পর্ব – ২৮
(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)
প্রাক আর্য যুগের কোনো লেখ্য ইতিহাস নেই। তাই কোনও সাহিত্যও নেই। প্রথম ভারতীয় সাহিত্য বলতে বোঝায় 'ঋক বেদ'কে। ঋগ্বেদে নারীর ইচ্ছাক্রমে বা অনিচ্ছাক্রমে হরণের কথা আছে। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলে আছে, পুরুমিত্রের কন্যাকে বিমদ হরণ করেছিলেন। আর সপ্তম মণ্ডলে আছে, কোন এক পুরুষ রাতে নারীকে হরণ করতে যাবে; তাই সে প্রার্থনা করছে, "তোমার মাতা নিদ্রা যান, তোমার পিতা নিদ্রা যান। কুকুর নিদ্রা যাক, গৃহস্বামী নিদ্রা যাক, বন্ধুগণ নিদ্রা যাক। চতুর্দিকবর্তী জনগণও নিদ্রা যাক।"
এরপর আমরা সাহিত্যে সবচেয়ে বড় অপহরণের উল্লেখ পাই রামায়ণে—সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিল রাবণ। পরবর্তীকালে হরিবংশে পাই, প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরক ১৬ হাজার কন্যাকে হরণ করে প্রাসাদে আটক রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, নরক একবার হাতির রূপ ধরে বিশ্বকর্মার কন্যাকে অপহরণ করে সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ পরে এই নরকাসুরকে বধ করেছিলেন।
পুরাণ যুগের পর স্মৃতির যুগ। সে যুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হলো মনুসংহিতা। মনুসংহিতায় আট প্রকার বিবাহ প্রচলনের কথা আছে – ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ, প্রজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। মৌর্য যুগে লিখিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও এই আট প্রকার বিয়ের কথা বলা আছে। শেষ দু’টি বিবাহ অপহরণের নামান্তর। হরিবংশে কথিত শ্রীকৃষ্ণ তার প্রথমা স্ত্রী রুক্মিণীকে বিবাহ করেছিলেন হরণ করে, যার জন্য তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। এতে অবশ্য রুক্মিণীর মত ছিল। মহাভারতে আছে, শ্রীকৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে হরণ করেছিল অর্জুন, তাতে সুভদ্রার মত ছিল না, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের মত ছিল। এগুলি সব রাক্ষস বিবাহের উদাহরণ।
প্রাচীন সাহিত্যে আমরা নগরনটী বা নগরবধুর উল্লেখ পায়। সে যুগে সর্বশ্রেষ্ঠ নগরনটী ছিলেন আম্রপালী। তাঁর সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এই জন্য তার কথা বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রগুলিতে আছে। চীনা পর্যটকদের কাহিনীতে, ত্রিপিটকের চৈনিক সংস্করণে এবং কাশ্মীরের গিলগিট অঞ্চলে প্রাপ্ত 'গিলগিট পাণ্ডুলিপি'তে সবিস্তার জানা যায়। আম্রপালী একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। আম্রপালী ছিলেন বৈশালী নগরের বিখ্যাত গণিকা। তাকে মহানাম নামে এক শ্রেষ্ঠী কুড়িয়ে পান আমবাগানে। বৈশালীর প্রচলিত নিয়ম অনুসারে অনিন্দ্যসুন্দরী আম্রপালী কে হতে হয়েছিল নগরনর্তকী। সে সময় মগধের রাজা ছিলেন হর্যঙ্ক বংশের বিম্বিসার (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক)। তিনি বৈশালী রাজ্য অধিকার করেছিলেন। বিম্বিসারের সঙ্গে আম্রপালী সম্পর্ক নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে।
