পর্ব ২

আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।

পৃথিবীর সবচেয়ে আদিম পেশা গণিকাবৃত্তি, বলা হয় যখন গোষ্ঠী বা কৌম ভেঙে পরিবারের পত্তন হচ্ছিল তখন থেকে নারীর ওপর পুরুষের অধিকার সমাজ মেনে নিতে শুরু করে। আর তখন থেকেই শুরু হয় গণিকাবৃত্তি। পরিবারের নির্দিষ্ট সীমার বাইরে কোনও নারী যখন অন্য পুরুষকে অর্থ বা বস্তুর বিনিময়ে দেহ দান করে, তখন সেই নারী গণিকা বলে চিহ্নিত হয়। এই তত্ত্ব মানলে আর্যরা এদেশে আসার আগে থেকেই গণিকাবৃত্তি ছিল। বেদে মহিলাদের একাধিক পুরুষদের কাছে গমনের উল্লেখ থাকলেও, তা মূল্যের বিনিময়ে হতো— তার কোন প্রমাণ নেই। তাই বৈদিক যুগে গণিকাবৃত্তি ছিল কিনা বলা মুশকিল। তবে মৌর্য ও গুপ্ত যুগে গণিকাদের স্থান ছিল উচ্চ সারিতে। সৌন্দর্য্য, শিক্ষা, শিল্পকলায় এঁরা ছিল শ্রেষ্ঠ। সে যুগে রাষ্ট্র তাঁর শিক্ষার ব্যয় বহন করত, তাঁর আয় থেকে নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায় করত। মৌর্য যুগে কৌটিল্য বার্ধক্যে তাঁদের জন্য কিছু বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই যুগের গণিকাদের নগরবধূও বলা হতো। আম্রপালি ও বসন্তসেনা— এই দুই নগরবধূর নাম আমরা সবাই জানি। আম্রপালি ঐতিহাসিক চরিত্র, বুদ্ধদেবের সমসাময়িক। বসন্তসেনা অবশ্য শূদ্রকের (খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক) মৃচ্ছকটিকের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

আম্রপালি

নারীকে ঘরের লক্ষী ও সন্তানের জননী রূপে ঠাঁই দিয়ে পুরুষ আমোদ প্রমোদ সঙ্গী হিসেবে নারীকে হারিয়ে ফেলল। কিছু পুরুষের মধ্যে শিক্ষিতা, বিভিন্ন গুণের অধিকারী রমণীর সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সর্বদা ছিল। সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারত কেবলমাত্র গণিকারা। কারণ, সে যুগে গণিকারা ছিল শিক্ষিতা এবং নানা শিল্পকলায় পারদর্শী। শুধু তা-ই নয় সে যুগে তাঁরাই ছিল একমাত্র স্বাধীন নারী। একটা অদ্ভুদ ব্যাপার, কূলবধূকে শিক্ষা দীক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে গণিকাদের সর্ববিদ্যায় পারদর্শিনী করত প্রাচীন ভারত। অনেকে বলেন, সে যুগে এ কারণে অনেকে স্বেচ্ছায় গণিকার পেশা নিত। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে এর থেকে আনন্দের বিষয় আর কিছু নেই। কারণ, একজন নারী তাঁর নিজের মতো জীবন বেছে নিতে পারছে। কিন্তু বিষয়টা এত সহজ ছিল না। সে যুগেও স্বামীর দ্বারা নারীরা পরিত্যক্ত হতো। তখন সেই সব নারীদের গণিকাবৃত্তি বা দাসীবৃত্তি ছাড়া আর কোনও পথ থাকতো না।

