দু’বছর আগের কথা, লকডাউনের ভরা বাজার তখন।
লোকজনের হাতে বিস্তর সময় থাকলেও আমাদের কপালে খাঁখা। রোজ অফিস, বারো ঘণ্টার উপর। ভরদুপুরে রওনা হওয়ার আগে আপন মনে গজগজ করছি, “আর পারা যায় না। কেউ যদি কিডন্যাপ করে মাসখানেক রেখে দিত.. একটু শান্তি পেতাম..”
গিন্নি আলমারি থেকে পুরনো কাগজপত্রের জঞ্জাল সাফ করছিলেন। হঠাৎ বললেন, “এটা দ্যাখো তো! বাবার হাতের লেখা।”
প্রয়াত পিতৃদেবের হাতে লেখা একটি ইংরেজি চিঠি, ১৯৯৯ সালের। রেশনকার্ড ট্রান্সফারের দরখাস্তের ডুপ্লিকেট কপি। নীচে রেশন ডিলারের স্ট্যাম্পের মাঝে গোটা গোটা ইংরেজি হরফে সই–কে পি পাল।
কাশীপ্রসাদ পাল। আমাদের কাশীদা। কী সমাপতন! আশ্চর্য!
কয়েক মুহূর্ত আগে নিজের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে লহমায় চোখের সামনে ভেসে উঠেছে কাঠের টেবিলের ওপারে তেলচিটে চেয়ারে ততোধিক তেলচিটে স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত একটি ফর্সা,নাদুসনুদুস চেহারা। কাঁধে ফেলা গামছা দিয়ে টাকের উপর জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে হুঙ্কার ছাড়ছেন, “অ্যাই অ্যাই। ভিড় করবি না, ভিড় করবি না বলছি। উফফফ… সামনেটা ছেড়ে দাঁড়া না রে বাবা…ইট্টু হাওয়া-বাতাসও আসতে দিবি না!”
চাল-ডাল-গম-চিনির বস্তায় বোঝাই গুমোট ঘরের সিলিংয়ে মান্ধাতার আমলের ফ্যান ঘুরছে ঘটাং ঘটাং। ঘাড় উঁচিয়ে বড় বড় চোখে সে দিকে ক্রুদ্ধ চাহনি হেনে ফের তর্জন, “আরে, অ্যাই রতন। কোথায় গেলি শালা রতনা.. গোডাউনে কি আমার দাদু যাবে? সব হয়েছে এক একটা!” দরজায় জমায়েত ভিড়ের মাঝে আমাদের কারও মুখ দেখলে আরও রুষ্ট, “কাজের সময় মজা মারতে এসেছিস, অ্যাঁ? পালা, এখন হবে না। ঢুকবি না বলে দিলাম।”
অবশ্যই আমরা কেউ রেশন তুলতে যাইনি। কাশীদার সঙ্গে কিঞ্চিৎ নষ্টামির তাল। ছ’ফুটি-রুনু-সমু-জগ্গুর বিড়ির জোগানদার, খৈনির সাপ্লায়ার হলেন গিয়ে কাশীদা। বয়সে আমাদের আড়াইগুণ হলেও পাড়ার সবার কাছে কাশীদা। মেমারির বর্ধিষ্ণু কৃষকবাড়ির সন্তান, পারিবারিক চালের ব্যবসা, রাইসমিল ইত্যাদি থাকতেওকাশীদা ঘরছুট হয়ে আমাদের লোহা-কয়লার শহরে এসে পড়েছিলেন কেন, কে জানে। তবে রেশন ডিলারশিপ জোগাড় করে ভালই পয়সাকড়ি বানিয়েছেন।
কিন্তু চিপ্পুসের জাসু। দু’আঙুলের ফাঁক দিয়ে একটা পয়সা গলে না।
আমরাও তেমন। কাজে-অকাজে, যাতায়াতের পথে কাশীদার দোকানে একবার ঢুঁ মারা চাই। দোকান ফাঁকা থাকলে সটান পাশের চেয়ারে, কাশীদা, বিড়ি দাও।
রেহাই নেই বুঝে মুখ ভেটকে ড্রয়ার খুলে বিড়ি বার করতেন। ঠোঁটে বিড়ি গুঁজে ছ’ফুটির পরের বাক্য, “দেশলাইটা কি তোমার দাদু দেবে টাকলু?”
