(গলায় অসামান্য সুরের জাদু, স্টেজে হাজারো অঙ্গভঙ্গি। তাঁকে শুধু একবার দেখতেই উন্মাদনা ছড়াতো গ্রাম-শহরে। ঠিক কতটা জনপ্রিয় ছিলেন কিশোরকুমার, তার নমুনা মিলবে আজ থেকে চার দশক আগে, বাংলা-বিহারের কয়লাঞ্চলে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায়। ‘কিশোর নাইট’-এ কিশোর না এলে কী হতে পারে…সেই মজার অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন সাংবাদিক অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়।)

গাতা রহেএএএ.. মেরা দিল.. তুহি মেরিইইই মনজিল…..
অদ্ভুত মাদকতাময় যে কণ্ঠে সারা দেশ মোাহিত হয়েছে, মাতোয়ারা হয়েছে বছরের পর বছর, সেটির অধিকারীর নাম কে না জানে? সেই বাঙালিগৌরব তথা ভারতের সর্বকালের জনপ্রিয়তম গায়কদের তালিকায় শীর্ষে থাকা কিশোরকুমারের জন্মদিন আজ, ৪ অগস্ট। রেডিও-টিভি-সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রদ্ধার্ঘের ঢল দেখে আমারও মনে পড়ে গেল একটা ঘটনা। কিশোর মনে দাগ কেটে যাওয়া ঘটনা।
বোধহয় আটাত্তর কি ঊনআশি, আমি বারো-তেরো বছরের। বাবা তখন মাইথনে পোস্টেড। ওখানে কোয়ার্টার্স, রাঁধুনি-মালি আছে, বাবা সপ্তাহে বেশিটা ওখানে থাকেন, ছুটিছাটা ও উইকএন্ডে আসানসোলে চলে আসেন। টানা কয়েক দিন ছুটি পেলে আমরা যাই। পাহাড়ি জঙ্গলের মাঝে বেশ সময় কেটে যায়।
কালীপুজোর পর এক শনিবার রাতে বাবা এসে জানালেন, পরের শনিবার চিরকুন্ডায় কিশোর-আশা নাইট হচ্ছে, ফলাও আয়োজন। অতবড় প্রোগ্রাম নাকি সে তল্লাটে কখনও হয়নি। রাতভর গান চলবে, বোম্বের আরও সব নামজাদা নাচিয়ে-গাইয়ে থাকবেন। স্থানীয় জাঁদরেল শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা পণ করেছেন, আসানসোল, রানিগঞ্জ-ধানবাদের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেবেন। উদ্যোক্তাদের মাথা হলেন গিয়ে বিশিষ্ট শিল্পপতি বজরং আগরওয়াল, যিনি আবার বাবার বিশেষ পরিচিত। মাইথনে এসে বাবার হাতে চারটে প্রিমিয়াম গেস্ট কার্ড ধরিয়ে বলে গেছেন, “আপকো আনাহি চাহিয়ে ফ্যামিলি লেকর। মাস্ট। ইয়ে হমারে ইজ্জতকা সওয়াল বেনার্জি সাব।”
“যাবে নাকি?”– মাকে শুধোচ্ছেন বাবা, “তা হলে শনিবার সকালে সবাই চলে যেও, নরেশকে পাঠিয়ে দেব, আমি আর আসব না। কিশোরকুমার-আশা ভোঁসলেকে একদম সামনে থেকে দেখবে! একেবারে ফার্স্ট রোয়ে বসাবে বলছে।”
মা কিছু বলার আগে আমি হাঁই হাঁই করে উঠেছি, “যাব, যাব, যাব।”

তখন আমাদের সবে সবে পাখা গজাচ্ছে। হিন্দি সিনেমার সব গান ঠোঁটস্থ, পড়তে বসলেও পাশে ট্র্যানজিস্টর খোলা, তাতে গমগমিয়ে রেডিও সিলোন। কিশোর, রফি, মান্না, মুকেশ, জেশুদাস, লতা, আশা, হেমলতা …. বুধবার রাত আটটায় বিনাকা গীতমালার আমিন সাহানি মিস মানে পাঁজরা খসে যাওয়া। সদ্য কিশোরকুমারের খাইকে পান বানারসবালা বিনাকায় জোর টক্কর দিচ্ছে, হাটে-বাজারে, স্কুলে-কলেজে, পুজো-মচ্ছবে সর্বত্র ডনের ভাঙখেকো গান বিরাজমান।
সেই কিশোরকুমার!! ওররে বাব্বা..!