সমসাময়িক কালে সারা ভারতে দেখা গিয়েছিল দেবদাসী প্রথা। দেবদাসী অর্থাৎ দেবতাদের দাসী। মন্দিরের দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এক বিশেষ শ্রেণির নর্তকী নিয়োগ করা হতো— তাঁদের দেবদাসী বলা হতো। দেবদাসীদের মূল কাজ ছিল পূজার সময় মন্দিরে বা মন্দির প্রাঙ্গণে নৃত্য করা। এজন্য তাঁরা বৃত্তি বা খাদ্যশস্য পেতেন। কোথাও মন্দির পুরোহিত তাঁর আয় থেকে এঁদের ভরণ পোষণ করতেন। দেবদাসীদের গৌণ অথচ সর্বজনবিদিত কাজ ছিল পুরোহিতের কামনা চরিতার্থ করা। শুধু পুরোহিত নয় মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিরাও তাঁদের ভোগ করত। এজন্য অনেকে এদেরকে ‘মন্দির গণিকা’ বলেন। যত সমৃদ্ধশালী মন্দির হতো, দেবদাসীর সংখ্যা তত বেড়ে যেত। সোমনাথ, পুরী সহ অন্যান্য বিখ্যাত মন্দিরে দেবদাসী ছিল। দক্ষিণ ভারতে এর প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ ও  কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে দেবদাসীর উল্লেখ রয়েছে। মধ্যপ্রদেশে যোগীমারা গুহা লিপিতে (খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক) দেবদাসী ‘সুতনুকা’-র নাম রয়েছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যালের কালজয়ী উপন্যাস আছে ‘সুতনুকা একটি দেবদাসীর নাম’। দেবদাসী প্রথা ১৯২৯ সালে মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই)  এবং ১৯৪৭ সালে সারা ভারতে আইন করে বন্ধ করা হয়েছে। এখনও অনেকে দাবি করেন, দেশের অনেক মন্দিরে লুকিয়ে-চুরিয়ে ভোল পাল্টে এখনও এই প্রথা চলছে।

শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক

 বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের দুই মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ রচনা হয়েছিল গুপ্ত যুগে। বলা হয়, রামায়ণ-মহাভারতের মূল কাহিনী অর্থাৎ ক্ষত্রিয় শৌর্য গাঁথা অতীতকাল থেকেই প্রচলিত ছিল, তার ওপর পুরাণের প্রলেপ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের নীতিবাক্য আরোপিত হয়েছে। সব মিলিয়ে সেখানে নারীর অবস্থান মিশ্র ভাবে দেখানো হয়েছে। রামায়ণে ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা-বনবাস-পাতাল প্রবেশ’, ‘অহল্যার পাষাণ হওয়ার অভিশাপ’ প্রসঙ্গে মনে হয়, নারীর সামাজিক অবস্থান তুলনামূলক নীচে ছিল। মহাভারতে নারীদের স্বেচ্ছায় অন্য পুরুষ গমন, তার ফলে অনেক নায়কের জন্ম— এতে মনে হয়, নারীর এই স্বাধীনতায় বিশেষ নিন্দা ছিল না। তবে রামায়ণে, মহাভারতে নানা কারণে নারী দান করা হতো— আপ্যায়নে, শ্রাদ্ধে, বিবাহে, যৌতুকে, যুদ্ধযাত্রায়, বিজয় উৎসবে ও নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে। বলা যেতে পারে, সেই সময় থেকে নারী ভোগ্য সামগ্রীর তালিকায় স্থান পেল। মহাভারতের শান্তি পর্ব ও অনুশাসন পর্বে গণিকা সম্পর্কে অনেক নিন্দাসূচক কথা বলা আছে। মর্তের গণিকা স্বর্গের অপ্সরা হিসেবে রূপায়িত হল। দুই মহাকাব্যে দেখা যায়, দেবতাদের প্রয়োচনায় অপ্সরা মর্ত্যে বসে নানা ঋষিমুনির ধ্যানভঙ্গ করত। অর্থাৎ রামায়ণ, মহাভারতের গণিকারা স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারতেন না। মৌর্য ও গুপ্ত যুগে গণিকারা যতই সমাজের উচ্চ স্থান অধিকার করুন না কেন, তাঁরাও কিন্তু একদম স্বাধীন ভাবে জীবন যাপন করতে পারতেন না। তাঁরা নগরবধূ জীবন ছেড়ে সহজে কূলবধূ জীবনে আসতে পারতেন না। এ ব্যবস্থা আজও সমাজে বহমান। বর্তমানে গণিকা বা যৌনকর্মীরা যতই সম্পদ উপার্জন করুন না কেন সার্বিক ভাবে স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারেন না।

[ক্রমশ]

তথ্য ঋণ: প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য