বেরো, বেরো শালা, …..
আমাদের হাঃ হাঃ হাঃ হাসিতে চারদিক মাত। চোখ-ফোখ কুঁচকে কাশীদা দেশলাই বার করতে না করতে জগ্গু হাত বাড়াত, “ডিব্বাটা।”
মানে, খৈনির ডিব্বা।
বেজার বদনে লুঙ্গির কোমর-ভাঁজে আটকানো সোনালি রঙের বাহারি পিতলের দু’মুখো ডিব্বা বার করতেন কে পি পাল। ডিব্বার একদিকে খৈনি, অন্য দিকে চুন। “এবার বলবি, দুপুরের ডাল-ভাতটাও খেয়ে যাব, তাই না? হারামের খেতে খুব আরাম! অ্যাঁ?”
ঘর্মাক্ত টাকে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিত ছ’ফুটি, “ডাল-ভাত কেন খাব টাকলুদা। পাবদা মাছ, কালামের খাসি, সোনামুগের ডাল আর সরু গোবিন্দভোগ। তোমার এই গরু খাওয়া চাল-ডাল নয়। বৌদিকে বলে আসছি।”
বেরো, বেরো, বেরো…
হাসতে হাসতে আমরা বেরোতাম। কাশীদার বাড়ি আমাদের পাড়া আর লায়লাদের শিখ মহল্লার বর্ডারে। দু’পাড়ার বাসিন্দাদেরই নয়নের মণি কাশীদা। আমরা বেশি উত্যক্ত করলে লায়লা চোখ পাকাত, “কেন ভাল লোকটাকে ডিস্টার্ব করছিস?” এক হাতে কাশীদার গলা জড়িয়ে অন্য হাতে ভুঁড়িতে তবলা বাজাত সর্দার, “গুরু, একটা পাত্তি ছাড়ো তো আজ। রসগোল্লা খাব, সবাইকে খাওয়াব। পুরা মহল্লা তোমার নাম করবে।”
ফোঁসফোঁস করতে করতে জবাব, “তুই খাওয়া শালা। আমার পয়সা সস্তা পেয়েছিস! রসগোল্লা খাওয়াবে! খাওয়াচ্ছি, দাঁড়া।”
রসগোল্লার উপর কাশীদার দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। সুগারের রোগী বলে বৌদি মিষ্টি ছুঁতে দেন না। অন্য দিকে, কাশীদা খাবেই। পাড়ার পুজোয় কমিউনিটি লাঞ্চে সে এক দৃশ্য। কর্তা-গিন্নি পাশাপাশি বসেছেন। কর্তার সকরুণ মিনতি, “একটা খাই আজ, অ্যাঁ! মায়ের পুজো বলে কথা,না খেলে মা রাগ করবেন।” গিন্নির সরোষ মুখঝামটা, “আহাহাহা। মরে যাই! মা রাগ করবেন! ন্যাকা!” সামনে দাঁড়ানো রসগোল্লা পরিবেশনকারীকে আঙুল তুলে শাসানি, “বেছে বেছে এখানেই তোদের দাঁড়াতে হবে, তা-ই না! সোজা আগে বাঢ়। এমুখো হবি না বলে দিলাম।”
অপসৃয়মাণ মিষ্টিবাহকের দিকে হাত তুলে দাদার আকুল হাহাকার, “আরে অ্যাই তিনু.. ইদিকে আয়, ইদিকে আয়, .. আরে এই তাতা…ধুর, কী যে করো না মাইরি..।”
কাশীদা মানেই ফুল মস্তি। আমাদের ঠাট্টা-তামাশায় যতই রাগ দেখাক, আমাদের ছাড়া আবার এক মুহূর্ত চলবে না। কারও বিপদে-আপদে সবার সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে ঝাঁপাবে। ভলিবল খেলার সময়ে কাশীদার আর এক রূপ। বাঁধা সার্ভিসম্যান। লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে বাঁ হাতে বল ধরে ডেলিভারির ঠিক আগে বাজখাঁই গর্জন, “জ্যায় কাল্লি, ইস্কোওয়াল্লি।” প্রতিটা সার্ভিসের আগে আলাদা আলাদা রণহুঙ্কার, যাতে তামাম কোলবেল্টের যাবতীয় দেবদেবীর প্রবল উপস্থিতি মজুত। কখনও ‘জ্যায় মা করালবদনী’ কখনও “লে কাল্লি, কাল্লাওয়াল্লি’, কখনও ‘জ্যায় কাল্লি, ভিড়িঙ্গিওয়াল্লি,’ কখনও ‘শ্মশানকাল্লি কি জ্যায়,’ কখনও ‘জ্যায় জ্যায় মা ঘাঘরবুড়ি’ কখনও “জ্যায় মা কল্যাণেশ্বরী,’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাইরের কোলিয়ারি টিমের সঙ্গে ভলিবল ম্যাচে গোড়াতেই বিপক্ষের পিলে চমকে দিতে কাশীদার জুড়ি নেই। জ্যায় কাল্লির ঘোর কাটতে না কাটতে অপোনেন্ট কোর্টে আছড়ে পড়ত কেপি পালের তেজালো সার্ভিস।
স্ত্রী আর এক ছেলেকে নিয়ে বেশ ভালই ছিলেন কাশীদা। বৌদিও জাঁদরেল,দাদাকে সারাক্ষণ পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর দাঁড় করিয়ে রাখতেন। জমিয়ে ঝগড়া হতো। দু’পক্ষই আমাদের সালিশি মানতেন। গিন্নির অভিযোগ, “বিড়ি ফুঁকে, খৈনি পিটিয়ে, চুরি করে মিষ্টি সাঁটিয়ে আর আড্ডা মেরে জীবনটা কাটিয়ে দিল! খেটে খেটে আমার হাড়মাস কালি। কোনও দিন কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেল না, একটা সিনেমা পর্যন্ত নয়,ভাবতে পারিস!” কর্তার খেদ, “সংসারের জন্য দিনভর প্রাণ দিয়ে দিচ্ছি, তা-ও এত কথা! চলে যাব শালা, যে দিকে দু’চোখ যায়।”
যেতেন না অবিশ্যি। পরের সকালে ফের রেশন দোকানে তেলচিটে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে নড়বড়ে চেয়ারে আসীন হয়ে গলাবাজি।
“এত মাল্লু কামিয়ে কী করবে বলো তো! কিছু খরচাপাতি করো।”– খোঁচা মারত লোডু-ছ’ফুটিরা। গাঁকগাঁক জবাব, “আমি মাল কামাই না-কামাই, তোদের কী? অ্যাঁ? নিজেরা কাজ করে মাল্লু কামিয়ে বিড়ি খা, আমাকে চাটিস না। রেহাই দে বাপ।”
ছদ্ম কোপে হাত জোড় করতেন কাশীদা। আমরা হাঃ হাঃ হাসতে হাসতে টাকে হাত বুলিয়ে দিতাম।
এমন ক্যারেক্টার এক-আধটা সব পাড়াতেই থাকে,নতুন কিছু নয়। কাশীদা-বৃত্তান্ত ফেঁদে বসার একটা বিশেষ কারণ আছে। কারণ, মামুলি ওই ব্যক্তিই এক দিন ইতিহাসে নাম তু্লে ফেললেন। ‘নিউজ আইটেম’ হয়ে গেলেন!