মা নিমরাজি। ঠাকুমা বেঁকে বসেছেন, “হোইয়া ধুমধাড়াক্কা নাসন-কোঁন্দন দ্যাখনের লগে আমি যামু না। তরা যা গিয়া।”
আমার হাজার অনুরোধেও ঠাকুমা নারাজ। “কীর্তন হইলে যাইতাম, রবীন্দ্রসঙ্গীত হইলেও দৌড়াইতাম। সবি (ছবি) বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন শুনসস? সুসিত্রা মিত্ররে দেখসস?”
কে বোঝায়, কিশোরকুমারের চিঙ্গারি কোই ভড়কে কিংবা ও মাঝি রে এ সবের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়?
যা-ই হোক, পরের শনিবার নরেশদার গাড়ি চড়ে দুপুরের মধ্যে আমি আর মা মাইথনে। রাত ন’টায় প্রোগ্রাম শুরু, আমরা আটটার মধ্যে খেয়েদেয়ে রেডি। অফিসের ড্রাইভার নরেশদা থাকে কুমারধুবি, সন্ধের আগে ডিউটি সেরে কেটে পড়ে। বাবা ওকে বলেছিলেন আজ আমাদের সঙ্গে বসে গান শুনতে, একটা কার্ড তো নষ্ট হবে! রাজি হয়নি। “রাতভর উয়ো গানা-উনা হমে নহি শুননা সাব। ঘর যাকে নিঁদ যানা।”
অগত্যা বাবার হাতে স্টিয়ারিং। কালো রঙের মার্ক টু অ্যাম্বাস্যাডর পৌনে ন’টা নাগাদ যখন চিরকুন্ডার অনুষ্ঠানস্থলের কাছাকাছি, দূর থেকে মহা উত্তেজিত শোরগোল শুনে বাবা স্পিড কমালেন, “ব্যাপার সুবিধার মনে হচ্ছে না। কী হলো?”
স্বাভাবিক। আসানসোল-চিরকুন্ডা-ধানবাদের ওই ‘কয়লাঞ্চলে’ যখন-তখন যা খুশি হতে পারে।
বাবার পাশে বসে আমিও উৎসুক চাউনিতে রাস্তা স্ক্যান করছি। শেষ হেমন্তের আধো কুয়াশায় সামনেটা স্পষ্ট নয়, তবে কিছু যে একটা ঘটেছে পরিষ্কার। “এই জন্য এ সব ঝামেলার জায়গায় আসতে চাই না।”– পিছন থেকে ফুট কাটলেন মাতৃদেবী।
বোঝা গেল খানিক বাদে। বাঁধভাঙা জলস্রোতের মতো জনতা ধেয়ে আসছে মহা কোলাহল তুলে। গুন্ডা-মস্তান নয়, সব সাধারণ লোক, পরিবার পরিজন সমেত। মহিলা-বাচ্চাদের নিয়ে দলে দলে হইহই করতে করতে আগুয়ান। এবং সবচেয়ে আশ্চর্য, অধিকাংশের মাথায় ঘাড়ে একটা-দু’টো চেয়ার।


যেন চেয়ারের ঢেউ বইছে সড়ক জুড়ে!
বাবা রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে নেমে এক চেয়ারবাহীকে পাকড়ালেন, “ক্যা হুয়া ভাই? কঁহাসে আ রহে?”
