পর্ব-৫

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

যুগে যুগে রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা নারীদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে, রাষ্ট্রও কিন্তু নারীদের সঠিক নিরাপত্তা দেয়নি। হয়তো এর কারণ, রাষ্ট্র বরাবর পুরুষতান্ত্রিক। আমরা দেখেছি মৌর্য ও গুপ্ত যুগে সমাজের মনোরঞ্জনের জন্য রাষ্ট্র নগরবধূ নিয়োগ করেছে, মন্দিরে দেবদাসী প্রথা আমদানি হয়েছে। দাসী, বাঁদী হিসাবে মেয়েদের নিয়োগ সব যুগেই ছিল। রাষ্ট্রনেতাদের চোখে সুন্দরী রমণী পড়লে, সেই নারীকে ভোগ্য হতে হয়েছে। স্থানীয় ভূস্বামী থেকে জমিদার, ছোট রাজা থেকে সম্রাট সবাই মনে করতেন, তাঁর অধীনে বসবাসকারী নারীরা তাঁদের সেবার জন্য নিবেদিত। এইসব প্রথা সমাজ খুব স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে।

       বৈশালী রাজ্যে (বর্তমান উত্তর বিহারের মজঃফরপুর জেলা) আইন ছিল, সর্বাঙ্গসুন্দর রমণী কখনও বিয়ে করতে পারবে না। তাকে নর্তকী হতে হবে। সে-সময় নর্তকী ও গণিকার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। আগেই বলা হয়েছে, সে-যুগে সমাজে গণিকা বা নগর বধূদের উচ্চস্থান ছিল। কিন্তু তিনি এই পেশা স্বেচ্ছায় বেছে নিতেন কি না, সেই মনোভাব আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বোঝা মুশকিল। বাংলায় গণিকাদের অবস্থানও সেরকম সম্মানজনক ছিল— তার নিদর্শন পাওয়া যায় ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস ‘রাজামালা’তে। তুর্কি অভিযানের পর সেন বংশের রাজারা পূর্ববঙ্গে এসে রাজত্ব করেছিলেন প্রায় ১০০ বছর। তখন সুবর্ণগ্রামে তাঁদের রাজধানী ছিল। তাঁদের সঙ্গে ত্রিপুরা রাজের সুসম্পর্ক ছিল। ত্রিপুরা রাজ ‘ডাঙ্গর ফা’র কনিষ্ঠ পুত্র ‘রত্না ফা’কে গৌড়েশ্বরের কাছে পাঠালেন রাজনীতি শেখার জন্য। সুবর্ণগ্রামে বাস করলেও সেন রাজারা গৌড়েশ্বর উপাধি নিতেন। গৌড়েশ্বর ‘রত্না ফা’কে আশ্রয় দিলেন। ‘রত্না ফা দেখেছিলেন, কোন এক শুভ সোমবারে নিয়মমাফিক রাজ্যের বেশ্যারা রাজসন্দর্শনে রাজপ্রাসাদে  এসে উপস্থিত হলেন। তাঁরা রীতিমতো সমারোহ করে এসেছিলেন। কারও চাকরেরা সামনে স্বর্ণখচিত নিশান নিয়ে যাচ্ছে, কেউ রত্নখচিত বস্ত্র ও মণিমানিক্যের গয়না পরে ঘোড়ায় চড়ে এসেছেন, কেউ শকটে এসেছেন। তাদের ‘প্রধানিকা’ এসেছেন চৌদোলাতে চেপে। প্রধানিকার আড়ম্বর দেখে ত্রিপুরা রাজকুমার ভাবলেন ইনিই গৌড়ের রানি; তিনি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। চতুর্দিকে হাসির রোল পড়ে গেল। পরবর্তীকালে এই রত্না ফা ‘রত্ন মানিক্য’ নাম নিয়ে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন। মানিক্য উপাধি দিয়েছিলেন গৌড়েশ্বর।