এক কাকভোরে কি়ডন্যাপড হয়ে গেলেন রেশন ডিলার কে পি পাল।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি ওই সময়টায় বিহারঘেঁষা (তখনও ঝাড়খণ্ডের পত্তন হয়নি) খনি-শিল্পাঞ্চলে অপহরণের ঢল নেমেছিল। কোটিপতি ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বা তাঁদের নিকটাত্মীয়দের পাশাপাশি ছোট-মাঝারি বেশ কিছু ব্যবসায়ীকেও কিডন্যাপাররা টার্গেট করে। আমাদের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু অঙ্কিত সাকুজা ওরফে আক্কুর অপহরণ কাণ্ড তো রীতিমতো হাড়হিম। বিলিওনিয়ার শিল্পপতি-পুত্র আক্কুর মতো আরও এমন অনেকে বিভিন্ন বিহারি কিডন্যাপার গ্যাংয়ের খপ্পরে পড়েছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে যাঁদের কোনও মতেই ‘তেমন বিত্তশালী’ গোত্রে ফেলা যায় না। যার ব্যাখ্যা একটাই– অপহরণের মারকাটারি বাজারে দাঁও মারতে রাতারাতি ‘গ্যাং’ বানিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিল কিছু আনকোরা ছোকরা, যাদের না ছিল অভিজ্ঞতা, না পেশাদারিত্ব।
ফল যা হওয়ার তা-ই।
বেশ কিছু কেসে কিডন্যাপাররা ধরা পড়ে গেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে মুক্তিপণ আদায় করেছে। আর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, কয়েকজন অপহৃতকে মরতে হয়েছে বেঘোরে, পেশাদার গ্যাং হলে যা হয়তো এড়ানো যেত। পুলিশকর্তাদের অভিমত, অপহৃত ও তাঁর পরিবার যেমন মানসিক চাপে থাকে, ‘কেস সেটলড’ না হওয়া পর্যন্ত অপহরণকারীদের উপরও প্রেশার কম থাকে না। পোড় খাওয়া প্রফেশনাল ক্রিমিন্যালরা সে চাপটা সামলাতে পারে। কিন্তু টেনশনের চূড়ান্ত মুহূর্তে নভিসরা মনোবল ধরে রাখতে পারে না, তাদের নার্ভ ফেল করে।
পরিণাম– অনর্থক খুনখারাপি।
আমাদের কাশীদাও তেমন এক দলের শিকার সন্দেহ নেই। ঘটনার সময় আমি শহরে ছিলাম না,চাকরিসূত্রে কলকাতার বাসিন্দা, এবং সেই সূত্রেই রাজ্যের বাইরে থাকতে হয়েছিল টানা কয়েক দিন। চাকরিসূত্রে তখন ছ’ফুটি, জাম্বো, ভুপি, জগ্গু, মিতলা, বাপি.. অনেকেই বাইরে। কয়েকটা বড় ‘অপারেশন’-এর জেরে কোলমাফিয়া লায়লা-মনোহরও সাময়িক ভাবে গা ঢাকা দিয়েছে।পরে লোডু, পিঙ্কু, বেলচাট, বাবুয়া পাণ্ডেদের মুখে সব শুনেছি।
সুগার কন্ট্রোলে রাখতে কাশীদা খুব সকালে উঠে হাঁটতে বেরোতেন। পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সফর। সেই গ্রীষ্মের সকালেও বেরিয়েছিলেন। হাইওয়ের মুখে ওঁত পেতে ছিল লাল রঙের মারুতি ভ্যান। স্লাইডিং ডোর খুলে দু’টি ছেলে নেমে কাশীদার মাথায় পিস্তল সাঁটিয়ে নিমেষে গাড়ির পেটে পুরে নেয়। অত ভোরে খুব একটা লোকজন রাস্তায় ছিল না, শুধু সব্জিওয়ালা গণেশ সাইকেল চড়ে বাজারে যাওয়ার সময় দেখে ফেলেছিল। পাঁইপাঁই সাইকেল চালিয়ে কাশীদার বাড়িতে এসে খবর দেয়, তারপর পাড়ার লোকজনকে।
সকাল ছ’টার মধ্যে কাশীদার বাড়ি ভিড়ে ভিড়াক্কার।
প্রতীক্ষিত ফোনটা আসে সাতটা নাগাদ। সাড়ে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ। বৌদিকে বলা হয়, পুলিশে খবর দিলে স্বামীকে ফেরত মিলবে না।
এখন শুনতে হাস্যকর লাগলেও আড়াই দশক আগে সাড়ে তিন লাখ খুব একটা কম ছিল না। ফোন নামিয়ে কাশীবৌদির প্রথম প্রতিক্রিয়া, “টাকা গাছে ফলে নাকি! বললেই হল! সাড়ে তিইইইন লাআআখ! আমরা খাব কী?”