– ফংশানসে সাব। শালেলোঁগ বোলেথে কিশোরকুমার আয়েঙ্গে, হজারো টিকটভি বেচ দিয়ে উসিকে নামপর। যাকে শুনা, উয়ো নহি আনেবালা। বদলেমে কাঁহাসে এক বিকাশকুমারকো লাকে চড়হা দিয়া স্টেজপর, শালে মাইক লেকে বুঢঢে লোমড়িকে তরহা ভোঁক রহে। হমভি লওট চলে কুর্সি উঠাকে।”
সর্বনাশ! কিশোরকুমারের গান শোনার জন্য টিকিট কেটে গিয়ে শোনে, কিশোর আসবে না, তার বদলে কোথাকার কোন এক বিকাশকুমার স্টেজে উঠে বুড়ো শেয়ালের মতো হুক্কাহুয়া করছে! শ্রোতারা রেগেমেগে চেয়ার তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরছে।
“বোঝো কাণ্ড!”– মা খেপে লাল, “কী সব লোকজন! ফেরো, ফেরো। এক্ষুনি দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগবে।”
বাবার চোখ কোঁচকানো, “স্ট্রেঞ্জ! বজরংরা তো এমন দু’নম্বরি করার লোক নয়! দে আর রেপুটেড পিপল।”
মায়ের গজরানি শুনতে শুনতেই গাড়ি ছোটালেন সামনে। উল্টো দিক দিয়ে হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে ভিড়ে ঠাসা ট্রেকার, সব ঝরিয়া, ধানবাদ, কুলটি, আসানসোল, চিত্তরঞ্জন থেকে ফাংশন দেখতে এসেছিল। তাদের মাথাতেও দড়ি দিয়ে বাঁধা চেয়ারের স্তূপ। কয়েকটা প্রাইভেট গাড়িও দেখলাম, চেয়ার মাথায় করে ফিরছে।
বিশাল মাঠে অতিকায় চাঁদোয়া খাটানো, আলো ঝলমল সুসজ্জিত অনুষ্ঠানস্থলের সামনে এসে গাড়ি থামল যতক্ষণে, ইতস্তত দাঁড়িয়ে থাকা আয়োজকরা ছাড়া বিশেষ কেউ নেই। বাবার গাড়ি দেখে এগিয়ে এসেছেন লম্বাচওড়া বজরং আগরওয়াল, “আনফোরচুনেট বেপার হোয়ে গেলো বেনার্জি সাব।”

বিধ্বস্ত উদ্যোক্তার মুখে যা জানা গেল, অনিবার্য কারণে কিশোর-আশার টিম আজ আসতে পারেনি, কাল আসবে জানিয়েছে। শেষ মুহূর্তে খবরটা পেয়ে ওঁরা স্টেজে উঠে অ্যানাউন্স করেছিলেন, এমনকী ফাউ হিসেবে নিয়ামতপুরের বিশিষ্ট কিশোরকন্ঠ বিকাশকুমারকে মঞ্চে উঠিয়েছিলেন শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করাতে। শালারা এত কিছুর দামই দিল না, উল্টে বিকাশকুমারের উদ্দেশে এন্তার খিস্তি আর জুতো-ফুতো ছুড়ে চেয়ার ঘাড়ে করে ফিরে গেল! “আপ জানতে হ্যায়, কিতনে তকলিফসে হমলোঁগ লাস্ট মোমেন্টমে বিকাশকুমারকো অ্যারেঞ্জ কিয়া! উনহে ট্রিপল চার্জ দেনা পড়েগা, জুতে খানেকে লিয়ে একস্ট্রা।”
– কাল প্রোগ্রাম হবে কী করে? সব চেয়ার তো হাপিস!
বজরং জানালেন, সে চিন্তা করতে হবে‌ না, অর্গানাইজারদের টাকার অভাব নেই। কালকের মধ্যে দু’হাজার চেয়ার এসে যাবে। “আসলি চিজ হ্যায় রেপুটেশন। ইজ্জত।”– মায়ের দিকে তাকিয়ে হাতজোড়, “পহেলিবার ম্যাডামজি ইঁহা আয়ি, আউর অ্যায়সে দেখ লি, তো হমারে প্রেস্টিজ মিট্টিমে মিল গ্যয়ে না!”