আরেক বিখ্যাত বারাঙ্গনার নাম পাওয়া যায়; বসন্তসেনা। তিনি ছিলেন শূদ্রক রচিত সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিক-এর নায়িকা। মৃচ্ছকটিক আজ থেকে কম করে দেড় হাজার বছর আগে লিখিত, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাটকগুলির মধ্যে একটি। বসন্তসেনার সঙ্গে দরিদ্র ব্রাহ্মণ চারুদত্তের প্রণয় কাহিনী নাটকের মুখ্য বিষয়। চারদিনের ঘটনাক্রমে বসন্তসেনা কিভাবে গণিকা হলেন, সে বিষয়ে নাটক থেকে কিছু জানা যায় না। সে যুগে গণিকাদের সমাজে উচ্চ স্থান ছিল। তাদের এই পেশায় আসার জন্য কোন বল প্রয়োগ ছিল কিনা, সে বিষয়ে সে যুগের সাহিত্য থেকে কিছু জানা যায় না। সে যুগের সাহিত্যে দাস-দাসীর প্রভূত উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতীয় তথা বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থায় দাসপ্রথা স্বাভাবিক ছিল। তাই তাদের সুখ-দুঃখের কথা সেভাবে কোন সাহিত্যে স্থান পায়নি।
বানভট্টের লেখা হর্ষচরিতে আছে গৌড় অধিপতি শশাঙ্ক কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে হত্যা করে গ্রহবর্মার স্ত্রী রাজশ্রীকে বন্দিনী করেন। ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধ মানেই নারী হরণ। তারপর তাদের জোর করে পত্নী হিসেবে গ্রহণ বা ক্রীতদাসী হিসেবে নিয়োগ। এগুলো সবই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল তাই নারী হরণ বা নারীর যৌন স্বাধীনতা খর্ব করার বিষয়গুলি সেকালের সাহিত্য সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। এই পরম্পরা আধুনিক যুগের সাহিত্যে প্রথম দিক পর্যন্ত ছিল। গণিকা, বেশ্যা, বারবনিতা প্রভৃতির উল্লেখ থাকলেও তাদের অন্ধকার দিক, অর্থাৎ তারা কীভাবে এই পেশায় এলেন, বা কেন তারা আসতে বাধ্য হলেন, সে বিষয়ে রচনাকারগণ ছিলেন উদাসীন।
সে দিক থেকে প্রথম সার্থক নারীপাচার বিষয় সাহিত্য বলা যেতে পারে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত 'শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত'; লেখক মানদা দেবী। তিনি কীভাবে তার দূর সম্পর্কের দাদার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলেন এবং শেষে পতিতাবৃত্তি অবলম্বন করেছিলেন, সেই আত্মকথা শুনিয়েছেন। এর আগেই মানদা দেবীর মতো অনেকে আত্মজীবনী লিখেছেন। সেখানে তাদের সুখ-দুঃখ, আক্ষেপ-অনুতাপ ব্যক্ত করেছেন। যেমন নটী বিনোদিনীর 'আমার অভিনেত্রী জীবন' (১৯১০), তিনকড়ি দাসীর 'আমার জীবন' (১৯১০)। তাঁরা অভিনয় জগতে ভীষণ সুনাম অর্জন করেছিলেন।
এযুগেও লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিকরা নারীপাচার নিয়ে সেভাবে সরব হননি। তাদের রচনায় দেহপসারিণীদের চরিত্র আছে বটে, কিন্তু তারা কীভাবে পাচার হয়ে এ পথে এলেন সে নিয়ে বিস্তৃত লেখা খুব কম আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিচারক গল্পে (প্রথম প্রকাশ সাধনা পত্রিকায়, পৌষ ১৩০১ বঙ্গাব্দ) ক্ষীরোদা নামে দেহপসারিনীর চরিত্র এঁকেছেন। তাকে তার প্রণয়ী ঠকিয়ে সব অর্থ, অলংকার নিয়ে পালিয়ে যায়। তখন ক্ষীরোদা তার দুধের শিশুপুত্রকে নিয়ে কুয়োতে ঝাঁপ দেয়। তিনি বেঁচে গেলেও শিশু পুত্রের মৃত্যু হয়; আর শিশু পুত্রের মৃত্যুর জন্য তার মৃত্যুদণ্ড হয়।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনায় কয়েকটি বাঈজি চরিত্র আছে। 'আঁধারে আলো' গল্পে বিজলী (ভারতবর্ষ পত্রিকা, ভাদ্র ১৩২১), শ্রীকান্ত প্রথম পর্বের পিয়ারী (ভারতবর্ষ, ১৩২২ - ২৩) এবং 'দেবদাস'-এর চন্দ্রমুখী (ভারতবর্ষ, ১৩২৩ চৈত্র)। পিয়ারী প্রথম জীবনে শ্রীকান্তের খেলার সঙ্গী ছিলেন। তখন নাম ছিল রাজলক্ষ্মী। ভাগ্যচক্রে তাকে বাঈজির পেশা নিতে হয়। দেবদাস শরৎচন্দ্রের বাল্য রচনা, প্রকাশিত হয় পরে। দেবদাসের চন্দ্রমুখী সারা ভারতের এক জনপ্রিয় চরিত্র। রাজলক্ষ্মী থেকে পিয়ারী হয়ে ওঠা এটা ছাড়া অন্যত্র নারী পাচারের কোন ইঙ্গিত নেই।
