পর্ব ১৩

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

চলা শুরু। পশুর নদী পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। যেতে হবে শিবসা নদীর খাল নিশানখালীতে।

আজকে পরিচয় করাবো আমার একজন সাথীর সঙ্গে। আমার ভিডিওগুলি যাঁরা নিয়মিত দেখেন, তাঁদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। সবার প্রিয়পাত্রও বটে। আমরা যে এগারোজন মিলে ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলাম, তার মধ্যে সে-ও একজন। আমার অনেক সফরের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী। সবদিকে তাঁর খেয়াল। আমাদের রান্নাবান্না, ট্রলার চালানো— সবটাই নিজের কাঁধে তুলে নেন বেলায়েত ভাই। আমি যখন সুন্দরবন নিয়ে কাজ শুরু করেছি, তার বছর দুই পরে একদিন আচমকাই পরিচয় হয় বেলায়েত সর্দারের সঙ্গে। আমি তখন মংলায়। গিয়েছিলাম এক সোর্সের কাছে। রাতের বেলা দেখা হলো সেই সোর্সের সাথে। আমি যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলছি, সেই সময় পাশেই এক কোণায় বেলায়েত অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছিল। বেলায়তকে দেখিয়ে আমার সোর্স আমাকে বললো, “ওই যে ছেলেটাকে দেখছেন, ওর নাম বেলায়েত সর্দার। সুন্দরবনকে একেবারে হাতের তালুর মতো চেনে। পরিচয় করবেন নাকি? ” আমি তো হাতে চাঁদ পেলাম। সুন্দরবন তখন আমার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর হাতের কাছে এমন একটা ছেলে যে সুন্দরবনকে এমন ভাবে চেনে— তার সঙ্গে আলাপ করবো না?

কথা হল বেলায়েতের সঙ্গে। তার দু’দিন পরে আমি নিজে গেলাম বেলায়েত বাড়ি চিলা বাজারে। চা পানি হল, গল্প হল।  পরিচয় নিবিড় হল বেলায়েতের সাথে। জানতে পারলাম অনেক কিছু। মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে উপেক্ষা না করেও বলতে পারি— বেলায়েত হয়তো সুন্দরবন উপকূলের একজন প্রান্তিক মানুষ, কিন্তু  তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি, যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার ক্ষমতা যে কোনও মানুষের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। বেলায়েত সর্দারের ছোটবেলা সুখের নয়। বলা ভাল সংগ্রামের। মা, ছোট ভাই, বোনের দায়িত্ব সেই ছোটবেলায় তুলে নিতে হয় বেলায়েতকে। সেই সময় তার বয়স বারো কি তেরো। স্ট্রাগল! আমাদের জন্য কমন একটা শব্দ। তবে বেঁচে থাকার সত্যিকারের লড়াই কাকে বলে, সেটা বোঝা যায় সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষগুলিকে দেখলে। ওই বারো বছর বয়স থেকে বেলায়েত সর্দারকে একটাই কাজ করতে হয়েছে। খাবার জোগাড়ের কাজ। যেভাবে হোক। সেটা শুধু নিজের জন্য নয়— তাঁর মা, ভাই, বোনের জন্য। চটপটে, বুদ্ধিমান আর মিশুক হওয়ায় মংলা এলাকায় বেলায়েতের পরিচিতি ছিল ভালই। বিশেষ করে সাংবাদিকদের সঙ্গে। অনেক সময় অনেক সাংবাদিকের সঙ্গে ও চলে যেত সুন্দরবনের গহীনে। যখন জানতে পারলো আমিও সুন্দরবনের গহীনে যাই, জলদস্যুদের সঙ্গে দেখা করি— আর বিশেষ কিছু বলতে হয়নি। বেলায়েত রাজি হয়ে গেল আমার সঙ্গী হতে।  ব্যাস, তারপর থেকে আমার সঙ্গে। কত বছর কেটে গেছে। আজও বেলায়েত আমার খুব প্রিয় মানুষ। বেলায়েতের একটা ছোট ট্রলার ছিলো। ওটাই ওর জীবন, ঘরবাড়ি। কিছু সময়ের জন্য আমারও। বেলায়েত আর আমি কতদিন ওই ট্রলারে করে সুন্দরবনের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি। কতদিন ওই ট্রলারে রাত কাটিয়েছি তার হিসাব নেই। আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব ভাল। আমাকে দেখলেই সে যেন বুঝে যায় আমার কী চাই। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, বেলায়েত কিন্তু আমার কোনও সোর্স নয়, সঙ্গী। অনেকে ভাবেন, বেলায়েত বোধহয় আমার সঙ্গে জলদস্যুদের যোগযোগ করিয়ে দিত।  কিন্তু মজার কথা হল, অনেক সময় জলদস্যুদের ডেরায় পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত সে জানতো না আমরা কোথায় যাচ্ছি।

