ভারতীয় টেলিভিশন সিরিয়াল নিয়ে একটা মজার কথা চালু রয়েছে। ৫% গল্প , ২০% কান্না , ২৫% বিজ্ঞাপন, ৫০% ধুম তানা তানা আর সময় কাল অনন্ত। টেলিভিশনে বছর বছর চলতে থাকা অধিকাংশ সিরিয়াল দেখলে কথাটা ভুল মনে হবে না।  

আসলে ভারতের কোনও হিট সিরিয়াল কবে শেষ হবে কেউ জানে না। যেমন, কিউকি সাস ভি কাভি বহু থি (৮ বছর !), কাহানি ঘর ঘর কী  (৮ বছর ) , এখন চলতে থাকা  কুণ্ডলী ভাগ্য শুরু হয়েছে ২০১৭ সালে। শেষ কবে হবে কেউ জানে না । এই সব সিরিয়ালের  শুরু থেকে দেখলে মনে হবে, গল্প কোথা থেকে কোথায় চলে যাবে , কে ক’টা বিয়ে করবে , সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা ঈশ্বরের উপর ছেড়ে  দেওয়া হয়েছে।

ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ, মহাভারত। প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে বি আর  চোপরা ও তাঁর ছেলে রবি চোপরা এত বড় মহাকাব্যকে ৯৪টি এক ঘণ্টার র্পবে শেষ করে দিতে পেরেছিলেন। টান টান সেই গল্পের টানে রাস্তাঘাট ফাঁকা করে দর্শক বসে থাকত টেলিভিশনের সামনে। তারক মেহতার ‘উল্টা চশমা’কেও এই সারিতে ফেলা যেতে পারে। এই সিরিয়ালটি বহুদিন ধরে চলেছে ঠিকই। তবে প্রতিটি এপিসোড দর্শককে এখনও টেনে রাখে। কিছু দিন আগে পর্যন্ত বাংলায় ‘শ্রীময়ী’ নামে একটা সিরিয়াল চলত। ভিন্ন ধরনের কনসেপ্ট নিয়ে তৈরি সিরিয়ালটি প্রথম দিকে দর্শকের মন জিতে নিয়েছিল। কিন্তু স্রেফ বাণিজ্যিক কারণে একে টানতে টানতে এমন জায়গায় এনে শেষ করা হল যখন দর্শক সিরিয়ালটি দেখতে চাইছে না। 

এ থেকে একটা কথা সামনে আসছে। সেটা হল, শুধু বাণিজ্য করতে গিয়ে আজকের সিরিয়াল নির্মাতারা কোথায় থামতে হবে বুঝতে পারছেন না। ভারতের সেরা হিন্দি সিরিয়ালগুলির তালিকার (বাণিজ্যিক ও দর্শকের পছন্দ দু‘দিক থেকেই ) দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। প্রথম স্থানে, মহাভারত। মাত্র ৯৪ পর্বে গোটা দেশে যা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এমনই কিছু সিরিয়াল, ‘মালগুড়ি ডেইজ’ (৫৪ পর্ব), ‘হাম পাঁচ’ কিংবা  ‘নুক্কড়’। সিরিয়ালগুলি যেমন বাণিজ্যিক ভাবে সফল তেমনি দর্শকও বহু বছর ধরে এগুলিকে মনে রেখেছে। কিন্তু এখন নানা চ্যানেলে বস্তায় ঠেসে প্রতিদিন হাজার সিরিয়াল গেলানোর যে ব্যবস্থা হয়েছে, তার শতকরা  দুই শতাংশও পাতে  দেওয়ার মতো থাকছে না। বিশেষ করে  পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিরিয়ালগুলিতে গল্পের আকাল প্রকট। সব গল্প প্রায় এক। এক গৃহবধূ আর তাঁর মহান হবার কীর্তি কাহিনী। সিরিয়াল নির্মাতাদের যুক্তি, দু’দিন আগেই তো হল ‘প্রথমা কাদম্বিনী’। অনেক রিসার্চ করে সিরিয়ালটি বানিয়েও কি দর্শকের মন পাওয়া গেল? বা ভূমিকন্যা, মনসামঙ্গলের একটা মর্ডানাইজ ভার্সন, কৌশিক সেনের মতো অভিনেতা। দর্শক নিল? আর দর্শক না নিলে তো চ্যানেলগুলি সিরিয়াল চালাবে না। 

