(আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার ‘এক যোগীর আত্মজীবনী’ বইটির লেখক পরমহংস যোগানন্দ (১৮৯৩-১৯৫২) ছিলেন একজন ভারতীয় যোগী, যিনি ‘ক্রিয়া যোগ’ নামে প্রাচ্য বিজ্ঞান পাশ্চাত্যে প্রচার করেন। তিনি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯২০-তে আত্মোপলব্ধি ফেলোশিপ’ চালু করেন। তাঁর বইপত্র এখনও বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাচ্যের প্রাচীন আধ্যাত্মিক জ্ঞান আহরণে অনুপ্রেরণা যোগায়।)

স্বর্ণ বছর কয়েক ধরে বৌদ্ধধর্ম, বেদান্ত, জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি, বিবেকানন্দ, ওশো, সুফিজম এবং আরও নানা বিষয়ে পড়াশোনা করেও ঠিক স্বস্তি পায়নি। প্রকৃত গুরুর জন্য তার বুঝি অনন্ত প্রতীক্ষা। সে জানতো একদিন সে অণ্বিষ্ট গুরুদেবের সন্ধান পাবেই। এক গ্রীষ্মের বিকেলে প্রিয় বন্ধু মহুয়ার সঙ্গে ট্যাক্সিতে যাবার পথে তার হাতে উঠে আসে মোড়কে ঢাকা একটি বই। বন্ধুর উপহার। মোড়ক খুলতেই মলাটের ওপর তার চোখ পড়ে। সেটিই সেই বই যার অপেক্ষায় ছিল সে। পরমহংস যোগানন্দের লেখা ‘এক যোগীর আত্মজীবনী’। এভাবেই স্বর্ণর সাক্ষাৎ তার গুরুদেবের সঙ্গে।
পরমহংস যোগানন্দ হলেন প্রথম খ্যাতনামা ভারতীয় গুরু যিনি পশ্চিমে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন পাশ্চাত্যে প্রাচীন যোগবিজ্ঞান ‘ক্রিয়া যোগ’ প্রচারের জন্য। তাঁর জীবন মানবজাতির মধ্যে সচেতনতা জাগ্রত করার জন্য নিবেদিত। একজন প্রকৃত গুরুর মতোই তাঁর ব্রত ছিল মানুষের কষ্ট লাঘব করে যোগশাস্ত্রের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে তাদের আত্মোপলব্ধির পথের দিশা দেখানো, যাতে তাদের জীবনে পরিবর্তন ঘটে।
স্বর্ণ বইটি পড়ে অভিভূত। সেখানে যোগানন্দ নিজের গুরুদেব সম্পর্কে বলছেন, যাঁরা আলোকপ্রাপ্ত সন্ন্যাসী, তাঁরা সেই অলৌকিক জীবন যাপন করে গেছেন যেখানে পার্থিব যুক্তিবিচারের ঘেরাটোপ ও সীমিত মানব জ্ঞানের পরিধি পেরিয়ে অচিন্ত্যনীয় সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া সম্ভব। প্রাচীন মুনিঋষি ও অমর যোগী যাঁরা যোগবলে ভগবৎ আশীর্বাদ লাভ করে স্থান-কাল, মাধ্যাকর্ষের নিয়ম পেরিয়ে অলৌকিক উপায়ে নিরাময় লাভ করেছেন তাঁদের গল্প পড়ে স্বর্ণ মুগ্ধ।
কয়েক মাস পর কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে সে ক্রিয়া যোগে দীক্ষা নেয়। তার ধারণা, এই দীক্ষাগ্রহণের পর তার জীবন নাটকীয় মোড় নেবে যেহেতু সে এমন এক আধ্যাত্মিক মানসিকতায় উন্নীত হতে চায় যেখানে দৈনন্দিন জীবনের দুঃখবেদনার উর্ধ্বে ওঠা সম্ভব। স্বর্ণ খুব উৎসাহ ভরে ক্রিয়াযোগ পদ্ধতির অনুশীলন শুরু করে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করে, কিছু শান্ত মুহূর্ত ছাড়া, যখন সে ধ্যান করছে বা ক্রিয়া অনুশীলন করছে, তখনও তার অন্তর অস্থির। আছে অতৃপ্তিও, যেহেতু ধ্যানের মধ্যে কোনও অপার্থিব অনুভূতির স্পর্শ পায় না সে। তার চারপাশের মানুষেরা যেমন ছিল তেমনি রয়েছে। আর সে নিজেও যেমন সাধারণ ছিল তেমনি রয়ে গেছে।