বেলায়েতের ছোটবেলা কেটেছে অনেক সংগ্রামের মধ্যে। ক্ষুধার জ্বালায় যে কাজ পেয়েছে, করেছে। সব মিলিয়ে কিন্তু আমার চোখে বেলায়েত একজন আদ্যোপান্ত সৎ মানুষ। দীর্ঘদিন সুন্দরবনে কাজ করার কারণে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। অনেকেই আমাকে সহযোগিতা করেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আমার নাম করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই অভিযোগ কোনওদিন বেলায়েত সর্দারের নামে আসেনি। আমার একটা ফোন, বেলায়েত হাজির। যত কাজ থাক। সবটাই পরে দেখা যাবে। সব কাজ ফেলে বেলায়েত হাজির মোহসীনের কাছে। আর বেলায়েত না থাকলে মোহসীনের মনে হয়, কী যেন নেই। সুন্দরবন অভিযানে আমার সবচেয়ে প্রিয় হল, বেলায়তের রসবোধ আর ঠাট্টা ইয়ার্কি। সময় কী করে কেটে যায়, বুঝতেই পারি না।     

যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। আমরা কোথায় যাচ্ছি সেই জায়গার কথা কেউই জানতাম না। এমনকি আমিও না! শুধু হাকিম ভাই জানতেন আমাদের পথ। জোংড়া খাল দিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের ট্রলার। জোয়ার আসবে রাত বারোটায়। সেই ভরা জোয়ারে পার হতে হবে চিপার খাল। অন্য সময় ট্রলার নিয়ে সেই পথে যাওয়া বিপজ্জনক। চিপার খাল শুধু নামে নয়, সত্যি সত্যি বেশ সরু। ভরা জোয়ার না থাকলে ওই খাল দিয়ে নৌকা বা ট্রলার নিয়ে যাওয়া যায় না। এই চিপার খালে একটা কাণ্ড ঘটেছিল। খালটি দিয়ে বেশ কিছুটা এগোনোর পরে হঠাৎ একটা  বিশাল আকৃতির গোসাপ এসে পড়লো ট্রলারের উপর। ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম সেদিন।

কিন্তু আসল ভয়ের আরও বাকি ছিল। সেই রাতে ভরা পূর্ণিমা। গভীর রাত। তার মধ্যে  চাঁদের আলোর মোহময়ী রূপ। এমনিতেই আমাদের ট্রলারটি ছোট।  এগারোজনকে বেশ কষ্ট করে বসতে হয়েছে। কিন্তু সেই রাতে গহীন বনে আলোর ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় মনটা ভীষণ ভাল হয়ে যাচ্ছিল। চাঁদের আলোয় সুন্দরবনকে দেখতে দেখতে বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে এসেছি। সামনেই চিপার দোয়া। ওই জায়গায় রামপালের রতন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

হঠাৎ কানে এল গুলির শব্দ। কি হল! হকচকিয়ে গেলাম আমরা! কে গুলি ছুড়লো ? কিন্তু আমাদের তো পিছানোর উপায় নেই। এগিয়ে যেতে হবে।  যা থাকে কপালে বলে এগিয়ে চললাম। আর একটু এগিয়ে দেখি

একটি ডাকাত বাহিনী সেখানে দাঁড়িয়ে। হাতে বন্দুক। জেলে বহরে তাদের জন্য ভাত রান্না হচ্ছিলো।

-কারা আপনারা? উল্টোদিকের ট্রলার থেকে একজন একটু হুমকির সুরে জিজ্ঞাসা করলো।

জবাব দিলাম, আমি সাংবাদিক মোহসীন।

-এতজন কেন ?

