সুইডেনের স্টকহোমের উদ্দেশ্যে। ওখানে বসেছে ১৯১২ সালের অলিম্পিক। গোটা দুনিয়া থেকে প্রতিযোগীরা আসছে। সেখানেই নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। 

তারপরের ঘটনা যেন এক মহাকাব্য। দুঃসাহসী  কোনও লেখকও যা কল্পনায় আনতে পারবেন না। সেই কাজই করে দেখালেন জিম।  ১১০ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই অলিম্পিকে(olympic) দুটো সোনার মেডেল জিতলেন।  না, শুধু জিতলেন না। দুটো বিশ্বরেকর্ড ও করলেন । সুইডেনের রাজা পঞ্চম গুস্তাফ তাঁর গলায়  দু’টি স্বর্ণপদক পরিয়ে ঘোষণা করলেন, জিম থর্প(Jim Thrope) হলেন  বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ। 

দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ! কিন্তু অলিম্পিকের কোনও নথিতে তো লেখা নেই সেই কীর্তি! আগে বলি, যে ইভেন্টগুলিতে জিম সোনা জিতেছিলেন, সেগুলি হল, পেন্টাথলন ও ডেকাথলন। গোটা বিশ্বে  তিনিই প্রথম যিনি এই দুটি ইভেন্টে সোনা জিতলেন। গ্রিক শব্দ পেন্টা মানে পাঁচ। ডেকা-র অর্থ দশ।  ১৯১২ সালে পেন্টাথলনে হতো আলাদা পাঁচটি প্রতিযোগিতা (লংজাম্প, জ্যাভলিন, ডিসকাস থ্রো, ২০০ মিটার দৌড়, ১৫০০ মিটার দৌড়)। ডেকাথলন দশটি আলাদা প্রতিযোগিতা নিয়ে। কী সেগুলি? লং জাম্প, হাইজাম্প, ডিসকাস থ্রো, জ্যাভলিন থ্রো, পোল ভল্ট ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের দৌড়। সব মিলিয়ে যিনি ভাল ফল করবেন, তাঁর গলাতেই উঠবে পদক। 

সেই অলিম্পিকে এক দিনে হয়েছিল পেন্টাথলন প্রতিযোগিতা। জ্যাভলিন বাদ দিয়ে সবকটিতেই প্রথম জিম থর্প। আর জ্যাভলিন! একমাস আগেও জিম জানতেন না জ্যাভলিন কী ভাবে ছুড়তে হয়! তবু সেই ইভেন্টে তিনি ছিলেন চতুর্থ স্থানে। ১৫০০ মিটার দৌড়ে প্রথমবার ভাঙলেন ৫ মিনিটের গন্ডী। ৪ মিনিট ৪৪.৮ সেকেন্ডে শেষ করলেন দৌড়। বিশ্বরেকর্ড!

 পাঁচ দিন পরে শুরু হল সবচেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতা, ডেকাথলন। চলবে তিন দিন ধরে। কিন্তু প্রথম দিনে সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি। তার মধ্যেই শুরু হল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রথম দিনে তিনটি ইভেন্ট। জিম ১০০ মিটার দৌড়ে  তৃতীয়, লংজাম্পে দ্বিতীয়, শটপুট থ্রোতে  দ্বিতীয় স্থান অধিকারীর থেকে আড়াই ফুটেরও বেশি দূরে ছুড়ে প্রথম।

দ্বিতীয় দিন সূর্য ঝলমল করছে আকাশে। কিন্তু  সমস্যা হল অন্য জায়গায়। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জিমের জুতোজোড়া। যেখানে রাখা ছিল সেখানে পড়ে রয়েছে ভিন্ন মাপের দু’টো জুতো। পায়ে কোনওটাই হচ্ছে না। কিছু না ভেবে মিসফিট জুতো পরেই জিম পৌঁছলেন মাঠে। হাইজাম্পে প্রথম হলেন , ৪০০ মিটার দৌড়ে চতুর্থ আর ১১০ মিটার হার্ডলসে ১৫.৬ সেকেন্ড  সময় করে  প্রথম (বিশ্বরেকর্ড)। শেষ দিনেও নামলেন মিসফিট জুতো পরে। ডিসকাসে দ্বিতীয়, পোল ভল্টে তৃতীয়, জ্যাভলিন থ্রোতে তৃতীয় এবং তারপর নিজের প্রিয় ইভেন্ট ১৫০০ মিটার দৌড়ে পেন্টাথেলনের রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেলেন। ৪ মিনিট ৪০.১ সেকেন্ডে শেষ করলেন দৌড়। ১০,০০০-এর মধ্যে পেলেন ৮,৪১২.৯৫ পয়েন্ট। রৌপ্যপদক জয়ী সুইডেনের(Sweden Olympic) হুগো উইসল্যান্ডারের থেকে ৭০০ পয়েন্ট বেশি! ১৯৭২-এর অলিম্পিক পর্যন্ত জিমের সেই রেকর্ড অক্ষত ছিল।

১৯১২-র গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে পেন্টাথলন এবং ডেকাথলনের ১৫টি ইভেন্টে থর্পের মহাকাব্যিক পারফরম্যান্স কিন্তু রেকর্ডের পাতা থেকে মুছে  ফেলা হল একদিন। অলিম্পিক কমিটি তাঁর পদক কেড়ে নিল। কারণ, অভিযোগ উঠল, ১৯০৯-১০ সালে মাইনর লীগে  বেসবল খেলে অপেশাদারের নিয়ম লঙ্ঘন করেছিলেন তিনি। অলিম্পিক হল অপেশাদারদের জন্য। এখানে টাকার কোনও স্থান নেই। কিন্তু থর্প বেসবল খেলে টাকা রোজগার করেছেন। তাই অফিসিয়াল রেকর্ড থেকে তাঁকে মুছে ফেলা হল। এখন অবশ্য পেশাদার বাস্কেটবল টিম বা পেশাদার ফুটবল টিম অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা পায়। কিন্তু অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছে জিম থর্পের নাম। 

ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ অলিম্পিক হিস্টোরিয়ান্স-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা, আইওসি-র পরামর্শদাতা ও পরিসংখ্যানবিদ বিল ম্যালন অবশ্য বিশ্বাস করেন, থর্পের ১৯১২ সালের পারফরম্যান্স তাঁকে ‘‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে(GOAT)।’’ ম্যালনের যুক্তি, ১৯১২ সালের চারটি অলিম্পিক ইভেন্টের মধ্যে থর্প এক নম্বরে ছিলেন এবং আরও দুটি ইভেন্টে শীর্ষ দশে স্থান পেয়েছেন। এমন কীর্তি কোনও আধুনিক ক্রীড়াবিদ অর্জন করতে পারেননি। এমনকি, কার্ল লুইসও নন, যিনি ১৯৮৪ ও ১৯৯৬ সালে ট্রাক এন্ড ফিল্ডে নয়টি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছিলেন।  

১৯৫০ সালে American sportswriters and broadcasters জিম থর্প (Jim Thrope)কে ২০ শতকের প্রথমার্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ আমেরিকান ক্রীড়াবিদ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রিডিরন (গ্রিডিরন ফুটবল ইংলিশ রাগবি এবং সকার থেকে উদ্ভূত) ফুটবল খেলোয়াড় হিসাবে নির্বাচিত করেন।

জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল জিম থর্পকে। আপনি অলিম্পিকের পদকগুলির ফিরে পাবার জন্য আবেদন করবেন না?

 না ! জানি আমি কী করেছি। হৃদয় দিয়ে বলতে পারি, আমি অপেশাদার ছিলাম। আর আমার উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে প্রমাণ করা। তবে হ্যাঁ, আমি নিজেকে প্রমাণ করেছি আর ইভাকেও পেয়েছি। 

১৯১৩ সালেই জিম থর্পের বিয়ে হয়েছিল ইভা মিলারের সঙ্গে। 

কেউ কেউ অবশ্য জিমের পদক কেড়ে নেওয়ার পিছনে অন্য সন্দেহ করেন। গভীর কোনও ষড়যন্ত্রের শিকার নন তো থর্প ? না, কিছু প্রমাণ হয় নি। তবে বহু ক্ষেত্রে এমন হয়েছে, অনেক আমেরিকান অলিম্পিক প্রতিযোগী ওই বেসবল লিগে অংশগ্রহণ করেছেন, কিন্তু অলিম্পিক কমিটির কাছে তার খবর নেই। তা ছাড়া নিয়ম রয়েছে, কারও সম্পর্কে অভিযোগ থাকলে অলিম্পিক কমিটিকে তা জানাতে হবে ৩০ দিনের মধ্যে। কিন্তু জিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ পৌঁছেছিল এক বছর পরে। অলিম্পিক কমিটি সেটা মেনেও নিয়েছিল! আর একটা ছোট্ট সন্দেহ, কী ভাবে হারিয়ে গিয়েছিল থর্পের জুতো জোড়া ?

দুনিয়ার সামনে জিম থর্প তাঁর কীর্তি দেখিয়েছিলেন এমন সময়ে যখন নেটিভ আমেরিকানরা মার্কিন নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত ছিল না। আর থর্প ছিলেন প্রথম নেটিভ, যিনি আমেরিকার হয়ে পদক জিতেছিলেন। একজন নেটিভ (Sac and Fox Indian,native) সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের সম্মান পাবে— সেটা কি অসহ্য ছিল তাঁর দেশের একাংশের কাছে? উত্তর নেই।  

শুরু হয়েছিল  প্রতিবাদ আন্দোলন। থর্পকে পদক ফিরিয়ে দিতে হবে। ব্যাপারটা আমেরিকান নেটিভদের মধ্যে শুরু হলেও ক্রমে তা  ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বে। বছরের পর বছর চলেছিল আন্দোলন। চাপের মুখে মাথা নুইয়ে ১৯৮২ সালের অক্টোবরে (থর্পের মৃত্যুর ৩০ বছর পরে ) ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি(IOC) তাঁর পরিবারকে দুটি প্রতিরূপ পদক প্রদান করে। ঘোষণা করে, “জিম থর্পের নাম তাঁদের তালিকায় যুক্ত করা হবে, যাঁরা ১৯১২-র অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেছিলেন।” তবে সেই সঙ্গে একটি ছোট্ট বাক্যও  জুড়ে দিয়েছিল কমিটি। কী সেটা? বলা হয়েছিল, ‘‘এই খেলাগুলির জন্য অবশ্য অফিসিয়াল রিপোর্ট পরিবর্তন করা হবে না।” অন্য ভাবে বলতে গেলে, আইওসি থর্পের ১৫টি ইভেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। ফলে আজ পর্যন্ত অলিম্পিকে জিম থর্পের রেকর্ডের কোনও উল্লেখ নেই। বরং আইওসির রেকর্ড খাতায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন উইজল্যান্ডার। সেখানে জিম থর্প নিছকই একজন সহ-চ্যাম্পিয়ন।