সিদ্ধার্থ সেন

(আইআইটি খড়্গপুরের প্রাক্তন অধ্যাপক সিদ্ধার্থ সেন দীর্ঘদিন অশোকনগরে বসবাস করেছেন। আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে একটি উদ্বাস্তু কলোনিতে সঙ্গীত শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগের কথা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।)

সময়টা উনিশশো আটষট্টি কি ঊনসত্তর। গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যা। বয়েজ স্কুলের মাঠে বসেছে গানের এক জলসা। স্কুলের দু’দিকে দুটো বিরাট মাঠ, এক দিকে বিশাল পুকুর। সামনের রাস্তাটা তেরছা করে বাস রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। মাঠটা সেই বাসরাস্তা অবধি বিস্তৃত। রাস্তায় কোনও বাতি নেই। ধারের বাড়িগুলোতে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। মাঝে মধ্যে হেডলাইটের আলোতে অন্ধকার খান খান করে দু-একটা বাস সদর্পে চলে যাচ্ছে। গুমোট গরম কাটাতে সন্ধ্যাবেলায় ওই খেলার মাঠই ভরসা। ওইখানেই ছোট ছোট দলে বিভিন্ন বয়সের লোকজনদের আড্ডা বসে। রাতের খাওয়ার সময় অবধি চলে সেই গুলতানি। ফুরফুরে হাওয়ায় সময় কাটানোর ভালোই উপায় এক। এরই মধ্যে মাঝে মাঝে মুখ বদল হয় যদি মাঠে কোনও গানের জলসা বসে। সময়টা কাটে ভালোই। হিন্দি, বাংলা, সব গানেরই অনুষ্ঠান বসে, স্থানীয় ও বহিরাগত শিল্পীর সমন্বয়ে। মাঠের একধারে স্টেজ বাঁধা হয়। তাতে বড় আলো। বাকি মাঠটা অন্ধকার। স্টেজের সামনের সারিতে বসে থাকা বাচ্চাদের চলে কলকলি। তারই মধ্যে দিয়ে হেঁটে যায় ছোলা মটর লজেন্সওয়ালা।

কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানটা একটু অন্য রকমের। এটা স্থানীয় পূবালী সঙ্গীত শিক্ষায়তনের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। তাতে গাইবেন স্কুলের কিছু ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক। আর গাইবেন বহিরাগত এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। পুরস্কারও দেবেন তিনিই। মাঠে লোক সমাগম হয়েছে ভালোই। তার মধ্যে বড় অংশ ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক। আর বাকিটা এলাকার ভাসমান শ্রোতা। কিন্তু আজকে অনুষ্ঠান শুরু হতে অনেক দেরি হচ্ছে। প্রধান অতিথি নাকি কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছেন। কিন্তু এসে পৌঁছচ্ছেন না। মাঝ রাস্তায় যোগাযোগ করারও কোনও উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হলো। উদ্বোধনী সঙ্গীত হলো, সম্পাদকের রিপোর্ট পাঠ হলো, কিছু ছাত্রছাত্রী গানও পরিবেশন করলো। কিন্তু প্রধান শিল্পীর দেখা নেই।
দর্শকদের মধ্যে প্রথমে গুঞ্জন, পরে সেটা হট্টগোলে পরিণত হলো। কিন্তু উদ্যোক্তারা অসহায়। মঞ্চের পেছনে চুপ করে বসে মাঝে মাঝে শুধু মাইকে ঘোষণা করতে লাগলেন, বিখ্যাত এই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছবেন। দর্শকরা যেন একটু ধৈর্য ধরে বসে থাকেন। কিন্তু তাতেও কিছুতেই বাগ মানানো যাচ্ছে না। হইচই বাড়তেই থাকলো।