বললাম, মাছ ধরতে এসেছি। বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরবো।

বিশ্বাস করলো না আমার কথা। হম্বিতম্বি শুরু করলো। তবে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমার সহযাত্রীরাই উল্টে ওদের বকাবকি করছে। কী ব্যাপার! আমাদের মধ্যে একজন বললেন, এটা একটা ছোট ডাকাত দল। আমি চুপ করে গেলাম। আমার সহযাত্রীদের ধমকে মনে হয় ডাকাত দল একটু ঘাবড়েই গেল। 

কয়েক সেকেন্ড পরে দেখি, ওদিক থেকে নড়াচড়ার শব্দ। ছেলেগুলি সব ধুপধাপ করে ট্রলার থেকে নেমে জঙ্গলে চলে গেল। আমি চিৎকার করে ওদের ডাকলাম। বললাম ভাত খেয়ে যান। একজন সাড়া দিলো, থাকলে গোলাগুলি করা লাগবেনে।  বলতে বলতে জঙ্গলে হারিয়ে গেল ওরা। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ওরা এভাবে পালালো কেন?

সেটা ছিল জয়নাল বাহিনী। ওই পাঁচ ছয় জনের একটি দল। সুন্দরবনে এমন বহু দল ছিল।  ওই রাতে জেলে বহরে খাওয়াদাওয়া করতে এসেছিল ওরা। আমাদের শব্দ পেয়ে একটি ফাঁকা গুলি চালায়। ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু গুলির শব্দ পাবার পরেও আমাদের ট্রলারটি ওদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পূর্ণিমার রাতে সবটাই দেখা যাচ্ছিল। ওদের হাতে বন্দুক দেখেও আমরা এগিয়ে যাওয়াতে ওরাই উল্টে ভয় পায়। একটি ছোট ট্রলার। আর ট্রলার ভর্তি লোক! ওদের থেকে লোকবল বেশি। ওদের ধারণা হয়েছিল, আমরা বোধহয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর লোক। তাই ওরা নৌকা থেকে নেমে তাড়াহুড়া করে জঙ্গলে চলে যায়।

বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। চলতি পথে একটি ডাকাত দলকে দেখা হয়ে গেল। রাত সেখানে কাটলো। পরদিন সকালের ভাটায় রওনা দিলাম আবার। যাবো শিবশা নদীতে। কিন্তু আদাচাই এর ভাড়ানি পার হতেই আমাদের আটকে দিলেন বনবিভাগের কর্মীরা।  অনিশ্চিত হয়ে পড়লো দস্যুনেতা ইলিয়াসের কাছে যাওয়া।

(ক্রমশ )

2 COMMENTS

  1. বেশ ভালোই লেগেছে এই পর্ব পড়ে। আমাদের বেলায়েত সর্দারের সঙ্গ পাওয়া,এত ঝড়ঝাপটার পরেও এত হাসিখুশিতে জীবন সত্যিই অসাধারণ বেলায়েত ভাই।
    আপনাদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল। ভালো থাকুন ভাইয়্যা।

  2. সালাম বড়ো ভাই এই কর্মজজ্ঞ যে নিজেকে রক্ষা করে করতে পেরেছেন এটাই বড়ো অর্জন রক্ষা করেছেন সুন্দর বন কে স্বাভাবিক জীবন উপহার দিয়েছেন অনেককে
    আপনার কথা স্বরনে রাথবো আমরা সবাই।
    ০১৭১৪৭৬৭৪২০ এটা আমার নাম্বার
    ছোট ভাই মনে করে ফোন দিলে খুব খুশি হতাম

Comments are closed.