পর্ব ১৩
(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)
সৃষ্টির সূচনায় নারী পুরুষের আলাদা করে কোন কর্ম বিভাজন ছিল না। সবাইকে শিকার করে বা গাছ থেকে ফল পেড়ে বা গাছের তলার ফল কুড়িয়ে খেতে হতো। তার ওপর সে সময় কৌমগুলি ছিল নারীকেন্দ্রিক। আজও যেমন মৌমাছি বা পিঁপড়ের সংঘবদ্ধ জীবনে আছে। তাই নারীরাই পুরুষদের পরিচালনা করতো পুরুষদের খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে। কারণ সন্তান প্রসবকালে নারীরা সাময়িক ভাবে শিকারে যেতে পারতেন না, তখন পুরুষরা নারীদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করাটা তাদের দায়িত্ব বলে মনে করতো, দায় বা দয়া হিসাবে দেখতো না।
কিন্তু যখন কৃষিকাজ শুরু হল, তখন থেকে শ্রম বিভাজনটা স্পষ্ট হয়ে গেল। কারণ শিকারের মাংস কাঁচা খেয়ে নিলে বা পুড়িয়ে নিলেই চলত। ফল সরাসরি আহার করা যায়। কিন্তু চাষের ফসল আহার্যে রূপান্তরিত করতে মেয়েদের ভূমিকা নিতে হলো। ফলে ঘরের বাইরের কাজ ছেলেদের, ঘরের ভিতরের কাজ মেয়েদের, এই কর্ম বিভাজনটা প্রকট হয়ে উঠল। যখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠল তখন পুরুষ বাধ্য করল নারীকে গৃহে অন্তরীণ থাকতে।
ইতিহাসের পথ ধরে চললে প্রথমেই বলতে হয় বৈদিক যুগের কথা। বৈদিক যুগে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে যজ্ঞ করতেন, বিদ্যাভ্যাস করতেন, জ্ঞানচর্চায় ও বিতর্কসভায় অংশগ্রহণ করতেন। তাই বৈদিক যুগের নারীরা বাগ্মিতায় পারদর্শী ছিলেন। শুধু জ্ঞানচর্চা নয়, যুদ্ধেও তারা অংশগ্রহণ করতেন। ঋকবেদে বধ্রিমতী ও বিস্পলা নামে দুই নারী যোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। ঋকবেদে শশীয়সী নামে বীর আর্যনারীর নাম পাওয়া যায়। পুরাণের যুগে মুদগল যখন রাজা ছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী মুদগলনী স্বামীর রথের সারথি ছিলেন। তবে এইসব নারীরা এগুলি পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন না ভাললাগা থেকে করতেন বলা মুশকিল।
বৈদিক যুগের পর স্মৃতির যুগে মনু এসে স্ত্রী জাতির কর্ম ও কর্তব্য নির্ধারণ করে দিলেন- “সন্তান উৎপাদন, সন্তানের প্রতিপালন, অতিথি সৎকার এবং অন্যান্য সংসারিক কাজ সুষ্ঠ ভাবে সম্পাদনের মাধ্যমেই স্ত্রী জাতির জীবন সার্থক হয়।” এগুলি অবশ্যই কাজ। কিন্তু পেশা নয় অর্থাৎ এর মাধ্যমে কোনও অর্থ উপার্জন হয় না বা নিজের জীবনযাপন স্বাধীন ভাবে করা যায় না।
উত্তর ভারতের গোবলয়ে মহিলারা গোপালন ও দুগ্ধ ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ভাগবত পুরাণের রাধার সখী ও কৃষ্ণের গোপীরা ছিল এই গোষ্ঠীর মহিলা। বাংলার চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তাদের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য নিয়ে মথুরার হাটে বিক্রি করতে যাওয়ার কথা আছে। যদিও এগুলি ছিল সব পারিবারিক পেশা।