ঠিক কথা ! কিন্তু এখনকার দিনে ভাল সিরিয়াল করলেও দর্শক নিচ্ছে না কেন ? মনে হয়, এর খোঁজ দরকার। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের টিভি সিরিয়াল থেকে নতুন প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। একটু খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এঁদের অনেকেই কিন্তু ইউটিউবে বাংলাদেশের নাটক বা সিরিয়াল দেখছেন। সেখানে যে সব সিরিয়াল-নাটকে বাস্তবধর্মী গল্প কিংবা অভিনয় প্রতিভা সামনে আসছে, দুই বাংলার দর্শকেরাই সেগুলি নিচ্ছেন। 

পশ্চিমবঙ্গের সিরিয়ালগুলির দৈন্যের কয়েকটা কারণ, সিরিয়াল যদি দর্শকের একবার পছন্দ গেল তো আর শেষ হবে না। আবার দেখা যায়, গল্পের গরু গাছে উঠছে তারপর আকাশ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুলনায় বাংলাদেশের সিরিয়ালগুলি নির্দিষ্ট এপিসোডে, নির্দিষ্ট সময়ে  শেষ হচ্ছে।  দুই বাংলার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতিভা নিয়ে অবশ্য আলাদা ভাবে কিছু বলার নেই।

বাংলা সিরিয়াল নতুন প্রজন্মকে টানতে না পারার বোধহয় সবচেয়ে বড়ো কারন, টিভি সিরিয়াল নির্মাতারা প্রথম থেকে তাদের টার্গেট অডিয়েন্স ঠিক করে ফেলেন। ঘরের মা বউদের কথা ভেবে তাদের অধিকাংশ সিরিয়ালগুলো তৈরি। তারা সেই টার্গেট অডিয়েন্সকে ছেড়ে নতুন কাউকে আকর্ষণ করার কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু যুগ পাল্টাচ্ছে। একটা সময় ছিল ঘরের টিভি ছিল মানুষের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। আজ OTT ধীরে ধীরে টিভি সিরিয়ালগুলোর জায়গা করে নিচ্ছে। আর OTT প্লাটফর্মগুলি দেখলে পরিষ্কার ওগুলির টার্গেট অডিয়েন্স কিন্তু নতুন জেনারেশন। এমন হয়তো হতে পারে টিভি সিরিয়ালের জায়গা একদিন পুরোটাই গিলে ফেললো হইচই, আড্ডা টাইমস এইসব OTT প্লাটফর্মগুলি ।

এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য দেওয়া যেতে পারে। আমরা বাঙালিরা ভাবি, আমরাই বোধহয় বেশি সিরিয়াল দেখি। কিন্তু কোরিয়া, চিন বা জাপানের লোকেরা টিভি সিরিয়াল দেখার ব্যাপারে আমাদের দশ গোল দেবে। আর সেই সব সিরিয়ালের আন্তর্জাতিক রেটিং মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো। ডিসেন্ডেন্ট অফ দ্য সান ,সার্জন ,দ্য ফক্স সামার — এই সব সিরিয়াল যদি আমাদের এখানে তৈরি হতো, তবে তা নেভার এন্ডিং সিরিয়ালে পরিণত হতো। কিন্তু ওই দেশগুলিতে একটাই নিয়ম, যত ভালই সিরিয়াল হোক, এপিসোড সেই ৪৮ থেকে ৫২— তার বেশি করা চলবে না। কিছুদিন আগে একটি তুরস্কের একটি সিরিয়াল সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এর হিন্দি ভার্সন, ‘প্যার লবজো মে কাহা’। ১১০টি পর্বেই শেষ। ভারত ছাড়া প্রায় সব দেশেই ব্যবস্থা রয়েছে একটি সিরিয়ালকে সময়ের মধ্যে বেধে দেওয়ার। এখানে অবশ্য একটি সিরিয়াল একবার শুরু হলে শেষ হয় না। যদি আট বছর ধরে একটা সিরিয়াল চলে, তবে যারা সিরিয়াল লিখছেন তাদের তো তাল কাটবেই। আর কাহিনীর আগা মাথা না খুঁজে পেয়ে হতাশ হন দর্শকেরা। ধীরে ধীরে সেই দর্শক সিরিয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তখন ভাল কোনও সিরিয়ালও দর্শক দেখতে চান না, আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁকে টিভি বিমুখ করে তোলে। 

একটা কথা ভাবা দরকার, বাংলা সিরিয়ালের দৈন্যদশার মধ্যেও বহু শিল্পী কর্মকুশলীর জন্য তা নিজেকে প্রমাণ করার জায়গা। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে এখানে। ফলে ইন্ডাস্ট্রি মার খেলে মুখ থুবড়ে পড়বে গোটাটাই। তাই আজ হয়তো সময় হয়েছে সিরিয়াল প্রোডাকশনের কৌশল পাল্টানোর।