মাঘ ১৩৫০ থেকে মাঘ ১৩৫২ পর্যন্ত মাতৃভূমি পত্রিকায় ধারাবাহিক বেরিয়েছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’। ১৩৫০ (১৯৪৩-১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসে কাপালিদের ছোট বউ ছুটকি কিভাবে ক্ষুধার তাড়নায় নিজের দেহ বিক্রি করে চাল সংগ্রহ করত; তার বর্ণনা আছে। শেষে আড়িকাঠির সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়; কিন্তু উপন্যাসের নায়িকা অনঙ্গ বউয়ের অনুরোধে সে সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকে। মন্বন্তর সবচেয়ে আগে পণ্য করে নারীকে, তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ এটি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়' উপন্যাস প্রথম খণ্ড এপ্রিল ১৯৮১ এবং দ্বিতীয় খণ্ড এপ্রিল ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়। তার আগে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল 'সেই সময়'। এর প্রথম খণ্ডে আছে বিধবা বিন্দুবাসিনী ও গঙ্গানারায়ণ সম্পর্কের কথা। বিন্দুবাসিনী নিরুদ্দেশ হয়। পরে বারাণসীতে বিন্দুবাসীর সঙ্গে আবার গঙ্গানারায়ণের দেখা এবং শেষে দুজনের গঙ্গার জলে ঝাঁপ। সেযুগে বিধবাদের নির্বাসন হতো বৃন্দাবনে বা বেনারসে। রূপ যৌবন সম্পন্ন বিধবাদের ওখানকার ভূস্বামী বা প্রভাবশালীদের রক্ষিতা হতে হতো। এটা তারই বাস্তব চিত্রাঙ্কন।
বলা হয় সাহিত্য সমাজের প্রতিচ্ছবি। সমাজের ভালো-মন্দ, সমাজের মানুষের চাওয়া-পাওয়া, আশা-নিরাশা প্রকাশিত হয় সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে। অথচ নারীপাচার নিয়ে বা পাচার হওয়া নারীদের অসহায়তা, বিপন্নতা সেভাবে সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়নি। কিন্তু নারী জীবনের জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়ে প্রচুর কাগজ, কালি খরচ হয়েছে। নারী পাচার হওয়ার পর, রূপান্তরিত হওয়া গণিকা, পতিতা ও বাঈজিদের অনেক কাহিনী আছে। কিন্তু তাদের হাহাকার, এ পথে আসার জন্য সমাজের প্ররোচনা নিয়ে সাহিত্য নিশ্চুপ। নাটক বা চলচ্চিত্রে নারী প্রধান চরিত্র করতে গিয়ে বা রূপোপজীবিনীদের দেখাতে গিয়ে পুরুষ বিনোদনের 'পালা' তৈরি হয়েছে। তাই আমাদের প্রথাগত সাহিত্য নারীপাচার রোধে সেরকম সচেতনতা গড়ে তোলেনি; যা নারীপাচারে সহায়ক হয়েছে।
তথ্য ঋণ:
১. ঋকবেদ সংগীতা (দ্বিতীয় খন্ড): রমেশ চন্দ্র দত্ত অনুদিত (হরফ প্রকাশনী)
২. মনুসংহিতা: সম্পাদনা ও ভাষান্তর- চৈতালী দত্ত (নবপত্র প্রকাশন)।
৩. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র: সংক্ষিপ্ত অনুবাদ – সুকুমার শিকদার (অনুষ্টুপ)
৪. প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য (আনন্দ পাবলিশার্স)
৫. পৌরা
ণিক অভিধান – সুধীরচন্দ্র সরকার (এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড)
৬. শূদ্রক বিরচিত মৃচ্ছকটিক: অনুবাদ – সুকুমারী ভট্টাচার্য (সাহিত্য অকাদেমি)
৭. মানদা দেবী ও রমেশদা’র চাপান উতোর: সংকলক – সুবীর ভট্টাচার্য (করুণা প্রকাশনী)
৮. গণিকা দর্শন – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (আরোহী প্রকাশনী)