“মাইরি, যেমন দ্যাবা, তেমন দেবী!”–পরে বলেছিল লোডু, “দুই কিপ্টেতে মিলেছে ভাল।”
তা বৌদি কিডন্যাপারদের হুকুম অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন,পুলিশে খবর দেননি। সারা তল্লাট রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ায় পুলিশ বাড়িতে এসেছিল। অফিসারদের সামনে মাথা চাপড়ে, মুখে আঁচল চেপে, ফুঁপোতে ফুঁপোতে বৌদি কেঁদেছেন, “যা কপালে আছে হবে স্যার। দেখুন, আপনারা যদি কিছু করতে পারেন। আমি কিন্তু কিছু করতে বলছি না।”
হাজার অনুরোধেও রিটন কমপ্লেন্ট দেননি। স্বামীকে ছাড়াতে মুক্তিপণ মেটাবেন কিনা জানতে চেয়েছিল পুলিশ। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বৌদির জবাব, “এই তো সংসারের হাল স্যার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ভগবান যা করবেন…”
অর্থাৎ, ঝেড়ে কাশেননি।
কাশীদার ছেলেও তালেবর, তখন বোধহয় কলেজে সেকেন্ড ইয়ার। পরদিন থেকে জিনসের উপর কলারতোলা পাঞ্জাবি পরে, ঘাড়ে-গলায় সেন্টের ছিটে মেরে, চোখে সানগ্লাস সেঁটে রেশন দোকানে বাবার চেয়ারে বসে পড়ল। খদ্দেরদের প্রশ্নবাণের সামনে তারও মুখে চরম বৈরাগ্যভাব, “উপরওয়ালা যা করবেন..”
মানেটা কী?
পাড়াশুদ্ধ লোকের উৎকণ্ঠার শেষ নেই। লোডু-সমু-পিঙ্কুরা বডি ফেলে দিয়েছে কাশীদার বাড়িতে। কিডন্যাপারদের ফোন আসছে সকাল-বিকেল। তখন আমগেরস্তের ল্যান্ডফোনে সিএলআই জমানা বহু দূর,কোথা থেকে ফোন আসছে, বোঝার যো নেই। পুলিশ ট্রেস করছে কিনা, কে জানে! তবে সব ফোন তুলেই কাশীবৌদির এক রা, “সাড়ে তিইইইইন লাআআখ! আমরা খাব কী?”
কী করছেন বৌদি!
লোডুদের আর্তনাদ শুনে বৌদি ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “টাকা মাগনা আসে নাকি রে, অ্যাঁ? ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে না?”
কিন্তু দাদার যদি কিছু ভালমন্দ হয়ে যায়?
উদাসী বাতাসে স্বর্গীয় নির্লিপ্তির ভেলা ভাসিয়ে দেন কাশীবৌদি, “কী আর করব বল! কপালের লিখন কে খণ্ডাবে!” পরক্ষণে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন,“কে ওকে ওই সাতসকালে বেড়াতে যেতে বলেছিল? তবে জেনে রাখ, ওই বুড়োকে জিম্মা রাখা অত সহজ নয়। যে সে পারবে না। আমি বলেই এত দিন পেরেছি।”
যাঃ শালা!
লোডু-বেলু-পিঙ্কুরা পুরো ঘেঁটে ঘ। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এ দিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দু’দিন গেল, তিন দিন গেল, চার দিন, পাঁচ দিন, ছ’দিন…
কাশীদা অপহরণের সপ্তাহ ঘুরতে চলল। বৌদি-ছেলের ভাবান্তর নেই। কিডন্যাপাররা ফোন করে করে হল্লাক। সাড়ে তিন লাখ এখন পঞ্চাশ হাজারে নেমেছে। কিন্তু বৌদির সুর পাল্টায়নি, “পঞ্চাআআআশ হাজার! মানে আআআধা লাআআআখ! খাব কী বাবা!”
