-পর্ব ৩

আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।

            নারীর সামাজিক অবস্থান নারীকে পণ্যে পরিণত করেছে। এমনকি, স্বয়ং পিতা তার কন্যাকে পণ্য হিসাবে বিবেচনা করেছে। মহাভারতে যযাতি তাঁর কন্যা মাধবীকে আটশত অশ্বের পরিবর্তে ‘গালব’কে দান করেন। গালব ছিলেন বিশ্বামিত্র মুনির শিষ্য। বিশ্বামিত্র গুরুদক্ষিণা বাবদ আটশত অশ্ব গালবের কাছে চান, যাদের বর্ণ হবে চন্দ্রের মতো শুভ্র এবং তাদের একটি কর্ণ হবে শ্যামবর্ণ। গালব এতগুলি ঘোড়া যযাতির কাছে প্রার্থনা করলে, যযাতি বলেন, “আমার কাছে এখন অত ধন নেই, যা দিয়ে আমি তোমাকে এতগুলি ঘোড়া কিনে দেবো। তাই আমি তোমাকে আমার কন্যা দান করছি। এই কন্যাকে অন্যান্য রাজাদের কাছে নিয়ে গিয়ে সমর্পণ করলে কন্যার শুল্ক বাবদ তাঁরা ঘোড়া দেবেন।”

 তারপরের গল্প সবার জানা; গালব মাধবীকে অযোধ্যার রাজা হর্যশ্ব, কাশীরাজ দিবোদাস ও ভোজরাজ উশীনরের কাছে নিয়ে যান। মোট ছয়শত অশ্ব লাভ হয়। তার বিনিময়ে হর্যশ্ব বসুমনা, দিবোদাস প্রতর্দন ও উশীনর শিবি নামে পুত্রদের লাভ করেন। তারপর গালব ছ’শো ঘোড়া এবং দুশো ঘোড়ার পরিবর্তে মাধবীকে বিশ্বামিত্রের কাছে নিবেদন করেন। বিশ্বামিত্রের ঔরসে মাধবীর গর্ভে অস্টক নামে এক পুত্র হয়। অবশেষে গালব মাধবীকে যযাতির কাছে প্রত্যর্পণ করেন। যযাতি মাধবীর স্বয়ংবর সভা আয়োজন করলে, মাধবী সকল রাজাকে প্রত্যাখ্যান করে বনবাসে গিয়ে ধর্ম পালন করতে থাকেন।

পিতা মাতা নানা কারণে তাদের কন্যাসন্তানকে বিক্রি করেছেন বা এখনও করছেন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাবো দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে যখন পিতা মাতা সন্তানদের ভরণ পোষণ করতে পারছেন না, তখন প্রথমে তাদের কন্যাসন্তানকে বিক্রি করছেন। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ) বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘আনন্দমঠ’-এ লিখেছেন- ‘গোরু বেচিল, লাঙল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল, তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল, তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল’।

           অনেক মা-বাবা অভাবের জ্বালায় নিজের কন্যাকে মন্দিরে দেবদাসী করে পাঠাতো। বঙ্গদেশেও দেবদাসী প্রথা ছিল। সিলেট থেকে প্রাপ্ত পুন্ড্রবর্ধন, বঙ্গ ও সমতটের রাজা শ্রীচন্দ্রের লিপিতে (দশম শতক) ‘চাটিকা’ নামে দাসীর উল্লেখ পাই। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে এরা ‘দেবদাসী’ ভিন্ন অন্য কিছু নয়।