এরই মধ্যে এসে পৌঁছলেন শিল্পী। এসেই সোজা মঞ্চে এসে ধপ করে বসে পড়লেন। সাথে সাথে শুরু করলেন গান। কিন্তু একি? শিল্পীকে দেখে তো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মনে হয় না! তন্বী চেহারা, বব ছাট চুল, স্লিভলেস ব্লাউজ, রিমলেস চশমা। তাকে তো আধুনিক গানের শিল্পী হলেই মানাতো ভালো। দর্শকরা সামান্য হতাশ। হট্টগোল থামেই না। এরই মধ্যে আসতে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে শিল্পী শুরু করলেন ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’। মুহূর্তের মধ্যে সব চুপ। দর্শকদের মধ্যে অনেকেই শিশু, অনেকেই গানটি প্রথম শুনলো, অনেকেই গান শুনতে এসেছে গরমে মাঠে একটু হাওয়া খাবে বলে। কিন্তু সবাই যেন সম্মোহিত হয়ে রইলো তাঁর গানে। পুকুর থেকে উঠে আসা পূবালী বাতাস, চাঁদের আলো, আর তাঁর সেই উন্মুক্ত গলা। সব মিলিয়ে কোন স্বপ্ন রাজ্যের দেশে যেন নিয়ে গেল তাঁর গান। শেষ হলো যখন তখন সমস্ত দর্শক আপ্লুত। আরও দু-একটি গান করলেন। তারপর পুরস্কার বিতরণ করলেন। তারপর চলে গেলেন। কিন্তু দর্শকদের মননে কৃষ্ণকলির ঘোর আর কাটলো না। আরও পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলো। সুচিত্রা মিত্রের গানের সেই রেশ আজও কানে বেজে চলেছে।

কলকাতা থেকে প্রায় পয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে চব্বিশ পরগনার উদ্বাস্তু কলোনি আশোকনগর। সেখানে পূবালীই প্রথম সঙ্গীত শিক্ষায়তন যেটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিলো। তার আগে এই উদ্বাস্তু কলোনিতে অনেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে নিজের বাড়িতে বা অন্যের বাড়ি গিয়ে গান শেখাতেন। তবে তার চল ছিল খুব কম। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন লোকে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগসূত্র গড়ে তুলতেই সময় লেগেছিলো অনেক। বস্তুত, তিরিশ-চল্লিশের দশকের প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার সুকৃতি সেন অশোকনগরের আট নম্বর কালীবাড়ির মোড়ের কাছে বাড়ি নিয়েছিলেন। কিন্তু থাকতেন কম। কলকাতা থেকে মাঝে মাঝে সপরিবারে এসে দু-এক দিন কাটিয়ে ফিরে যেতেন। তার খবর খুব বেশি লোক রাখত না। পরে ষাটের দশকের শেষে তিনি বাড়ি বিক্রি করে চলে যান। তবে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে এই উদ্বাস্তু কলোনিতে রবীন্দ্রসংগীত চর্চায় গতি আসে যুব উৎসব, নানা সঙ্গীত প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। অশোকনগরের মেয়ে বাসন্তী দাশগুপ্ত (রায় ) শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপরে এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করে আসেন। তবু রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষকের অভাব ছিল তখন। সেটা মেটাতে প্রশান্তবাবু বলে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষককে ঠিক করা হয়। উনি দক্ষিণীতে প্রশিক্ষিত। সপ্তাহে একদিন করে আসতেন কলকাতা থেকে গান শেখাতে। সেই দিনই ফেরত যেতেন। ক্লাস হতো মনীষী নন্দীর বাড়িতে। কারণ চেনা পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র সেই বাড়িটিতেই একটি হারমোনিয়াম ছিল। প্রথম আমলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন মনীষী নন্দী, অরূপ সাহা, সুমিতা সেন (পরে রায়)। আরও কয়েক জন ছিলেন, তাঁদের নাম মনে করতে পারছি না। সেটা বোধ হয় উনিশশো চৌষট্টি সাল হবে।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ওই একটি ঘরে স্থান সংকুলানের সমস্যা হতে শুরু হলো। গানের ক্লাস সরে এলো বয়েজ সেকেন্ডারি স্কুলের এক ক্লাস ঘরে। কিন্তু তার জন্য একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করা দরকার।সেই স্কুলের নাম রাখা হলো পূবালী সঙ্গীত শিক্ষায়তন। সম্পাদক দীপ্তেশ মহাজন, সভাপতি সুশীল কুমার সেন। কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুব্রত সাহা। সপ্তাহে দু দিন গানের ক্লাস হতো— শনি আর রবিবার। স্থানীয়দের মধ্যে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন বাসন্তী দাশগুপ্ত (রায়), সনৎ ভট্টাচার্য এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিক্ষার জন্য মহেন্দ্র মজুমদার। তবলায় বেনু ব্যানার্জি। আর কলকাতা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতে আসতেন অবনীবাবু, কবি মজুমদার। কিছুদিন পরে যোগ দিলেন রীণা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম দিকের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন অরূপ সাহা, নমিতা দাশগুপ্ত (চন্দ রায়), অমিতা দেব, সুমিতা সেন (রায়), সুব্রত সাহা প্রমুখ। এঁরা ছিলেন সিনিয়র ক্লাসের ছাত্রছাত্রী। জুনিয়র ক্লাসে বিমলেন্দু দেব, শর্মিষ্ঠা সেন (দত্ত), অরূপ চন্দ ছাড়াও ছিলেন আরও অনেক ছাত্রছাত্রী।