কাল অবশ্যই আসব, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাবা ছাড়ান পেলেন। ফিরতে ফিরতে মা’র মন্তব্য, “আবার কাল? পাগল নাকি? আর পরশু আমার স্কুল, কাল বিকেলেই ফিরব।”
কালীপুজো-ভাইফোঁটার পর মায়ের স্কুল খুলে গেছে, আমারও। সামনে দাঁত খিঁচোচ্ছে অ্যানুয়াল। কিন্তু তাই বলে মুঠোয় এসেও কিশোরকুমার ফস্কে যাবেন? হতে দেওয়া যায়?
প্রবল আপত্তি জুড়লাম। মাতৃদেবীর ব্যাক্যবাণ থেকে আমাকে আড়াল করলেন বাবাই, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, কাল আসা যাক। কিশোরকুমার, আশা ভোঁসলে বলে কথা! আমারও তো দেখার ইচ্ছে সেন্ট পার্সেন্ট। সোমবার সক্কাল সক্কাল নরেশ তোমাদের আসানসোল পৌঁছে দেবে।”

বিস্তর ঘ্যানঘ্যানানিতে মা রাজি হয়েও সংশয়াকূল, “কালও আসবে কি না দ্যাখো। সন্দেহ আছে।”
না, আর অঘটন ঘটেনি। পরদিন, মানে রবিবার রাতে কিশোরকুমার এসেছিলেন, স-কন্যা আশা ভোঁসলেও। রাত ন’টা থেকে একদম সামনের সারিতে বসে শেষরাত পর্যন্ত গোগ্রাসে গিলেছিলাম স্বপ্নের গায়ক-গায়িকার গান। এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে, সাদা প্যান্টের উপর বাহারি চকরাবকরা ফুলছাপ রঙিন কলারতোলা পাঞ্জাবি পরে দামাল কিশোর স্টেজে উঠতেই তুমুল হর্ষোধ্বনি আর করতালির সঙ্গে ভেসে আসা খাইকে পান বানারসবালা গাওয়ার অনুরোধের ঝড়। রিকোয়েস্টের ঠেলায় দু’বার ওঁকে একই গান গাইতে হল। শেষে একটু বিরক্ত হয়েই বকুনি দিলেন, আরে ভাইলোঁগ, কুছ সিরিয়াস গানেভি তো শুন লিয়া করো কভি কভি…
বলেই নিজস্ব অনুনকরণীয় ভঙ্গিতে স্টেজের উপর থেবড়ে বসে ‘আ চলকে তুঝে, ম্যঁয় লে কে চলুঁ, এক অ্যায়সে গগনকে তলে…যঁহা গমভি না হো, আঁশুভি না হো, বাস পেয়ার হি পেয়াআআর পলে..ইক অ্যায়সে গগনকে তলে..’
