সকালের রোদের ধারা বেয়ে এসে একটা সবুজের উপর কালো বুটিদার প্রজাপতি চোখের উপর নেচে বেড়াচ্ছিল। ফরফরিয়ে উড়ছে, টেবিলের উপর নীচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বসছে না কোথাও। অনল রায় চুপ করে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, আপাত শব্দহীন,কিন্তু ঠোঁট নড়ছে। উল্টোদিকে বসে রাগিণী , টেবিলের কাঁচের দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখ ভাবলেশহীন। চোখের সামনে প্রজাপতি দোল খাচ্ছে, চারিদিক শুনশান। শুধু সবুজ প্রজাপতির ডানার ফরফরানি। অনল রায় নড়ে উঠলেন, বসার ভঙ্গি পরিবর্তন করলেন এবং অনেক দূর থেকে একটা ডেটাশীট উড়তে উড়তে এসে সবুজ প্রজাপতিকে ধাঁই করে চাঁটি মেরে রাগিণীর সামনে আছড়ে পড়ল। ব্যাস, প্রজাপতি গায়েব। চারিদিকের শান্তি গায়েব। অফিস হলের ভিতরে থাকা লোকজনের যাতায়াত, কাজকর্ম, নিঃশ্বাসের শব্দ, ফাইলের ঘষাঘষি নিমেষে ভিড় করে চলে এল কানের গোড়ায়। রাগিণী চোখ তুলে দেখল টাকমাথা আর শুঁয়ো ভুরুর নীচ থেকে অনল রায় তাকিয়ে আছেন গোল্লা গোল্লা চোখ নিয়ে। বোধহয় রাগিণীর ভিতরটা পড়ার চেষ্টা করছেন। মনে হচ্ছে চোখের ভিতর থেকে দুখানা বল্লম বেরিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে। চট করে ঠোঁটের কোণে ,না একটু বেশি-না একটু কম পেশাদার হাসিটা এনে ফেলল রাগিণী। লক্ষণ বলছে, ইনি এখুনি বাজে বকতে শুরু করে দেবেন। এখুনি জিগ্যেস করবেন কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে রাগিণী চিন্তিত কিনা। তারপর সেই ব্যক্তিগত সমস্যার বহর ও গতর নিয়ে মোলায়েম আলোচনা। তার আগে উঠে যেতে হবে। অফিসের বড় হলের অন্যপাশের থেকে লোকের কথা ভেসে আসছে। অনল রায়, হাঁ করার সঙ্গে সঙ্গে রাগিণী উঠে পড়ে বলল, ঠিক আছে স্যার, ডেটাশীটটা তৈরী করে নিয়ে আসছি। লম্বা পায়ে হেঁটে সিটে ফিরল রাগিণী। ডেটাশীটটা তৈরী করতে লাগবে আন্দাজ ২৫মিনিট। ঠিক ১৫ মিনিটের মাথায় অনল রায় উঠে এসে, সোজাসুজি নয়, একটু ঘুরে শতকের ডেস্কে গেলেন। সেখানে মিনিট দুই কাটিয়ে হলের অন্য প্রান্তে ওয়াশরুমে গেলেন। রাগিণীর মাথার পিছনেও একজোড়া চোখ থাকলে দেখতে পেত, উনি ওয়াশরুম থেকে হেঁটে আসছেন সোজা রাগিণীর ডেস্ক লক্ষ্য করে। সতর্ক হবার সুযোগ নেই। অনল রায় এসে রাগিণীর চেয়ারের পিছনে দাঁড়ালেন। গতবছর মে মাসের থেকে কোমরের এল থ্রি এল ফোর লাম্বার জোনে ব্যথা হবার জন্য রাগিণী এখন কাঠের চেয়ারে বসে। রায় ঠিক চেয়ারের ব্যাকরেস্টের উপর হাত রাখেন এবং তাঁর লম্বাটে চেহারাটাও। তারপর অনেকটা হুমড়ি খাওয়ার ভঙ্গিতে রাগিণীর ঘাড়ের উপর দিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিন, হাতে মোবাইল থাকলে, মোবাইলের স্ক্রিন মন দিয়ে দেখতে থাকেন। রাগিণী ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাসের শব্দ পেলে চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে জিগ্যেস করে, কিছু বলবেন স্যার? রায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মুচকি হেসে বলেন, না না, আপনি করুন ম্যাডাম, করুন না, আমি দেখছি আপনি কীভাবে কাজটা করছেন। অগত্যা, ম্যাডাম অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে গলার কাছের জামা, কাঁধের ব্রা স্ট্র্যাপ ইত্যাদি ঠিক করতে করতে কাজ করতে থাকেন। রায় ভুরু কুঁচকে কোনও এক কাল্পনিক ডেটা প্রসেসিং দেখতে দেখতে আরও অবান্তর কিছু বলার চেষ্টা করে সরে যান। এরকম প্রায়ই হয়। অনল রায় যবে থেকে জেনেছেন, রাগিণী একজন স্বামী বিচ্ছিন্না, একলা কর্মরতা মহিলা এবং বাচ্চার জন্য কেরিয়ারের গোড়ায় ধূনো জ্বেলে, সেলস থেকে অপারেশনস এ ট্রান্সফার নিয়ে এসেছে, তখন থেকেই তিনি রাগিণীর ভালো-মন্দ, ওঠা বসা, ফ্যামিলি, অফিস ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি প্রায় সবকিছু নিয়ে চিন্তিত। সকালে, বিকেলে, দুপুরে এবং বিশেষ করে সন্ধেয় তিনি নিজের কেবিনে ডেকে পাঠান। নানান প্রশ্ন থাকে তাঁর। যেমন— কখন বেরোয়, কখন ফেরে, বাচ্চা কার কাছে থাকে, রাতে ফিরে কি করে, রান্না বান্না করে কিনা, বাবা মা ছাড়া আর কে আছে ইত্যাদি। রাগিণীর যেহেতু ইয়েস, নো, ভেরিগুডের বাইরে বেরোয় না, কাজেই আলোচনা বেশি দূর এগোয় না। অগত্যা, উনি পেরেন্টিং স্কিল আর ফাইনান্সিয়াল প্ল্যানিং নিয়ে সম্যক জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রেখে যান। রেখেই যান। রাখতেই থাকেন। এসময় ওনার হাতে অফুরন্ত সময় থাকে। খুব সূক্ষ্ম ভাবে রাগিণীর ব্যক্তিগত বিষয়ে ঢুকতে থাকেন। কুণালের সঙ্গে সেপারেশনের সময় থেকেই, গত প্রায় তিন বছর ধরেই বিভিন্ন জায়গায় এসব সইতে হচ্ছে বলেই প্যাটার্ন রাগিণীর খুব চেনা। পিঠ টান করে বসে, মরা মাছের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়, আর দশ মিনিট পর পর বলতে হয়, আচ্ছা, তাহলে ডেস্কে ফিরি স্যার, কাজ আছে, ফোন এসেছে, ফাইল নিয়ে আসি ইত্যাদি। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, অনল রায় তাঁর কোষ্ঠকাঠিন্য হাসি আর কৌণিক চাহনি নিয়ে প্রায় সব তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে বলতে থাকেন, আহা বসুন না। রাগিণী বুঝে পায় না কি করে ছাড়া পাবে। ছুটির দিন দুপুরে, গজু আর রাগিণী অ্যানিমেশন ছবি দেখে। একদিন দেখল, একটা ইঁদুরের গর্তের সামনে লম্বা লম্বা গলার, ভেতরে জুলজুলে চোখে তাকিয়ে থাকা, এদিক ওদিক তুরতুরিয়ে ঘুরতে থাকা ইঁদুর ছানা জেরি। বাইরে টম নামের মিচকে বেড়াল পায়চারি করছে। জেরি গরাদের দরজা খুলে বেরোলেই খপ করে ধরবে। জেরি পায়ে পায়ে গরাদের কাছে আসে। ওত পেতে থাকা টম হাত বাড়ায়। জেরি আবার লেজ গুটিয়ে ভেতরে,অন্ধকারে ঢুকে যায়। অন্ধকারের গায়ে ড্যাবাড্যাবা চোখ ফুটে ওঠে। টম আপশোষে ল্যাজ আছড়ায়।