স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়েই চলছিল। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা একশো-দেড়শো ছাড়িয়ে যায় এই সময়ে। সিনিয়র ও জুনিয়র দুই ভাগে ভাগ করা হয় ছাত্রছাত্রীদের। আবার প্রত্যেকটা ভাগে ছিল নানা ইয়ার। স্কুলের উন্নতির বড় উল্লম্ফন দেখা গেলো রীণা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেবার পরে। নকশালবাড়ির মেয়ে ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এমএ পড়তে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সুচিত্রা মিত্র তখন বিভাগীয় প্রধান। অল্প সময়েই তাঁর প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠেন তিনি। পূবালীতে যোগ দেবার পরে রীণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগাযোগে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত সঙ্গীত শিক্ষায়তন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে অসুবিধা হয়নি। আর পূবালীর উপদেষ্টা মণ্ডলীর প্রধান হতে সুচিত্রা মিত্রের সম্মতি পেতেও দেরি হয়নি। সেই উপলক্ষেই তাঁর অশোকনগর আসা, তার উল্লেখ আগেই করেছি। এক কথায় রাজি হয়ে যান নিজে ছাত্রছাত্রীদের হাতে শংসাপত্র তুলে দিতে।

পুবালীর এই পর্বে রীণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান ভোলার নয়। যেমন তাঁর মিষ্টি গলা, তেমনি গান শেখানোর কায়দা। খুব তাড়াতাড়িই ছাত্রছাত্রীদের আপন করে নিতেন। পরবর্তীকালে দীপ্তেশ মহাজনকে বিয়ে করে অশোকনগরকেই তিনি নিজের ঘরবাড়ি করে নেন। কিন্তু পূবালীর সেই রমরমা দিন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সত্তর সালে নকশাল আন্দোলনের ফলে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকে, স্কুলবাড়ির একাংশ পুড়িয়ে দেয়া হয়। পূবালী স্কুলও বন্ধ হয়ে যায় এইসাথে। দীপ্তেশ মহাজন ও রীণা বন্দ্যোপাধ্যায় অশোকনগর ছেড়ে কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন। তার কিছুকালের মধ্যেই দুরারোগ্য ক্যন্সারে আক্রান্ত হয়ে রীণাদি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। বয়স তখন তাঁর তিরিশের কোঠায়। এই ভাবে বাংলা হারালো এক উদীয়মান রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও একজন দরদী শিক্ষিকাকে।

পূবালীর প্রথম পর্যায় শেষ হয় উনিশশো সত্তর সালে। তারপর দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে পড়েছিল এই সঙ্গীত শিক্ষায়তন। প্রায় দশ বছর পরে আবার কিছু নতুন আর কিছু পুরনো শুভানুদ্ধায়ীর উদ্যোগে পূবালীর দ্বিতীয় পর্যায়ের পথ চলা শুরু। কিন্তু সেই উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়নি। তাই তার কথা আর টানলাম না। আপাতত এই লেখাটি হয়ে থাক অশোকনগর উদ্বাস্তু কলোনিতে সঙ্গীত চর্চা সূচনার একটি স্মৃতিনির্ভর খসড়া ইতিহাস লেখার এক অক্ষম অসম্পূর্ণ প্রয়াস। অথবা সুচিত্রা মিত্রের জন্মের শতবর্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীকৃত এই অধমের বিনীত শ্রদ্ধার্ঘ্য!

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়

1 COMMENT

Comments are closed.