দমবন্ধ হয়ে অডিয়েন্স শুনছে, মন্ত্রমুগ্ধ। অসামান্য গায়কীর ঐন্দ্রজালিক বিচ্ছুরণে সব চাপল্য স্তব্ধ। সুরজকি পহেলি কিরণসে.. আশাকা সবেরা জাআআগে… চান্দাকি কিরণসে ধুকর.. ঘনঘোওওর আঁন্ধেরা ভাগে….কভি ধুউউপ খিলে, কভি ছাঁআআও মিলে…
মাথা নিচু করে শুনছেন আশাজিও, পাশে মেয়ে বর্ষা ভোঁসলে। কিশোরকণ্ঠের মায়াবী জাদুতে কোন এক স্বপ্নের জগতে ভেসে চলেছে সবাই। শেষ করেই ধরলেন, ‘ঘুঙরু কি তরহাআআ..বাজতাহি রহা হুঁ ম্যঁয়.. কভি ইস পগ মে, কভি উস পগ মে, বজতাহিইইই রহা হুঁ ম্যঁয়য়য়….।’
সুরের ভেলায় চড়ে শ্রোতারা ভাসছে। আর ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠ একের পর এক ঝরিয়ে যাচ্ছে মণিমুক্তো।
এই পর্বে পর পর শুনেছিলাম উয়ো শাম.. কুছ আজীব থি/ শামহা হ্যায় সুহানা সুহানা…নশে মেঁ জাহান হ্যায়/ মুসাফির হুঁ ইয়ারো, না ঘর হ্যায় না ঠিকানা/ পল পল দিল কে পাস..তুম রহতি হো/ কোই হোতা জিসকো আপনা..হম আপনা কহে লে তে ইয়ারোঁ/ বড়ি শুনি শুনি হ্যায়..জিন্দগি ইয়ে জিন্দগি/ কুছ তো লোগ কহেঙ্গে..লোগোঁকা কাম হ্যায় কহেনা/ ও সাথী রে.. তেরে বিনা ভি ক্যা জি না/ নদিয়া সে দরিয়া..দরিয়া সে সাগর….ইত্যাদি। বাদ যায়নি প্রেমনগর ফিল্মের দেবদাসমার্কা ফাটাফাটি পিস ‘ইয়ে লাল ইয়ে রং..কব মুঝেএএ ছোওওড়েগা’র মতো অবিস্মরণীয় সৃষ্টিও। ঘরের কাছে চাসনালা খনি দুর্ঘটনা নিয়ে বচ্চনের সুপার ডুপার ফিল্ম ‘কালাপাত্থর’ তখন রিলিজ হয়েছে কি হবে, ইক রাস্তা হ্যায় জিন্দগি অলরেডি তুলকালাম হিট। সেটা পেশ করার আগে মৃতদের উদ্দেশে প্রণাম জানালেন।
আর সব মনে না থাকলেও এটুকু আছে যে, মঞ্চে থেবড়ে বসা অবস্থায় এ দফার শেষ গানটি ছিল মেহবুবার সুপারহিট– মেরে নয়না.. শাওন ভাদোঁ.. ফিরভি মেরা মন প্যায়সা…ফিরভি মেরা মন প্যায়সা….
অনির্বচনীয় সে অনুভূতি। খোলা আকাশের মতো দরাজ কণ্ঠে সওয়ার হয়ে স্বর্গীয় সুরের ঢেউ ঠোক্কর খেয়ে ফিরছে প্রেক্ষাস্থল জুড়ে। দর্দ ভরাআআআ ইয়ে…. গীইইত কঁহাআআআসে,..ইন হোঁওওঠোওওও পে আআয়েএএএএএএএএএএএএএএএএএএএ….. দূউউউর কঁহিইই লেএএ যাআআয়ে..
বাঁ মুঠোয় মাইক্রোফোন, দু’চোখ বোজা, ডান হাত আকাশমুখো তুলে উদাত্ত কণ্ঠ যখন মোক্ষম টানটা মারল, সম্মোহিত অডিয়েন্স সাড় ফিরে পেয়ে হাততালির সাইক্লোন।
সত্যি, শিল্পী বটে! ভগবান প্রতিভা উজাড় করে দিয়েছেন! অন্তিমে খুব আলতো করে ‘ফিরভি মেরাআআ মন প্যায়সাআআ’র মোলায়েম স্পর্শেরই বা তুলনা কোথায়?
বিভোর শ্রোতাকুলকে অবশ্য মুগ্ধতা রোমন্থনের সুযোগ দেননি। ‘প্যায়সাআআ’র রেশ থাকতেই লাফিয়ে উঠে আশাজির হাত ধরে চালু ‘এক ম্যঁয় ওউর এক তু..দো নো মিলে ইসতরহা..অউর যোহ, তন মন, মে হো রহা হ্যায়, ইয়ে তো হোনা হি থা..’