গৃহকর্ম সেরে পারিবারিক পেশায় সাহায্য করা এই পর্যন্তই ছিল নারীদের কর্মের জগৎ। তাই জীমূতবাহন (দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতক) বলেছিলেন, নারীরা প্রয়োজন হলে সূতা কাটিয়া তাঁত বুনিয়া অথবা অন্য কোনও শিল্পকর্ম করিয়া স্বামীদের উপার্জনে সাহায্য করিতেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন কাঁথা সেলাই, আলপনা দেওয়া, পিঁড়ি চিত্র ও দেওয়াল চিত্র অঙ্কন এগুলি গুপ্তযুগ থেকে চলে আসছে। তবে চরকা কেটে সুতো বার করা রাজার মহিষী থেকে দীনের কুটিরের গৃহিনী সবাইকেই করতে হতো। পুরুষেরা সাধারণত চরকা কাটতেন না, তারা শুধু সুতো দিয়ে বস্ত্র বয়ন করতেন।
পারিবারিক জীবিকা বলে মহিলাদের কাজের আলাদা করে কোন মূল্যায়ন হতো না। তবে দুটি ক্ষেত্রে তাদের মূল্যায়ন হতো। সে গুলো হলো বৈদ্যর ব্যবসা ও বিদ্যাদান ব্যবসা। বৈদ্য পরিবারের মেয়েরা পারিবারিক সূত্রে চিকিৎসা বিদ্যা শিখে নিতেন। তারা স্বাধীন ভাবে না হলে স্বতন্ত্র ভাবে চিকিৎসা করতেন। বিদ্যাদানের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। পিতা বা ভ্রাতাদের কাছ থেকে বিদ্যার্জন করে পারিবারিক টোলে বা স্বতন্ত্র বিদ্যালয় খুলে পড়াতেন। উনবিংশ শতাব্দীতে এই ধারার প্রচলন ছিল।
বর্ধমানের সোঞাই গ্রামে হটি বিদ্যালঙ্কার (১৮/১৯ শতক) বলে এক কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যা ছিলেন। কুলীন কন্যা হওয়ার দরুণ বিবাহের পর পিতৃ গৃহেই থাকতেন; পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও কাব্যাদি শাস্ত্রে পারঙ্গম হন। পিতার মৃত্যুর পর কাশীতে গিয়ে চতুষ্পাঠী খুলে অধ্যাপনা শুরু করেন। আনুমানিক ১৮১০ সালে তিনি মারা যান। কাশীর পন্ডিত সমাজ তাঁকে বিদ্যালঙ্কার উপাধি দেন। আরেক বিদুষী মহিলা দ্রবময়ী দেবী, জন্ম ১৮৩৭ সালে খানাকুল কৃষ্ণনগর সংলগ্ন বেড়াবেড়ি গ্রামে। তিনি ছিলেন বাল্য বিধবা। পিতা ছিলেন চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কার। পিতার টোলে পড়ে, সেখানেই তিনি পড়াতেন।
ফরিদপুরের জবসা গ্রামের আনন্দময়ী দেবী (১৭৫২-১৭৭২) ছিলেন বেদজ্ঞ। তিনি রাজা রাজবল্লভের যজ্ঞকুন্ডের ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। তার খুল্লতাত জয়নারায়ণ সেনের ‘হরিলীলা'য় কয়েকটি পদ লিখে দিয়েছিলেন। আনন্দময়ী দেবীর আত্মীয়া গঙ্গামনি দেবী 'হরিলীলা' পুথি নকল অর্থাৎ লিপি করেছিলেন। পুথি নকল অর্থাৎ অনুলিপি করে দিলে পারিশ্রমিক পাওয়া যেত। এনারা পয়সা পেয়েছিলেন কিনা বলা মুশকিল।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেল, মেয়েদের জন্য কর্মজগৎ কোনওদিন প্রশস্ত ছিল না। বর্তমানেও সেই জগৎ খুব একটা বিস্তৃত হয়নি। নারীদের সঙ্কুচিত কর্মজগত নারীপাচারের জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে।
তথ্য ঋণ:
১. প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য
২. মনুসংহিতা- সম্পাদনা ও ভাষান্তর- চৈতালী দত্ত- নবপত্র প্রকাশন।
৩. বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব) – নীহাররঞ্জন রায়।
৪. নারী – হুমায়ুন আজাদ (আগামী প্রকাশনী, বাংলাদেশ)।
৫. নারী চরিতাভিধান– সম্পাদনা: জীবন সাহা, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া।