রিহ্যাবের রাতদিন- পর্ব ১

জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নানা বয়সের মানুষ। সকালে-বিকেলে। শীতে বা গরমে। বর্ষায়। না! বর্ষায় তো জানালা বন্ধ। উপরের ছাদে মেলে রাখা জামা গেঞ্জি বারমুডা গামছা। ধোঁয়া ওড়ে। আকাশে মিলিয়ে যায়। বারোয়ারি ‘কিচেন’। রান্না হয়। নীচে একতলায় অফিসঘর। বাড়ির লোক আসে। অসম্ভবের প্রত্যাশায়। আলুথালু ভাবে। জামাকাপড়় নিয়ে আসে। ব্যাগে। পেস্ট-চিরুনি-তেল-বিস্কুট। কখনও দেখা হয়। কখনও হয় না। আবার ফিরে যাওয়া শূন্য ঘরে। কেউ নিয়ে যায় কাউকে। বাড়ীতে। মেয়াদ শেষ। আপাতত। কুচো কুচো খুশি ছড়িয়ে পড়ে। এবার হবে। সব ঠিক হবে। আগের মতো। আর পাড়ায় মাথা নিচু করে থাকতে হবে না। অনুষ্ঠানে পার্বণে সপরিবার যাওয়া যাবে। আবার! আগের মতো! আত্মীয়-স্বজন যেতে বলবে আবার। চোখে চোখ রেখে কথা বলা যাবে আবার! আয়নার সামনে দাঁড়ানো যাবে আবার। সাজা-গোজা। পরিপাটি হওয়া যাবে আবার! চুলে শ্যাম্পু আবার। দাঁড়ি কামানোর কথা মনে থাকবে রোজ। জায়গার জিনিস জায়গায় থাকবে আবার! আবার পছন্দের মাছ আসবে বাড়িতে। রান্না হবে আগের মতো। সব জানালা খোলা থাকবে সারাদিন। হাওয়া খেলবে। রোদ আসবে লাফিয়ে লাফিয়ে! আবার বাঁচা যাবে তুমুল। হয়তো! হ…য়…তো!  এইসব ইতিবাচক কথা মাথায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। জানালা ধরে দাঁড়িয়ে অন্যরা। মলিন মুখে। এদের চলে যাওয়া দেখে ফ্যালফ্যাল করে। দিন গোনে! রণ-রক্ত-সফলতার গুদামে দাউদাউ আগুন জ্বালিয়ে এসেছে তো! এসেছে এইখানে। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ফিরবে বলে। সে গোছানো কখনও হয়। কখনও হয় না। তবু চেষ্টা চলে সকলের। এদের। নেশার ধিকিধিকি অথবা দাউদাউ আগুনে যাদের জ্বলে গিয়েছে সবকিছু। আয়-পত্তর, সমাজ-সংসার- বন্ধু-বান্ধব, শরীর-মন সবকিছু। তারাই আসে এখানে। এই ‘নেশামুক্তি কেন্দ্র’ গুলিতে।

দুই

ছিলাম কচুয়া মোড়ে। মহানন্দে। তুমুল আনন্দে। সেই সকালে বেরিয়েছিলাম বাড়ি থেকে। শান্তিতে একটু মদ খাবো বলে। বাড়িতে তো শান্তিতে খাওয়া যায় না! বেরোতেই হয়। কাজে। বা মহাকাজে!

তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম। তারপর সারাদিন শুধু ঠেকে ঠেকে ঘুরলাম। ভ্রাম্যমাণ পানাভ্যাস (Drink) আমার। পেটে খাবার নেই একটুও। খাওয়ার ইচ্ছেও নেই। কারণ, শরীর-মনে বানভাসি অবস্থা। সেই ঘোরে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধেয় কচুয়ায়। কচুয়া মোড়ের মানুষের খুব সুন্দর সময় ও সন্ধ্যা কাটছিল। আমার লীলাখেলা চলছে তখন। দল-মত-বয়স নির্বিশেষে লীলা বিতরণ চলছিল! 