হাততালি, চিৎকারে কান পাতা দায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, চেয়ারের ফাঁকে ফাঁকে দর্শকদের উদ্দাম নাচ চলছে তালে তালে। কিশোরও নাচছেন দুলে দুলে, ‘আররে, দেখা না হায় রে..শোচা না হায় রে..রাখদি নিশাঁনে পে জাআআআন..তারারা তারারা পমম.. কদমোঁমে তেরে, নিকলে মেরা দিল..হ্যায় বাস এঁহি আরমাআআন..আরে ওওওওহহ, কুকুর কুউরুউউহহ…ওলেওলেওলেহ হেহে হেহে..ট্যাঁও ট্যাঁও, ট্যাঁও ট্যাঁও’..
চটুল রিদমের দোলায় শ্রোতৃমণ্ডলীতে উচ্ছ্বাসের টাইফুন। যা তুঙ্গে উঠে পড়ল, যখন আশা ধরলেন ওঁর কালজয়ী ‘পিয়া তুউউউউউউউউউ…অব তো আযা..আহহা হা আহহা হা..ষোওলাসা মন দহকে আকে বুজাযা..আহহা হা..আহহা হা..তনকি জ্বলা, ঠান্ডি হো যায়ে, অ্যায়সে গলে লগা যা..আহহ হাহা..আহহ হাহা..আহহ হাহা… মনিইইকাআআআআআ….ওও মাই ডার্লিং…।’
মানে, ফুল মস্তি যাকে বলে।
আশাজি এই সিরিজে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিলেন হরেকৃষ্ণ হরেরাম ফিল্মের সেই বিখ্যাত আইটেমে– দম মারো দমমম… মিট যায়ে গমমমম.. বোলো সুবহো শাআআমমমম.. হরে কৃষ্ণ হরে রাম…হরে কৃষ্ণ হরে রাম…
শ্রোতৃমণ্ডলীর উচ্ছ্বাস এবার টর্নেডো হয়ে লন্ডভন্ড করে দিল চারপাশ। শরীরে শিহরণ জাগানো শ্রিলিং ভয়েসে ধ্বনিত হচ্ছে উদ্ধত, দিগভ্রান্ত, বেপরোয়া যৌবনের অভিমানী অনুযোগ, ‘দুনিয়ানে হমকো দিয়া ক্যায়া?.. দুনিয়াসে হমনে লিয়া ক্যায়া?.. হম সবকে পরওয়া করে কিঁউউ.. সবনে হমারা কিয়া ক্যা!!… আআ হাআআ হাআআহাআ…’
জিনাত আমনের মতো তামাম অডিয়েন্সও যেন ড্রাগের নেশায় বুঁদ। সুরের মাদক, ঐশ্বরীয় কণ্ঠের হেরোইন।

প্রাণ ভরে গান শুনেছিলাম সে রাতে। প্রচুর বাঙালি শ্রোতা থাকার সুবাদে বাংলাও বাদ‌ যায়নি। পরাণ ঢেলে কিশোর গেয়েছিলেন নয়নো সরসী কেন/ ও গো নিরুপমা/ কী আশায় বাঁধি খেলাঘর/ একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে প্রভৃতি। আশাজির সঙ্গে দুরন্ত সব ডুয়েট– ঢলে যেতে যেতে/ যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে..। লালকুঠির সর্বব্যাপী ‘কারও কেউ নইকো আমি..কেউ আমার নয়’ গাওয়ার সময় নিজেই বাচ্চা ছেলে হয়ে গেলেন, ‘তুমি কে? তোমার নাম কী? তোমার বাড়ি কোথায়?’
