মিষ্টি বিতরণ চলছে গলিতে গলিতে, কোথাও আবার অকাল হোলি। মিডিয়ার দৌলতে ওঁরা সবাই জেনে গিয়েছেন, এক ঐতিহাসিক আদেশ দিয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। “পতিতাবৃত্তি একটি আইনি পেশা এবং যৌনকর্মীদের অবশ্যই মর্যাদার সাথে আচরণ করা উচিত (prostitution is a legal profession and sex workers must be treated with dignity)।” মিডিয়ায় আলোড়ন শুরু হয়ে গিয়েছে। পাতা ভরিয়ে তারা জানিয়ে দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট যৌন ব্যবসাকে বৈধ ঘোষণা করেছে। এ এক ঐতিহাসিক রায়— বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ফুটে উঠছে সেই কথা।
কিন্তু সত্যি কি নতুন কিছু বলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত? যদিও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত চালু আইন নিয়ে নতুন কোনও কথা হয়নি, যা হয়েছে সেটা পর্যবেক্ষণ। তবে যা স্পষ্ট ভাবে উঠে এসেছে, তা হল, যৌনপেশাকে ঘিরে মানবাধিকার সংক্রান্ত কিছু নির্দেশ।
দেখা যাক, গত ২৫ মে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা ঠিক কী বলেছেন। সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতি, এল নাগেশ্বর রাও, বি আর গাওয়াই ও এ এস বোপান্নার বেঞ্চ বলেছে, যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, তাঁদের গালমন্দ করা চলবে না। এজন্য গোটা দেশের পুলিশ বাহিনীকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। কোর্ট বলেছে, এই দেশে নাগরিকদের যে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, প্রশাসন যেন ১৯৫৬ সালের ইমমরাল ট্রাফিক (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট লাগু করার ক্ষেত্রে তা মনে রেখে চলে। কোনও যৌনকর্মী যদি যৌন হিংসার শিকার হন, তাহলে নির্যাতিতাকে দ্রুত চিকিৎসা ও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। বিচারপতিরা বলেছেন, ‘‘এটা দেখা গিয়েছে, যৌনকর্মীদের প্রতি পুলিশের মনোভাব অনেক সময়েই হিংস্র, যেন তাঁরা এমন একটা শ্রেণি যাঁদের অধিকার স্বীকৃত নয়। পুলিশ ও আইনরক্ষাকারী সংস্থাগুলিকে যৌনকর্মীদের অধিকার সম্পর্কে মানবিক হতে হবে। কারণ, সংবিধানে ২১ তম ধারায় সব নাগরিকের জন্য মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যৌনকর্মীদেরও সেই অধিকার রয়েছে।’’ ফলে পুলিশ যাতে যৌনকর্মীদের অযথা বিরক্ত না করে, সেকথা স্পষ্ট করে জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। পাশাপাশি, গ্রেফতারি, তল্লাশি ও উদ্ধারকাজের সময় যৌনকর্মীদের পরিচয় যাতে প্রকাশিত না হয়, সে জন্য প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়াকে একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করার জন্য বলা হয়েছে। উদ্ধারকাজ চলাকালীন গ্রাহকের সঙ্গে যৌনকর্মীর ছবি প্রকাশ না করা কথাও বলেছেন বিচারপতিরা।
এছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। যেমন, রাজ্য সরকারগুলিকে শেল্টার হোমগুলি নিয়ে সার্ভে করতে বলা হয়েছে। কারণ, যদি কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটক করা হয়ে থাকে, তবে সেই বিষয়ে পর্যালোচনা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মুক্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য জানিয়েছেন বিচারপতিরা। তাঁরা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দিয়েছেন, যৌনকর্মীদের অধিকার ও এই পেশার আইনগত অধিকারের দিকটি নিয়ে সচেতন করতে ওয়ার্কশপ করা হোক। এই পেশা সংক্রান্ত আইনে পুলিশের কী অধিকার ও বাধ্যবাধকতা রয়েছে, ওয়ার্কশপে তা-ও জানিয়ে দেওয়া হোক। আইন অনুযায়ী কোন বিষয়ে ছাড় রয়েছে, কোনটা নিষিদ্ধ— তা জানানো হোক যৌনকর্মীদের।
যৌনকর্মীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে শীর্ষ আদালতের বিচারপতিদের নির্দেশের পর অকাল হোলি স্বাভাবিক ঠিকই। কিন্তু পতিতাবৃক্তি সংক্রান্ত আইনি জটিলতার অবসান সুপ্রিম কোর্টের সেদিনের নির্দেশের পরও স্পষ্ট হয়নি। এই বিষয়ে কয়েকটি তথ্য সামনে আনা যেতে পারে। তা হল, ভারতে বহুদিন থেকেই যৌনবৃত্তি বা পতিতাবৃত্তি বৈধ। ১৯৫০ সালে নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের ঘোষণাপত্রে ভারত অনৈতিক ট্রাফিক (প্রতিরোধ) আইন বা ITPA ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে। তার উপর ভিত্তি করে ১৯৫৬ সালে অল ইন্ডিয়া সাপ্রেশন অফ ইমমরাল ট্রাফিক অ্যাক্ট (SITA) সংশোধিত হয়। সেই আইনে পতিতাবৃত্তি বিকাশের বিভিন্ন দিককে ক্রমান্বয়ে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে ভারতে পতিতাবৃত্তিকে সীমিত এবং শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত করার চেষ্টা করা হয়। ভারতে যৌনপেশা বৈধ হয়েও আইনের চোখে ঘুরিয়ে অবৈধ করে রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, Prostitution is legal in India. A number of related activities including soliciting, kerb crawling, owning or a brothel, prostitution in a hotel, child prostitution, pimping and pandering are illegal.