রাষ্ট্র, গণিকাদের শুধু মনোরঞ্জনের জন্যই ব্যবহার করতো না; তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতো, তাদের দিয়ে গুপ্তচরের কাজ করাতো। হর্ষচরিতে আছে, বারাঙ্গনারা রাজসভার অলঙ্কার। তাঁরা রাজাকে স্নান করিয়ে দেয়, নানা ভাবে পরিচর্যা করে। এসবের জন্য সুন্দরী নারীর প্রয়োজন। তাই নারীর সরবরাহ থাকতে হবে। তাই নারী পাচার হবে। অতীতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নারীপাচার চলত। বাংলায় নবাবি আমলে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। এই সুন্দরী মেয়েদের খবর দিত সিন্দুকী পদবির রাজকর্মচারীরা।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় দাসপ্রথা চালু ছিল বলে মেয়েদের দাসী হতে হতো। দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের তাই উচ্চবিত্তের বাড়িতে বিক্রির চল ছিল।  সেখানে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন শোষণের শিকার হতো তারা। এখনও কর্মক্ষেত্রে মহিলারা পুরোপুরি এর থেকে মুক্তি পাননি। দুঃস্থ পিতা-মাতারা কন্যা সন্তানকে সরাসরি গণিকালয়ে বা দাসবাজারে বিক্রি করতেন। আগেই বলা হয়েছে, দেশে অনেক দাসবাজার ছিল। অনেক ব্যক্তি পুণ্যলাভের আশায় দরিদ্র কন্যাকে কিনে মন্দিরে দেবদাসী হিসাবে উৎসর্গ করতেন। নারীদান প্রথা পৌরাণিক যুগ ছাড়িয়ে ঐতিহাসিক যুগেও বর্তমান ছিল। নারীদান দাতার পুণ্যকর্ম বলে গণ্য হতো। দরিদ্র দূরীকরণ, মানবাধিকার রক্ষা, এসব তো রাষ্ট্রের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই আগে বলেছিলাম, রাষ্ট্র কখনও নারীপাচারের ক্ষেত্রে তার দায় এড়াতে পারে না। ভারতে তথা বাংলায় মুসলমান আগমনের পর দেবদাসী প্রথা কমতে থাকে। ব্রিটিশ আমলে আইন করে নারীহরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। ক্রীতদাস প্রথার অবলুপ্তি ঘটে।

 আবার ইংরেজদের বাংলায় আগমনের ফলে কলকাতা তথা বাংলায় গণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ইংরেজরা তাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র কলকাতায় তৈরি করায় সেখানেই পতিতার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বাড়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে কলকাতায় ইংরেজ বাসিন্দার সংখ্যা ছিল ৪০০০। কিন্তু তাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫০ জন। তাই অধিকাংশ ইংরেজ যৌনক্ষুধা মেটাতো স্থানীয় মেয়েদের দিয়ে। যেখানে যেখানে ইংরেজদের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল, সেখানে সেখানে একই চিত্র। প্রশাসক ইংরেজদের আবাসে বা নীলকর সাহেবের বাংলোতে এই ব্যবস্থাপনা খুব স্বাভাবিক ছিল। ইংরেজদের সহায়তায় কলকাতায় বিত্তবান এদেশীয়দের মধ্যে যে বাবু কালচার গড়ে উঠেছিল, তা ভীষণ ভাবে বারাঙ্গনাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল। তবে এটা ঠিক, যৌনকর্মীদের সংখ্যা বাড়লেও যৌনশোষণ তুলনামূলক ভাবে কমে গিয়েছিল। সেই ধারা এখনও প্রবহমান।

[ক্রমশ]

তথ্য ঋণ:

১) বৃহৎ বঙ্গ – দীনেশচন্দ্র সেন

২) কলকাতা – অতুল সুর

৩) বাঙালি নারী, হাজার বছরের ইতিহাস – মাহমুদ শামসুল হক, হাতেখড়ি (বাংলাদেশ)