কিম্ভুত সে কণ্ঠস্বর আর মুখভঙ্গি দেখে সবাই হেসে কুটিপাটি।
মনে পড়ে, আশাজি ‘চুরালিয়া হ্যায় তুমনে যো দিলকো.. নজর নহি চুরানা সনম’ ধরার আগে কাচের গ্লাসে চামচ ঠুকে টুং টাং বাজালেন চুমকি বসানো শেরওয়ানি, পাগড়িধারী এক দীর্ঘকায়, সুদর্শন, তরুণ গায়ক, নাম জানি না কিংবা তখন জানলেও এখন ভুলে গেছি। গানটায় রফির কণ্ঠ নকল করে উনি বেড়ে গেয়েছিলেন, তারিফও কুড়িয়েছিলেন বিস্তর। ‘তাআআরেএএএএএ.. ভোলানো গেলো না কিছুতেই..’ গাইতে গাইতে আশাজি হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে স্টেজ ছেড়ে নেমে এলেন দর্শকের মাঝে। আর ডনের মারকাটারি ‘ইয়ে মেরা দিল.. প্যার কা দিওয়ানা’র সময়ে ডেকে নিলেন মেয়ে বর্ষাকে। মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে কয়েকটা করে লাইন মেয়ের গলায়, দু’জনে মিলে ফের নাচিয়ে দিলেন অডিয়েন্সকে।
অন্তিম পর্বে ফের কিশোর-আশা হিন্দি যুগলবন্দির ফুলঝুরি, একের পর এক হিট। সব বিস্তারিত লেখা সম্ভব নয়, শুধু একটারই কথা বলব। জখমি ছবির তোলপাড় ফেলা ‘জ্বলতা হ্যায় জিয়া মেরা, ভিগি ভিগি রাতোঁমে.. আ যা গোরি, চোরি চোরি, অব তো রহা নেই নহি যায় রে.. হুঁ হুঁ হায় রে, হায় রে, হায় রে..।’
দুই অসামান্য কণ্ঠের মূর্চ্ছনায় মদির আবেশে মাখামাখি শ্রোতাকূল, আনখশির রোমান্টিকতার শিরশিরানি অঙ্গে অঙ্গে। এত সিরিয়াসলি গেয়েছিলেন, চোখ বন্ধ করে শুনলে মনে হবে সিনেমাহলে বসে রাকেশ রোশন-রিনা রায়ের সিনটি দেখছেন। অনবদ্য, তুলনাহীন। আশাজি-ই হাত নেড়ে অডিয়েন্সের করতালির ঝড় সামাল দিলেন, “ব্যাস, ব্যাস, অনেক ধন্যবাদ, মেনি মেনি থ্যাঙ্কস। অব প্রোগ্রাম খতম করনা হ্যায়।”
অনুষ্ঠানের শেষের আগের গানটি কিশোর ধরলেন আশাজির গলায় গলা মিলিয়ে, ওঁদের চিরকালীন হিট– লে যায়েঙ্গে, লে যায়েঙ্গে, দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে..। আর লাস্ট আইটেম বাপ্পি লাহিড়ির সুরে ওঁর সোলো সুপারহিট– চলতে, চলতে.. মেরে ইয়েএএ গীইইত.. ইয়াদ রখনা.. কভি আলবিদা না কহে না, কভি আলবিদা না কহে না…
হাত নাড়তে নাড়তে মিলিয়ে গেলেন মঞ্চের ওধারে।
রাত তখন সাড়ে চারটে পার। মাইথন ফিরে রাতজাগা চোখে আসানসোল, স্নান করে খেয়ে-দেয়ে স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের কাছে চুটিয়ে গল্প।
সত্যি অসামান্য, অনন্য, অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। দুই কিংবদন্তীকে কয়েক হাত তফাত থেকে এ ভাবে চাক্ষুষ দর্শনের ঘোর কাটতে বহু দিন লেগেছিল।
একটা কথা না বললেই নয়। সত্যি-মিথ্যে যাচাই করা হয়নি, বজরং আগরওয়াল পরে জানিয়েছিলেন, আগের‌ রাতে ক্ষিপ্ত হয়ে ফিরে যাওয়া বহু লোক রবিবার ফাংশন‌ শুনতে এসে চেয়ার ফেরত দিয়ে গেছেন।
ভাবা যায়?