কাকতালীয় ঘটনা হচ্ছে,পরের দিন অফিসে এসে শুনল, অফিসে তার আর অনল রায়ের জুটির নাম হয়েছে, টম অ্যান্ড জেরি। ইদানীং রায় এসে চেয়ারের পিছনে দাঁড়ালে রাগিণী উঠে অন্য ডেস্কে চলে যাচ্ছিল। লোকে সেটা লক্ষ্য করেছে। ফেরার সময় রায় প্রায়ই বলেন, ম্যাডাম কদ্দূর যাবেন? কোন দিকে? ভাবখানা এমন, আসুন, একসঙ্গে যাওয়া যাক। রাগিণী সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে। কলিগদের মধ্যে রাগিণীর যারা ঘনিষ্ঠ, সেটা যদিও সংখ্যায় মাত্র দুই, তাদের বক্তব্য, তুই নিজে বল। এরকম ভাবে গায়ে পড়াতো অসভ্যতা। কম্প্লেন কর, এইচআরকে চিঠি দে। রাগিণী মন দিয়ে দু আঙুলে রুটি ছিঁড়তে  ছিঁড়তে শুনল। খোপে খোপে এবং ঝোপে ঝাড়ে কানাকানিও শুনল। সরাসরি বলতে গেলে অসভ্যতায় নামতে হয়। শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করছেন এটা বলতে গেলেও নিজস্ব শালীনতার পর্দাটাকে এক স্তর সরাতে হয়। এটাই যদি ঠিক সময় মতো পারবে রাগিণী,তাহলে তো অনেক দিন আগেই কুণালের চলে যাওয়াটা আটকাতে পারত। রাত জেগে আড়াইটে তিনটে অব্দি টেক্সট করত যখন কুণাল, ভোর ছ’টায় উঠে সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে যেত, ফিরত রাত বারোটা, কখনও একটা,কখনও ফিরত না। রাগিণী সব দেখছিল, বুঝছিল।  অফিস যে শুধু অফিস নয়, ভালই বুঝেছিল। কিন্তু ঠিক কী জিগ্যেস করলে ঠিক হয়, সেটাই বুঝছিল না। অভদ্রতায় নামতে হবে। একথা যতদিনে বুঝল বা চোখের সামনে এল যে, ঘটনাটা আদতেই শালীন নয়, তাই তার কোনও শালীন প্রতিক্রিয়া হতেই পারে না, সে ছোটবেলা থেকে বাবা মা যা-ই শিখিয়ে থাক তোমায়, ততদিনে কুণাল সেপারেশন চেয়ে বসেছে। ডিভোর্স নিয়ে কুণাল, বান্ধবী-সহ পুণে চলে গেল, শাশুড়িকে কলকাতায় রেখে। ভদ্রমহিলার এ বিষয়ে কোনও মতামত ছিল না। এবং রাগিণীর সঙ্গে তাঁর এখনও যোগাযোগ আছে। পালে পার্বণে সাক্ষাৎ হয়। রাগিণী চার বছরের গজুকে নিয়ে চলে এল বাবা মায়ের কাছে। মোটামুটি চলছিল। ডিভোর্সী মেয়ে নিয়ে বাবা মায়ের খুব একটা তাপ উত্তাপও ছিল না। বাবা কমরেড জ্যোতি বসুর ভক্ত। বাবার ভাবটা এমন, যা হয়েছে ঠিক আছে, যা না হয়েছে তা-ও ঠিক হয়েছে। এরকম তো কত হয়। মায়ের উক্তি ছিল, কয়লা খেয়েছ তুমি, আংরা হাগবে তুমি। আমার কি? কুণালের সঙ্গে বিয়েতে মায়ের কোনওদিনই মত ছিল না। পছন্দই করেনি কখনও কুণালকে। কিন্তু চাকরি করা, স্বাধীনচেতা মেয়ের সংসার, বিবাহিত জীবন নিয়ে কিছু বলতেও যাননি। রাগিণী মিউচুয়াল ডিভোর্স দিয়েছিল, কোনও রকম নাটক ছাড়াই। অফিসের এই উপদ্রবটাও যেজন্য নাকের ডগায় ঝুলে আছে। সে শান্তিপ্রিয়, ল্যাদখোর ধরণের জীব। গজু,বুড়ো বাবা, মাকে নিয়ে সে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে। ব্রাঞ্চে যদ্দিন ছিল, সেলসে, তার সময়ই হতো না ছেলের দিকে তাকানোর। গজু, এখন ক্লাস থ্রি, বড় দুরন্ত। মা বাবা এখন আর ওর সঙ্গে পেরে ওঠে না। সেলস থেকে অপারেশনসে আসতে চেয়েছিল সেজন্যই। এখানে মান্থলি টার্গেটের চাপ নেই। কিন্তু অনল রায় হাজার পাস্কাল হয়ে সেকশন ইনচার্জ হয়ে বসে আছেন। রাগিণী ছাড়াও এই সেকশনে ঋতম আছে, মণীশ আছে ডেস্ক অফিসার হিসেবে। সেখানে কিন্তু রায় খাপ খুলতে যান না।