শুধু অভাবে নয়, অনেক পরিবার তাদের প্রথা অনুসারে তাদের কন্যা সন্তানদের বেশ্যাবৃত্তিতে নামায়। কিন্তু বাড়ির বউদের অবগুন্ঠনবতী করে অন্দরমহলে রেখে দেয়। হয়তো সেই সনাতনী চিন্তাধারা কাজ করে ‘বেটি পরায়া ধন’। মেয়ে নিজের নয়, মেয়েকে একদিন বিদায় দিতেই হবে, তা যেখানেই হোক। রাজস্থানের কিছু গ্রাম এরকম আছে। আজও সেখানে মেয়ে জন্মালে বাড়িতে খুশির হাওয়া বয়ে যায়। হাওড়া জেলার ডোমজুড় থানায় একটি তদন্তের সময় এরকম ঘটনা নজরে এসেছিল। রুমা নামে (নাম পরিবর্তিত) একটি মেয়েকে রাজস্থানের বুন্দি জেলার এক মাঝবয়সি যুবক বিয়ে করে; বিয়ের যাবতীয় খরচ সে নিজেই বহন করে। একদিনেই দেখাশোনা, একদিনেই বিয়ে। রুমার আগে বিয়ে হয়েছিল পাঁচলায়। স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে, আট বছরের কন্যাকে নিয়ে বাপের বাড়িতে গলগ্রহ। তাই এত সুন্দর বিদায় বাপের বাড়ির লোকেরা খুশি মনে মেনে নেয়। বিয়ের পরদিন ওরা রওনা দেয় রাজস্থান। একমাস পরে রুমার ঘরে লোক ঢোকাতে চায়। রুমা কান্নাকাটি করতো। রুমার বাড়ির লোকেরা থানায় জানালে রুমাকে উদ্ধার করে আনা হয়। রুমার স্বামী অমর গ্রেপ্তার হয়। অমরের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল, তার আগের পক্ষের স্ত্রী আছে, চারকন্যা। কন্যারা প্রত্যেকেই দিল্লি, কলকাতার বিভিন্ন যৌনপল্লীতে আছে। রুমাকে লোক দেখানো বিয়ে করেছিল ঘরের কাজকর্ম করার জন্য। সঙ্গে রুমার আট বছরের কন্যা ফাউ। আর এর নথতোড়ওয়ানিতে প্রচুর মুনাফা হবে, ব্যবসায় নামালে নিশ্চিত আয়। কুমারী কন্যাকে প্রথমবার সঙ্গমের সুযোগ করে দিলে ধনী ব্যক্তিরা মোটা অঙ্কের মূল্য দেয়। এই প্রথা পতিতাবৃত্তিতে নথতোড়ওয়ানি নামে খ্যাত। ওদের বাস ছিল কঞ্জর কলোনীতে। ওদের কলোনীতে মেয়ে জন্মালে আনন্দের উৎসব; আর ছেলে জন্মালে ১৫ দিন শোক পালন। এই কলোনী বসিয়ে ছিল বুন্দির রাজা। সেই রাষ্ট্রের হাত। রাষ্ট্র যতই হাত ধুয়ে ফেলতে চাক না কেন, নারীপাচারের দায় কখনও এড়াতে পারবে না।

 এরকম আরেকটি ঘটনা গোচরে এসেছিল মুর্শিদাবাদে, কান্দি থানায়। রাজস্থান ঢোলপুর জেলার একটি গ্রামে একই ব্যবস্থাপনা। এখানে বাড়ির মেয়েদের দেহ ব্যবসায় নামতে বাধা নেই। কিন্তু বাড়ির স্ত্রীরা বিয়ের পর গৃহবধূ। ঢোলপুর থেকে তিনপুরুষ আগে কলকাতায় চলে আসে কমল সিংয়ের পরিবার। উঠেছিল কলকাতার সোনাগাছি এলাকায়। এখানেই ভাব-ভালবাসা করে কমলের বিয়ে হয় শ্যামলীর (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে। শ্যামলীর বাড়ি মুর্শিদাবাদে কান্দি থানার একটি গ্রামে। সেই গ্রামের প্রায় সমস্ত বাড়ি থেকে কোনও না কোনও মহিলা কলকাতা বিভিন্ন যৌনপল্লীতে যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করে। বাড়ির এবং গ্রামের সকলেই এটা জানে। এদের আয়ে সংসার চলে। কমলের একটি কন্যা হয় তার নাম নীতা (নাম পরিবর্তিত)। নীতাকে কিন্তু এই পথে নামাতে কমলের মত ছিল না। যদিও তাঁদের পারিবারিক রীতি এটাই ছিল। সেজন্য তিনি পরিবার নিয়ে কলকাতার পাতিপুকুরে উঠে যান। সেখানে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেন। নীতা ক্লাস এইটে ফেল করে। তখন থেকে কমলের ওপর প্রচুর চাপ আসে নীতাকে ব্যবসায় নামানোর জন্য। নথতোড়ওয়ানি হবে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে। নীতাও খুব একটা বেশী আগ্রহী ছিল না। ২০১৪ সালে মে মাসে তারা সপরিবারে মুর্শিদাবাদে মামাবাড়িতে আসে। সেখান থেকে নীতা নিখোঁজ হয়ে যায়। কেস গড়ায় মহামান্য উচ্চ আদালত কলকাতা পর্যন্ত । জেলা পুলিশ প্রচুর চেষ্টা করে। তবুও নীতার হদিস মেলে না। বর্তমানে কেসটি C.I.D. পশ্চিমবঙ্গ-এর কাছে তদন্তাধীন।

(ক্রমশ)

তথ্য ঋণ:

১) পৌরাণিক অভিধান – সুধীরচন্দ্র সরকার

২) বাঙালি নারী, হাজার বছরের ইতিহাস – মাহমুদ শামসুল হক, হাতেখড়ি (বাংলাদেশ)