হঠাৎই একটি আধা পরিচিত ছেলে ডাকল আমায়। 

-কি হয়েছে? (রসভঙ্গের বিরক্তি)

-একটু রাধাকেমিক্যালস যেতে হবে।

-কেন? (রাগ কম, বিরক্তি বেশি)

-এই নাও, কথা বলো(ফোন ধরিয়ে দেয়)

বাকি কথা ফোনে হল। অতল জলের আহ্বান। মদ-মাংস পুরোটাই ‘স্পনসর্ড’। মারে হরি বাঁচে কে! আমি লকলকে জিভ নিয়ে পোষা জন্তুর মতো উঠে পড়লাম একটু দরে দাঁড়ানো অটোয়। চল পানসি বানভাসি! তুরীয় আনন্দে আমি গান ধরলাম। কী সব সময় সব! আহা! আহা! কিছুক্ষণ বাদে আবিষ্কার করলাম রাধা কেমিক্যাল পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ! কৌতুহল! কোথায় যাচ্ছি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়? কী ব্যাপার ভাই? কোথায় যাচ্ছ?

-এই তো!  আর একটু!

-আরে ধোর! চল নামি! 

-পাঁচ মিনিট! এসে গিয়েছি!

নামলাম! একটা গলির মধ্যে। সাটার ওঠানো। সিড়ি উঠে গিয়েছে উপরে। আমিও উঠলাম। 

ওঠানো হল আমায়! দোতলা…তিনতলা! টেবিল-চেয়ার! টাকমাথা…বসা। 

-বসুন(একগাল হাসি)

-এটা কোন জায়গা? কোথায় নিয়ে আসলেন? কে বলল আনতে? মদ কোথায়? যারা ডাকল তারা কোথায়? (ঝাঁক ঝাঁক গুলি ছুটলো)

-আরে বসুন না! মদ খাবেন? আনিয়ে দিচ্ছি! (সৌজন্য)

-হ্যাঁ, আনান! দেবনাথদা কোথায়? আসতে বলল তো!

-কেন? আমাদের পছন্দ হচ্ছে না?

-চিনিই না আপনাকে! পছন্দ…! মদ আনান! খেয়ে সবাইকেই আত্মীয় মনে হয়! (ফর্মে ফিরলাম)

-সেকথাই তো বলছি! একটু বসুন। মদ আসছে!

-সাথে কী আছে? (যদিও আমার ‘সাথে’ কিস্যু লাগতো না!)

-দিচ্ছি! এই দাদাকে নিয়ে যা! (সন্দেহজনক আতিথেয়তা)

-আপনারা খাবেন না?( সৌজন্য আমিও হারাইনি!)

-আপনি শুরু করন। আসছি!

(আমি শুরু করলে আর কেউ পাবে না চাঁদু!!)

গেলাম অন্য একটা ঘরে। ‘শুরু’ করলাম। ‘শেষ’টা মনে নেই! কোনওদিনও মনে থাকতো না! হুশ ফিরলে এক বস্তা অপরাধবোধ! কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকতো না! কেউ কোথাও থাকতো না! মাথায়-বুকে আগুন। হু-হু জ্বলতো! কেউ নেই কোথাও। কিছু নেই। অপরাধবোধ ঢাকতে হবে তো! বুঝতাম, নিজের হাতে সযত্নে নিজের চিতা সাজাচ্ছি! করুণা …সহানুভূতি…প্রত্যাখ্যান! পোড়া ঘিয়ের গন্ধের মতো অসহ্য লাগতো। কী করব? এখন? কোথাও যাব? চলো নির্বোধ….চলো বুদ্ধিমান….চলো আবার আগুনে পুড়ি! আবার! ‘‘এই তো জীবন, কালীদা!’’ সংলাপ…নাটক…অজিতেশ…। ‘নানা রঙের দিনগুলি’….নাটক করতাম তো! যাক, সে কাহিনী পরে। অতএব, ‘শুরু’ করলাম। ‘শেষ’ মনে থাকল না! কে পাশে ছিল?…কারা ছিল? কে জানে! ‘জেগে উঠলাম’! রুপনারাযণের তীরে নয়, ছোট্ট এক ঘরে! ছোট্ট এক তোষকের পরে! জানিলাম, এ জগৎ মিছে নয়। পাইলাম প্রশ্নের জবাব। এ ঘোর বাস্তব, সংক্ষেপে ‘রিহ্যাব’!

(ক্রমশ)