শেষমেশ একদিন রাগিণীই মুখ খুলল। সবার সামনে, উঁচু গলাতেই বলল, স্যার আপনি আমার ডেস্কে আসছেন কেন বারবার? আপনি সিনিয়র, আপনি কাজ দেবেন, আমি আপনাকে দিয়ে আসব। এভাবে এলে তো আমার অসুবিধা হচ্ছে। বেশ কেটে কেটে পরিষ্কার উচ্চারণে গলা তুলে বলল, যাতে সবাই শুনতে পায়। শোনানো জরুরি, কেননা, রাগিণী বুঝতে পারছিল,অফিসে যা কানাঘুষো চলছে, তাতে এরপর গসিপ টার্ন নেবে এইদিকে যে রাগিণী হয়ত এই অপ্রত্যাশিত মনোযোগে মজাই পাচ্ছে। এরপর হয়ত বিশেষ সুবিধাও নেবে। মানে, সমস্যা জটিলতর হবে। তো যাই হোক, শান্ত, নরম রাগিণীর উচ্চকিত ভাষণের পর অনল রায় ধাক্কা খেলেন। গটগটিয়ে নিজের ডেস্কে ফেরত গেলেন। হলের লোকজন খানিকক্ষণ সূচীভেদ্য নিস্তব্ধতা পালন করল। কেউ মারা গেলে যেমন দু’মিনিটের শোক পালন হয়। তারপর আবার গুঞ্জন, কাজকর্ম ইত্যাদি শুরু হল।