লোডুরা স্তম্ভিত বিস্ময়ে বাক্যালাপ শোনে। এক রবিবার সকালে যথারীতি ফোন বেজেছে। বৌদি সব্জি কাটছিলেন,ছেলেকে হাঁক পাড়লেন, “আবার বোধহয় আপদগুলো! দ্যাখ তো বাবু, কী বলছে!”
ছেলে রিসিভার তুলতেই ওপার থেকে অগ্নিবর্ষণ, ‘শালে নালায়েক, হারামি, বেশরম! কুছ তো খয়াল কর আপনে বাপকে বারে মে! বুঢ্ঢে রসগুলা আউর বিড়ি খৈনি মাঙ্গ মাঙ্গকে হমলোগোঁকো পুরা ফকির বনা দিয়ে রে! ছুড়াকে লে যা ভাই, ছুটকারা দিলা দে ইস মুসিবতসে।”
কাশীবৌদি শুনে হাঁউমাউ করে উঠলেন, “দ্যাখ, দ্যাখ, মিনসের কাণ্ড দ্যাখ। ওখানে গিয়েও রসগোল্লা! এত লোভ বুড়োর! একটু চোখের আড়াল হয়েছে কি ওমনি ন্যাজ গজিয়েছে! স্বভাব যাবে কোথায়, অ্যাঁ? আসুক বাড়ি।”
এই অব্দি শুনে লোডুরা হাল ছাড়ে।
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বৌদিই ওদের জানিয়েছেন। দেড় হপ্তার মাথায় মুক্তিপণের অঙ্ক নামতে নামতে পাঁচ হাজার। শুনে বৌদি একই ভাবে ‘পাঁআআআচ হাআআআজাআআর! খাব কী?’ ইত্যাদি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করায় ওপার থেকে অস্থির কণ্ঠ ফুঁসে উঠেছিল, “শালী, তু লোগ ক্যা খাতেই যা রহে চওবিশ ঘণ্টে! খাব কী, খাব কী! মরদ কে লিয়ে কোই চিন্তা নহি, ক্যায়সন আওরত হ্যায় রে তু!”
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাশীবৌদির উত্তর, “কী করব বাবা,যা কপালে আছে হবে। তোমরা নিশ্চয় ওর খেয়াল রাখবে, তাই না বাবা?”
অস্ফূট খিস্তি করে ফোন কেটে গিয়েছে।
এক রবিবার বাদ দিয়ে পরের রবিবার, মানে অপহরণের ঠিক চোদ্দো দিনের মাথায় ফের ফোন ধরেছিল কাশীদার ছেলে। কিডন্যাপার গ্যাংয়ের পান্ডার গলা সে দিন নেহাতই মিনমিনে, বিমর্ষ, নেতানো লাউডগাটির মতো, “লে ভাই, আপনি বাপকো লে কে যা। এক হাজার রুপাইয়া দে দে না, বাস।” বৌদি ‘এএএক হাআআআজার! খাব কী!’ বলার আগেই ও প্রান্তের আকুল আকুতি, “মাম্মিকো বোল, ভগওয়ানকে লিয়ে হাজার রুপাইয়াকো খানা ছোড় দে। ভগওয়ানকে লিয়ে।”
বৌদি অবশ্য দমেননি। ছেলের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে খরখরিয়ে ওঠেন, “হাজার টাকা মাগনা আসে নাকি বাবা! বললেই হল!”