দু’টো নিস্ফলা মাস কেটে গেল। ৫ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে স্বর্ণ যোগানন্দের জন্মোৎসব উপলক্ষে দক্ষিণেশ্বরে আসে। প্রাথমিক জড়তা সত্বেও আশ্রমে প্রবেশ করার পর আচমকা তার যেন একটা গুরুভার নেমে গেল। গঙ্গার ধারের আশ্রমটি ফুল দিয়ে সাজানো। গুরুগম্ভীর পরিবেশ। প্রায় শ’দুয়েক ভক্ত সারিবদ্ধ ভাবে নীরবে দাঁড়িয়ে ধ্যানস্থলে যাবার অপেক্ষায়। স্বর্ণ সাদা পাজামা-কুর্তা পরা এক প্রবীণের পিছনে দাঁড়িয়ে। বয়েস আশি ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ তিনি ফিরে তাকালেন, চোখাচোখি হল। ভদ্রলোক হাসলেন। তাঁর সেই শিশুসুলভ হাসি হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
‘তোমার মতো এক তরুণী যে এই পথে এসেছে তা গুরুজীর কৃপা। পরিণত বয়েসের আগেই এসে পড়েছো এটা তোমার পক্ষে ভাল’, হাসিমুখে বললেন ভদ্রলোক।
স্বর্ণ অপরিচিতের সঙ্গে বাক্যালাপের ক্ষেত্রে যে সতর্কতা মেনে চলে তা যেন ভুলে গেল। সে কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘আপনি কতদিন যাবৎ ক্রিয়া অভ্যাস করছেন’?
‘পঁয়ত্রিশ বছর’।
‘এতদিন? ক্রিয়া অনুশীলন করতে আপনার কেমন লাগে? মানে আপনার অভিজ্ঞতা কি রকম? আমি নতুন। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি একটু বিভ্রান্ত অবস্থায় রয়েছি’।


উনি একটু থামলেন। তারপর স্বর্ণের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখো, এখানে নানা জন নানা প্রত্যাশা নিয়ে আসে। এটা যে অনৈতিক বা অযৌক্তিক— তা বলছি না। আমরা সবাই মানুষ। এখানে আমরা সার বেধে দাঁড়িয়ে আছি কেন? কারণ, শান্তি আর গভীর তৃপ্তির একটা প্রতিশ্রুতি আমাদের টানছে। কিন্তু নিজের তৃপ্তিবোধকে তুমি ক কীভাবে দেখছো সেটা জরুরি বিষয়। ধ্যানে স্বর্গীয় অনুভূতির স্তরে পৌঁছনো অবশ্যই একটি বিরাট কর্মসাধন। কিন্তু তুমি যখন পৃথিবীর পথে হেঁটে চলেছ, তখন সেই শান্তি কি তোমার মধ্যে রয়েছে? সেটা কি তোমাকে শত্রুদের প্রতি সহিষ্ণু হতে সাহায্য করছে? চারপাশের মানুষের সঙ্গে তোমার আচরণে কি উন্নতি হচ্ছে? এসবই হল আধ্যাত্মিক উন্নতির সূচক। যখন আশ্রমে নতুন ভক্তরা আসে, তাদের বেশিরভাগেরই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ‘নির্বিকল্প সমাধি’ লাভের তাড়া থাকে। হা..হা। গুরুজী বলতেন, ঐশ্বরিক মহিমা লাভের পথটা সার্কাস নয়। অতৃপ্তদের তিনি সন্দিগ্ধ হতে বারণ করতেন। কারণ, অনেকেই অলৌকিকের অণ্বেষণে তাঁর কাছে আসত। তিনি বলতেন, মণীষীরা ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা দেখান না, যদি না সেরকম নির্দেশ পান। সাধারণ মানুষ বোঝে না যে সব অলৌকিকতার সেরা হল ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে জীবনকে বদলে ফেলা’।