তিন দিন, ঠিক তিন দিনের শান্তির পর অনল রায় নড়েচড়ে জেগে উঠলেন। উঠতে বসতে, পনের মিনিট অন্তর তুচ্ছাতিতুচ্ছ অজুহাতে রাগিণীকে ডেকে পাঠাতে লাগলেন। আর মেজাজ সর্বদাই তুঙ্গে। তুচ্ছ কারণে খিটিমিটি। রুঢ় ভাবে কথা, দৃষ্টিতে, চালচলনে অবজ্ঞা ঠিকরে পড়ছে। অডিট আসছে, ইয়ার এন্ডিং এসব নিয়ে ভয়ানক উত্তেজিত। ফেব্রুয়ারি মাসের এক বাসন্তী সকালে রাগিণী আবিষ্কার করল, তার বিভাগের ৯০% কাজ তার ডেস্কেই রয়েছে এবং রায়ের দাবি অনুসারে, তাকে সেসব দশটা থেকে ছ’টার মধ্যে শেষ করতে হবে। যে কাজ ঠিক মতো করলে শেষ করতে দু’মাস লাগবে, তার জন্য ডেডলাইন এক সপ্তাহ। এবং দু’বছরের পুরনো পেন্ডিং টেনে বের করেছেন, যেসব ফাইল তামাদি হয়ে যাওয়ার কথা, সেগুলো আবার রিভিউ করতে হবে। প্রচন্ড অস্বস্তিকর এক সপ্তাহ টানল রাগিণী। এর মধ্যে ব্যাপারটা সিএম অ্যাডমিন এবং জিএম-এর নজরেও এসেছে। অফিসে কানাঘুষোতে শোনা গেল, সিএম অ্যাডমিন, জিএম-এর নির্দেশে রায়ের সঙ্গে কথাও বলেছেন। এঁরা, রাগিণীর হ্যারাসমেন্ট নিয়ে চিন্তিত। এত চাপ কেন দেওয়া হচ্ছে তাকে।