— দেবীজি, কিরপা করো। উনহে খিলানে-পিলানে-পহেনানে বহোত নিকল গ্যয়ে। রসগুলা, বিড়ি, খৈনি, নয়া লুঙ্গি, কামিজ। উপ্পরসে গাড়িকা ভাড়া, পেট্রোল। ইনভেস্টমেন্ট কস্টকা টেন পার্সেন্ট তো উঠানে দো মেরি মাতাশ্রী।”
কাশীবৌদি গলেননি। পাঁচশো হাঁকেন। প্রচুর ঝোলাঝুলি, কাকুতি-মিনতি, টানাপোড়েন শেষে সাতশোয় রফা হয়। ঠিক হয়, সোমবার সকাল ছ’টায় বরাকরে, ব্রিজের ঠিক নীচে নদীর চরে ওরা কাশীদাকে ফেরত দিয়ে যাবে। ওখানেই টাকা হ্যান্ডওভার হবে।
সেইমতো কাশীদার ছেলে আর লোডু গিয়েছিল কাশীদার খটরা স্কুটারে চড়ে। নাটকের এন্ডিংটা লোডুর মুখে যেমন শুনেছি, তেমন লিখছি।
গিয়ে দেখি, তিনটে ছেলে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। কাশীদা আরামসে বসা বালির উপর। নতুন লুঙ্গি, নতুন পাঞ্জাবি। আবার সিগারেট টানছে! বিড়ি নয়। মনে হল, তোফা আছে। লোক তিনটে আমাদের দেখে এমন ভাবে দৌড়ে এল, যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে! দেড়েল পান্ডাটা কাশীদার ছেলের দিকে এক হাত বাড়িয়ে অন্য হাত কাশীদার দিকে তুলে বলল, “লে যা বাপ, লে যা। রুপাইয়া দে।”
মাইরি, কাশীর ব্যাটা কী করল জানিস? পাঁচটা একশোর নোট ধরিয়ে তারপর একটা পঞ্চাশ দিল। শেষে চারটে নোংরা দশের নোট। মানে, টোটাল পাঁচশো নব্বই। “মা বলে দিয়েছে, এর বেশি হবে না। আমরা খাব কী?”
কিডন্যাপাররা অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল ওর মুখের দিকে। লোডুও। শেষে পান্ডা দু’চোখ বুজে মাথা নাড়ে, “গোড় লাগুঁ তেরে মাম্মিকি চরনোঁমে। লে যা ভাই। না জানে কউনসি অশুভ ঘড়িমে হমারে নজর পড়েথে উস আফৎকে উপ্পর! শালে, ইস দোনো হপ্তেমে জিনা পুরা হরাম কর দিয়া! লে যা, লে যা..”
কাশীদা ততক্ষণে হেলতে-দুলতে উঠে এসেছেন, “সব ভাল আছিস তো! চ।”
লোডুরা ওঁকে নিয়ে উল্টো রাস্তায় হাঁটা লাগিয়েছে কি লাগায়নি, কাশীদা থমকে গিয়েছেন, “আরে দাঁড়া, দাঁড়া, একটু দাঁড়া। আরে এ গোবিনদ, জরা ঠ্যার যা না ভাই।”
কিডন্যাপার পান্ডার নাম ধরে হাত নেড়ে ডাকলেন,যেন কত দিনের পরমাত্মীয়!
গোবিন্দ নামধারী দাড়িওয়ালা যুবকটি ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কাশীদাই হনহনিয়ে ওর সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়েছেন, “থোড়ে খৈনি তো খিলাকে যা ইয়ার। আখরিবার।”
প্রথমে হতভম্ব। তারপর জ্বলন্ত চোখে ঠাটিয়ে চড়। দু’সপ্তাহের জমানো আক্রোশ বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় হয়ে ফেটে পড়ল কাশীদার ফর্সা গালে, “ফির! ফির! দো হপ্তেভর হরবখত রসগুলা দে, খৈনি খিলা, সিগ্রেট পিলা.. শালে হারামখোর.. হরামকা খানে-পিনেমে বহোত মজা! আঁ? নিকল শালে। নিকললল!ব্যাহেন**, তু অভভি নিকল মেরি নজরোঁ সে…”
দুর্দম ক্রোধে উন্মত্তের মতো চরের বালি তুলে কাশীদার গায়ে ছিটাতে থাকে কিডন্যাপার।