সেদিন সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু মূল পেশা ও তাকে ঘিরে বিভিন্ন বাধাকে নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানায়নি। যতটুকু জানিয়েছে, তা হল, দেশের অন্য নাগরিকদের মতো যৌনকর্মীর মানবাধিকার সংক্রান্ত দিকটি। পাশাপাশি, পুলিশের অধিকার ও বাধ্যবাধকতা, যৌনপেশায় কোথায় বৈধতা রয়েছে কোথায় নিষেধ— তা-ও যৌনকর্মীদের জানিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে সর্বোচ্চ আদালত। এই মামলায় রায় এখনও সামনে আসেনি। আজও পতিতাবৃত্তি সমস্ত বাধা নিয়েই বিদ্যমান। যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির মুখপাত্র মহেশ্বতা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, আগামী জুলাই মাসে এই মামলায় কেন্দ্রীয় সরকার কী অবস্থান নেয়, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা।
দেখা যাক, দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বক্তব্যকে কীভাবে দেখছে ও যৌনপেশা নিয়ে তাদের দাবিগুলিকে কী ভাবে সামনে রাখছে।
মহেশ্বতার বক্তব্য, কোনও প্রাপ্তবয়স্ক যৌনকর্মী যিনি স্বেচ্ছায় এই পেশায় রয়েছেন, তাঁকে পুলিশ হেনস্থা করবে কেন, সে প্রশ্ন দুর্বার বারবার তুলে এসেছে। ফলে যৌনকর্মীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে যে কথা বলেছেন বিচারপতিরা, তাতে তাঁরা খুবই খুশি। পাশাপাশি, যৌনকর্মীদের সম্মান বজায় রাখার ব্যাপারে আদালতের বক্তব্যে তাঁরা আনন্দিত। মহেশ্বতার মতে, যৌন পেশার স্বীকৃতি আজও সেভাবেই রয়েছে, যেখানে একজন মহিলা নিজের রোজগারে নিজে খেতে পারবেন। কিন্তু যখনই তাঁর রোজগারের উপর অন্য কেউ নির্ভরশীল হবে, যেমন ১৮ বছরের উর্ধ্বে কেউ (বাবা-মা-সন্তান) তখনই সেটা অপরাধ হিসেবে গ্রাহ্য হবে। দুর্বারের মতে, যৌনকর্মীরা তাঁদের পরিবার পালনের জন্যই মূলত এই পেশায় আসেন। ফলে জটিলতা রয়েই গিয়েছে। পেশাকে এখনও পুরোপুরি ভাবে বৈধতা দেওয়া হয়নি। এই পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে আজও ধোঁয়াশা রয়েই গিয়েছে। তবে তাঁর মতে, আশার কথা হল, যৌনকর্মীদের বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করার আগে যৌনকর্মীদের সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করার কথা বলেছে কোর্ট। যা একটি ইতিবাচক দিক। মহেশ্বতা জানান, অতীতে সরকার যৌন পেশার সঙ্গে জুড়ে থাকা আইনের বিভিন্ন দিকের সংশোধনী আনার চেষ্টা করলেও যৌন কর্মীদের সংগঠনের মতামত জানতে চায়নি। যেমন, ২০০৬-এ ইউপিএ জমানায় ইমমরাল ট্রাফিক (প্রিভেনশন) অ্যাক্টে একটি ধারা যোগ করার পরিকল্পনা হয়েছিল। সেটা হল, গ্রাহকদের উপর অপরাধের জাল বিছানো। কেন তিনি যৌনকর্মীর কাছে আসছেন, সেজন্য তাঁকে অপরাধী হিসেবে তুলে ধরা। পরিবর্তে সলিসিটিংকে অপরাধ হিসেবে গ্রাহ্য না করার কথাও ভাবা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত অবশ্য এই বিষয়গুলি বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এই সময়ে যৌনকর্মীদের সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার এই ধরনের আইন নিয়ে পদক্ষেপ করলে সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
Khub valo lekha hoyeche.point gulo thik vabei address korechen.Dhonnobad.