উত্তরে রায় নাকি বলেছেন, এমন কিছু কাজ দেওয়া নেই। রাগিণী সারাদিন ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাই রায় বিরক্ত, এবং কাজ ডিলে হয়, ভুল হয় ইত্যাদি। সবচেয়ে আপত্তিকর কথা, রায় সিএম অ্যাডমিনকে বলেছেন, সে ইচ্ছাকৃত দেরি করে অফিসে লেট স্টে করার জন্য।

রাগিণীর আপাদমস্তক জ্বলতে থাকে। সে কাজ এবং স্ট্রেসের পাহাড় নিয়ে বাড়ি আসে। আবার সেই নির্ঘুম রাত। সকালের ঘুমে দুঃস্বপ্ন। গায়ে হাত পায় ব্যথা। পিরিয়ডের ইরেগুলারিটি, অতল ডিপ্রেশন। ঠিক যেন সেপারেশন পিরিয়ডের দিনগুলো ফিরে আসছে। গজুকে স্কুলে দিয়ে অফিস যাবার পথে অনল রায়ের ভীতি তাকে পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরে।

অফিসে কলের পুতুলের মতো কাজ করে রাগিণী। একদিন কাজের ফাঁকে মাথা তুলে দেখল তার কোণাকুণি কেবিনে অনল রায় ভুরু কুঁচকে বসে আছেন, স্তব্ধ মুখে। রাগিণীর মনে হল সে বেবীজ ডে আউটের বড় বড় শিক ওলা শিম্পাঞ্জির খাঁচায় বসে আছে। তার সামনে একটা ইয়া বড় ডাইনোসর খাঁচার বাইরে ল্যাজ আছড়াচ্ছে। ডাইনোসরের আধখানা মাথায় টাক আর ঠোঁটের উপর জুতোর বুরুশের মতো গোঁফ।

রাগিণী চমকে উঠে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে গেল মুখে চোখে জল দিতে। ফিরে এসে দেখল, অনল রায় তার ডেস্কের কাগজপত্র ঘেঁটে, কি যেন কি একটা খুঁজছেন। রাগিণী থেমে গিয়ে ভাবতে লাগল তার ডেস্কে গজমোতির হার বা সেনাবাহিনীর সিক্রেট কোড জাতীয় কিছু আছে কিনা। নেই। রায় একটা অসম্পূর্ণ ডেটাশীটের অংশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, যেটা আজ সকালেই রাগিণী ওনাকে দিয়ে এসেছে। এবং রাগিণী কে দেখেই রায় চিৎকার শুরু করে দিলেন। পুরো অফিস শুনিয়ে, বাছাই করা শব্দ, যেমন অপদার্থ, কেয়ারলেস ইত্যাদি। এসব দিয়ে কাজ চলবে না। রাগিণী নত মুখে শুনল।  আধঘণ্টা পরে গিয়ে রায়কে হাতের কাজ জমা দিল। আগের অসম্পূর্ণ কাজের ব্যাখা দিল বরফ ঠান্ডা গলায়। দরকার ছিল না যদিও। লাঞ্চ টাইমে শুনল, প্রবল আলোচনা এই নিয়ে। জিএম নাকি চেঁচামেচি শুনে নিজে ডেকে জিগ্যেস করেছেন অনল রায়কে। রায় নিজের বিরক্তি জানিয়েছেন। কিন্তু, মজা হচ্ছে, উনি কিন্তু এত রাগ, বিরক্তি সত্ত্বেও এই অবাধ্য এমপ্লয়ীকে অন্য সেকশনে বদলি করতে রাজি নন।

বিকেলে রাগিণী সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের সার্কুলারটাকে ডাউনলোড করল, প্রিন্ট করল, টেবিলে সাজিয়ে রাখল। ফোনটাকে সেলফি মোডে রেখে কম্পিউটারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখল। ঘন্টাখানেক পর অনল রায় আবার এলেন। অভ্যেসমত চেয়ারে হেলান দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালেন। বাঁ হাতের তর্জনীর আলতো ছোঁয়ায় ছবি উঠে গেল। ঘাড়ের উপর থেকে টিকটিকি ঝেড়ে ফেলার মত রায়কে ঝেড়ে ফেলে উঠে গেল রাগিণী। সন্ধেয় বাড়ি ফেরার সময় নিজে এগিয়ে গিয়ে সিএম অ্যাডমিনকে জিগ্যেস করল উনি লিফট দিতে পারবেন কি না। ভদ্রলোক বয়স্ক, রিটায়ারমেন্টের দিন বেশি দূরে নেই। ভীতু ধরণের লোক। উনি অ্যাডমিন হেড হিসেবে এর আগে অনল রায়ের দু’দিন ক্লাস নিয়েছেন। রাগিণীর প্রতি রায়ের আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ, দুয়ের খবরই ওঁর কাছে আছে এবং উনি চিন্তিতও, রাগিণী জানে।