স্বর্ণ বাতাসহীন দিনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাছের মতো শুনছিল সব। প্রবীণ বলে চলেছেন, ‘আমি ৩৫ বছর ধরে অনুশীলন করে চলেছি। গুরুজী আমার কাছে কী, তা যদি মুখ ফুটে বলতে পারতাম! বিশ্বাস রাখো তাঁর ওপর। এর চেয়ে ভাল আর কোনও জায়গা নেই’।
স্বর্ণ বুঝল, তার মন পড়ে ফেলেছেন ভদ্রলোক। সে এরই প্রতীক্ষায় ছিল। প্রার্থনা চলাকালীন এক প্রবীণ সন্ন্যাসী ভক্তদের বললেন, ধ্যানে বসার আগে গুরুজীর কাছে বিশেষ কিছু কামনা করতে। তিনি বললেন, যেহেতু আজ শুভদিন, গুরুজী নিশ্চয়ই তা পূরণ করবেন যদি তা সু-কামনা হয় এবং লোভ বা আত্মবিনাশী কামনা না হয়। স্বর্ণর মন ভরে গিয়েছিল। সে চোখ বুজে আত্মস্থ হয়ে প্রার্থনা করল, ‘হে গুরুদেব, তোমার ইচ্ছার কাছে আমাকে সমর্পণ করতে চাই। জীবন আমাকে সুন্দর ও কুৎসিত দুই-ই দিক। কিন্তু আমার হাত সর্বদা ধরে থাকবে, এই প্রতিশ্রুতি আমায় দাও। তোমার প্রতি আমার ভালবাসা যেন চিরকাল থাকে’।

ছ’বছর কেটে গেছে। স্বর্ণর জীবন এখনও আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ। কিন্তু তার অন্তর সমৃদ্ধ হয়েছে ভালবাসায়, অনুকম্পায় আর বিশ্বাসে, যা ক্রমবর্ধমান। জীবনের টানাপোড়েনে সে টের পায়, তার জীবনে প্রতিটি মানুষ ও ঘটনা কোনও উচ্চতর উদ্দেশ্যসাধনে সহায়ক এবং শিক্ষার বাহক। সে তার কর্মক্ষেত্রে শান্তিতে কাজ করে, চারপাশের মানুষের সঙ্গে বিচারবুদ্ধি দিয়ে মেলামেশা করে, যাতে অকারণে কোনও সংঘাত সৃষ্টি না হয়। কোভিড কালে সে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে প্রায় হারাতে বসেছিল। তার মা-ও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তবু সে শান্ত ছিল। কারণ, তার মনে হয়েছিল, গুরুদেবের অদৃশ্য হাত ছিল তার মাথার ওপর। সে অবাক হয়নি যখন তার বন্ধু ও মা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। সে এখনও জীবনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পথ হেঁটে আরও বিনয়ী ও বিচক্ষণ হয়ে উঠতে চায়। স্বর্ণ টের পায়, গুরুদেব তার কপট অহং আর অবাস্তব প্রত্যাশাগুলোকে মুছে দিতে চান। তার ইচ্ছে পূরণ হলে গুরুদেব তার অন্তরে আসন নিয়ে পথের দিশা দেখাবেন।
সে গুরুদেবের জীবনের একটি বিশেষ ঘটনার কথা পড়তে ভালোবাসে। এক শিষ্য শুধোলেন, ‘গুরুদেব, আমরা যখন আপনাকে আর দেখতে পাবো না, তখনও কি আপনি যেমন আছেন, তেমন ভাবেই থাকবেন’?
গুরুজী স্মিত হেসে বলেছিলেন, ‘যারা আমায় কাছে আছি বলে ভাবে, আমি তাদের কাছাকাছিই থাকবো’।

  • অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা।