(কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানী ডঃ সৌরভ ব্যানার্জী কাজ করছেন Human disease, African sleeping sickness নিয়ে। মাঙ্কিপক্স নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের মধ্যে বালিহাঁস-এর পাঠকদের সামনে তিনি এই ভাইরাসঘটিত রোগটির বিভিন্ন দিককে তুলে ধরেছেন।)

কিছুদিন আগের কথা। কেমব্রিজে একটা সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। হঠাৎ করেই সেল ফোনে বিজ্ঞপ্তি পেলাম, ইউনাইটেড কিংডম হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সি মাঙ্কিপক্সের (Monkeypox) দুটি নিশ্চিত কেস শনাক্ত করেছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে দুটি কেসই একই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁরা একটি বিশেষ সংক্রামক রোগ কেন্দ্রের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার অধীনে রয়েছেন। আমরা সবেমাত্র কোভিড ট্রমা থেকে উঠেছি, তাই এই নতুন রোগটি বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত চাপ ও আতঙ্ক তৈরি করতে চলেছে। ফলে সদ্য ছড়িয়ে পড়া এই সংক্রমণ সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।


আমাদের মনে প্রথম যে প্রশ্নটি আসবে, তা হল, মাঙ্কিপক্স কী?
মাঙ্কিপক্স হল, একটি “ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ ভাইরাস” যা “পক্সভিরিডে”পরিবারের “অর্থোপক্সভাইরাস” গণের অন্তর্গত এবং পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার কিছু অংশে সংক্রমিত বন্যপ্রাণী থেকে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণত, ভেক্টরের মধ্যে ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালির মতো প্রাণীরা অন্তর্ভুক্ত। কোনও সংক্রমিত প্রাণীর কামড়ে বা তার রক্ত, দেহরস, চামড়া, ক্ষত স্পর্শ করলে মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে এই ধারণাও রয়েছে যে এটি সংক্রমিত প্রাণী থেকে রান্না করা মাংস খাওয়ার মাধ্যমেও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এটি কি নতুন ভাইরাস?
না। জেনে রাখা ভাল, ভাইরাসটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। গবেষণার জন্য রাখা বানরদের মধ্যে পক্স-সদৃশ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। তাই নাম এর নাম দেওয়া হয় ‘মাঙ্কিপক্স’। পরবর্তীতে, প্রথম মানব মাঙ্কিপক্সের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৭০ সালে, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে।
চিকেন পক্স এবং গুটিবসন্ত থেকে রোগটি কতটা আলাদা?
এটা খুব সহজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে মানুষ এই রোগটিকে পক্স সম্পর্কিত আরও দুটি রোগের সঙ্গে তুলনা করবে। যাই হোক, মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের সময় জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া এবং ক্লান্তির মতো লক্ষণগুলি শুরু হয়। সাধারণত, ফোস্কা/গুটি তৈরি হওয়ার লক্ষণগুলির বিকাশ ঘটতে ৭ থেকে ১৪ দিন সময় লাগে এবং তা কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হয়। ফলে সংক্রমিত ব্যক্তির কোনও উল্লেখযোগ্য লক্ষণ না থাকলেও প্রথম অবস্থাতে এটি একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ফুসকুড়ি বা rash সাধারণত মুখের উপর প্রথম দেখা যায়, তারপর শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এটি উত্থিত দাগ হিসাবে শুরু হয়, যা তরল ভরা ছোট ফোস্কায় পরিণত হয়। এই ফোস্কাগুলি শেষ পর্যন্ত স্ক্যাব তৈরি করে যা পরে শরীর থেকে ঝরে যায়।
গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন দুর্বল মানুষদের ক্ষেত্রে কেসগুলি গুরুতর। এসব বিবেচনা করলে রোগটি গুটিবসন্ত এবং চিকেন পক্সের মতোই মনে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে আলাদা বৈশিষ্ট্য হল, মাঙ্কিপক্স সংক্রমণে ফুলে যাওয়া গ্রন্থি/লিম্ফ নোড।
এই ভাইরাস কীভাবে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়?
একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য একজন সুস্থ ব্যক্তির দেহে সংক্রমণ দেহরস, হাঁচি-কাশি, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ড্রপলেট, আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ, সংক্রমিত ব্যক্তির ত্বকের ক্ষত বা সংক্রমিত ব্যক্তির দ্বারা ব্যবহৃত দূষিত বস্তুর মাধ্যমে সহজেই ছড়াতে পারে।


মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব কি প্রায়শই ঘটছে?
বিগত কয়েক বছরে, বিশ্বব্যাপী মাঙ্কিপক্স আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। এখন মনে করা হয়, গুটিবসন্তের টিকা বন্ধ করার পর সমস্ত সম্প্রদায়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের কারণে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে।
২০১৭ সালে নাইজেরিয়া ৫০০টিরও বেশি সন্দেহভাজন কেস এবং ২০০টি নিশ্চিত কেস-সহ একটি বৃহৎ প্রাদুর্ভাবের সম্মুখীন হয়েছিল। যার মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ৩%। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, তারা তখন থেকে প্রতি বছর সক্রিয় কেসগুলির প্রতিবেদন/ রিপোর্ট প্রস্তুত করছে।
২০০৩ সাল থেকে আমেরিকায় মাঙ্কিপক্সের বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে যা ঘানা এবং নাইজেরিয়া থেকে আসা ভ্রমণকারীদের সাথে যুক্ত ছিল। আমাদের প্রতিবেশী দেশ সিঙ্গাপুরেও ২০১৯ সালে এই রোগ দেখা গিয়েছিল।
এই বছরে কত দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে?
১৩ মে, যুক্তরাজ্য প্রথম দু’টি মাঙ্কিপক্সের কেস রিপোর্ট করেছে। প্রায় দু’ডজন দেশে ৪০০-র মতো সন্দেহভাজন ও অ্যাক্টিভ কেস সামনে এসেছে। এর মধ্যে ব্রিটেন ছাড়াও রয়েছে স্পেন, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশ। রোগটি আমেরিকা, আর্জেন্টিনা, কানাডা, ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং অস্ট্রেলিয়াতেও দেখা গিয়েছে।

আমাদের দেশ এই মুহূর্তে কতটা নিরাপদ?
কোভিড থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। আমরা এখন জানি যে ভাইরাসঘটিত রোগগুলিকে প্রথম থেকেই খুব গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এখনও পর্যন্ত, আমাদের দেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের কোনও নিশ্চিত ঘটনা রিপোর্ট করা হয়নি। তবে আমাদের খুব সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ, এই বছর এই রোগটি অন্যান্য দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, এই রোগের স্থানীয় অঞ্চলগুলির সাথে যুক্ত যে কোনও ভ্রমণ ইতিহাসের উপর নজর দেওয়া উচিত। যেমন নাইজেরিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল যারা প্রতিদিন কেস রিপোর্ট করছে। তাই আগামী দিনে আমাদের দেশেও এর কেস রিপোর্ট হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে এবং এয়ারপোর্টগুলিতে যথাযথ নিরীক্ষণ ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।

সতর্কীককরণ:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু নির্দেশিকা দিয়েছে। অবশ্যই আতঙ্কিত না হয়ে সেগুলি পালন করা উচিত। যদি একজন ব্যক্তি সংক্রমিত হন, তবে তাকে অবশ্যই আইসোলেশনে রাখতে হবে।
ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য ত্বকের ক্ষত থেকে নিশ্চিতকারী পিসিআর পরীক্ষা করা যেতে পারে।
অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনে স্পেশালিস্ট হাসপাতালে ভর্তি হন।
সাবান এবং জল দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুয়ে নিন/স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন।
যথাযথ ভাবে রান্না করা মাংস খান।
সংক্রমিত ব্যক্তি বা মাঙ্কিপক্সের মতো লক্ষণ রয়েছে— এমন কারও সাথে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
বন্য প্রাণীর মাংস স্পর্শ করবেন না। খাবেনও না। বন্যপ্রাণী থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।
আক্রান্ত ব্যক্তির বিছানা ব্যবহার এড়িয়ে চলুন।
আশার আলো?
জেনে রাখা ভাল যে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ সংক্রান্ত অসুস্থতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুতর হয় না। রোগী কয়েক সপ্তাহ পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। রোগীর উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করা হয়। এই রোগের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুটিবসন্তের চিকিৎসার জন্য উপলব্ধ অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধগুলি উপকারী হতে পারে, বৃহত্তর স্বার্থে আমি এই ওষুধগুলির নাম এখানে প্রকাশ করছি না। গবেষণার মাধ্যমে দেখা গিয়েছে, গুটিবসন্তের টিকা এই রোগের বিরুদ্ধে প্রায় ৮৫% বেশি সুরক্ষা দিতে পারে। তাই ব্রিটেনের ক্লিনিকাল বিশেষজ্ঞরা এখন সংক্রমিত ব্যক্তিকে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন।
যদিও এটি একটি বিরল রোগ তবে বিজ্ঞানীরা সংক্রমণ এড়াতে পরিস্থিতির উপরে গভীর ভাবে নজর রাখছেন।