গাড়িতে ওঠার সময় আড়চোখে দেখল, অনল রায় কোলাব্যাঙের মত বিস্ফারিত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।

দিন পাঁচেক রোজ সিএমের গাড়ি চড়ে যাতায়াত করল রাগিণী। দীর্ঘ আলোচনা হল। অফিস, মেয়েদের অধিকার, কম্প্লেন সেল ইত্যাদি নিয়ে। সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের ক্ষেত্রে অভিযোগকারিণী এবং অভিযুক্ত ছাড়া ইউনিটের, ইউনিট হেডের কি কি ক্ষতি হতে পারে ইত্যাদি। ষষ্ঠ কর্ম দিবসে নতুন অফিস অর্ডার হল। রাগিণীর ডেস্ক চেঞ্জ, সেকশন চেঞ্জ। অনল রায়ের বদলে এখন থেকে রাগিণী সিংহ সিএম-এর অধস্তন হিসেবে কাজ করবে। অফিস আবার তোলপাড়। অনল রায় জিএম এর কাছে অভিযোগ করলেন। বেয়াড়া কর্মচারীকে টাইট দিতে চাইছেন তিনি। সিএম তাতে হস্তক্ষেপ করছেন। লাভ হল না। জিএমের অনুমতি সাপেক্ষেই অর্ডার হয়েছে। হুকুম নড়ল না, হাকিমই নড়ে গেল। আহত শিম্পাঞ্জির মত রায় কিছুদিন দাঁত খিচিয়ে, মনমরা হয়ে আপিস করলেন। তারপর তড়িঘড়ি ট্রান্সফারের আবেদন করে, বাড়ির কাছে পোস্টিংয়ের অজুহাতে অন্য শাখায় চলে গেলেন। রাগিণীর তো হাল্লেলুইয়া। কুণাল আর ঋতম লাঞ্চে জিগ্যেস করল, এসব কিভাবে হল রাগিণীদি? রাগিণী মিষ্টি করে হেসে এড়িয়ে গেল। রামকৃষ্ণ দেব বলে গেছেন, কামড়াবি না, ফোঁস করতে তো দোষ নেই। এক কপি কথামৃত কিনে অনল রায়কে পাঠিয়ে দিতে হবে। ফেয়ার ওয়েল গিফট।

10 COMMENTS

  1. গল্পটার সাথে বাস্তবের অনেক মিল পেলাম। রোজ ই এগুলো ফেস করে বহু মেয়ে।

  2. ‘মায়ের উক্তি ছিল, কয়লা খেয়েছ তুমি, আংরা হাগবে তুমি।’ সব মায়েরাই বলেন মনে হয় ।

  3. প্রায় অনেক অফিসের রোজ নামচা। ভাল হয়েছে

  4. Excellent story, very close to the modern times. But the literary fragrance was extraordinary.

  5. বহু অফিসে ই এমন অনল রায় আছেন । তাদের জব্দ করতে রাগিণী ও অনেক অফিসে আছে । কিন্তু বিষয় চেনা হলেও মন কাড়লো গল্পের উপস্থাপনা , ভাষার ব‍্যান্জনা । শুধু একটা ই কথা , রাগিণী র মতো একটি আকর্ষণীয় যথার্থ নামের অধিকারিনী’র ছেলের বোধহয় আর একটু সুন্দর একটা নাম পাওনা ছিল ☺️

  6. খুবই ভালো লেখা হয়েছে, এক টানে পুরোটা পড়ে ফেললাম। তারপর আরও বেশ কয়েকবার পড়লাম। লেখিকার সিগনেচার ছোট ছোট চিত্রকল্প গল্পটাকে তর তর করে এগিয়ে নিয়ে গেছে। খুঁটিনাটি গুলো ও নিখুঁত। শেষের কথামৃতর কোট টা একদম আইসিং অন দ্য কেক।

    এরকম আরও গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।

Comments are closed.