মেঘালয়ের লোককথা

(এই লোককথাটি ১৯৭৫ সালে রমেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী এ.জি অফিসে কর্মরত পি আর পারিয়াত-এর কাছে শুনেছিলেন। ২০০৭ সালে এই একই কাহিনি আমি ওয়াহ ইউলিয়ম নদীর ধারে মওমুলাহ গ্রামের রুলবি সিনরেম-এর মুখে শুনেছি।)

 বহু যুগ আগেকার কথা, খাসি পাহাড়ের পাইনবনের ভেতরে মেলমো নামে একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল। ওই গ্রামে নিক ও সিং নামে দু’জন লোক বাস করত। ছোটবেলা থেকেই দু’জনের বন্ধুত্ব। সিং ছিল একজন ‘নং খাইস (মহাজন) আর নিক ছিল দরিদ্র দিনমজুর। কিন্তু অবস্থার তারতম্য সত্ত্বেও ওদের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো বাধা আসেনি। | নিক যে পাড়ায় থাকত, সেখানে প্রতিবেশীরা ওরই মতো কেউ বা দিনমজুর অথবা অন্য কোনো উপায়ে উপার্জন করে সাধারণ ভাবে দিন কাটাতেন। সিং-এর বাড়ি কিছুটা দূরে ছিল। নিক প্রতিদিন সিং-এর বাড়িতে গিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় আনন্দে কাটিয়ে আসত।

নিকের স্ত্রী লেক ওদের বিয়ের পর থেকেই সিং-এর কথা স্বামীর কাছে শুনে আসছে, কিন্তু ওদের দেখা হয়নি। একদিন লেক ওর স্বামীকে বলল, ‘‘সিং-এর বাড়িতে তুমি প্রতিদিন যাচ্ছ, কিন্তু ও একদিনও তো আমাদের বাড়িতে এল না।’’

নিকের মনে হল, লেক ঠিক কথাই বলেছে। পরদিন যখন সিং-এর সঙ্গে দেখা হল, নিক বলল, ‘‘সিং, তুমি একদিন আমাদের বাড়িতে এলে আমরা খুশি হব। আমার স্ত্রীর সঙ্গেও তোমার পরিচয় হবে। আমার মনে হয় ওর সঙ্গে কথা বলে তোমার ভাল লাগবে।’’ সিং কথা দিল, “নিশ্চয় একদিন যাব।’’

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ক’দিন থেকেই নিকের বড় কষ্টে দিন কাটছে। দিনমজুরের কাজ নেই। দিনরাত বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কাটতেও পারছিল না। ঘরে যা ছিল তা-ই দিয়ে ক’টা দিন চলেছে, আজ ওদের ভাড়ার একেবারে শূন্য।

নিক ও লেক্ ছোট্ট কুঁড়ের বারান্দায় বসে ছিল। হঠাৎ নিক দেখতে পেল, সিং আসছে। এই প্রথম সিং ওর বন্ধু নিকের বাড়িতে এল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিক ছুটে গিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল। লেকও খুব খুশি। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে সময় কাটল ওদের। তারপর লেক রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। নিক জানত ঘরে কিছু নেই। তাই কিছুক্ষণ পর নিকও উঠে ভেতরে গেল। নিককে প্রতিবেশীরা খুব ভালবাসতেন। তাই নিক লেককে প্রতিবেশীদের কাছে পাঠাল কিছু যদি পাওয়া যায়।

নিক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রইল। কিছুক্ষণ পর শূন্য হাতে লেক ফিরে এল। সবার ঘরেই অভাব, কে কী দেবে? নিক হতাশায় ভেঙে পড়ল। প্রিয় বন্ধুকে সামান্য কিছুও দিতে না পারার দুঃখ ও মেনে নিতে পারলনা। অক্ষমতার বেদনায় দিশেহারা হয়ে একটি ছুরি নিয়ে নিক নিজের বুকে বিঁধিয়ে দিল। লজ্জা ও দৈন্যের গ্লানি থেকে চিরদিনের মতো ও নিষ্কৃতি পেল।

চোখের সামনে এ ভাবে নিককে আত্মঘাতী হতে দেখে লেক উদভ্রান্তের মতো ছুরিটি নিয়ে স্বামীর অনুগামী হয়ে নিজেকে শেষ করে দিল।

এদিকে একা ঘরে বসে সিং ভাবছিল, কী হল এদের ? কোথায় গেল ওরা? কোনও সাড়াশব্দ নেই, কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। সিং আর বসে থাকতে না পেরে বাড়ির ভেতরে গেল। কেউ কোথাও নেই। নিকের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সিং রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, প্রিয় বন্ধু আর বন্ধুপত্নীর মৃতদেহ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অসহ্য কষ্টে সিং চিৎকার করতে চাইল, পারল না। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। সিং ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখল.. কোণে উনুনের উপরে একটি পাত্রে জল ফুটছে, কিন্তু পাত্রটিতে কোনো খাদ্যবস্তু নেই। শুন্যপাত্র দেখেই সিং বুঝতে পারল, কেন এদের এই আত্মহনন। এই ঘটনার জন্য ও নিজেকেই দায়ী করল। মুহূর্তের মধ্যেই সিং ছুটে গিয়ে লেক্-এর বুক থেকে ছুরি বের করে নিজের বুকে সেধিয়ে দিল।

সেই রাতেই একটি ক্ষুধার্ত মানুষ ঢুকে পড়েছিল একজন গৃহস্থের ঘরে, খাদ্যের অন্বেষণে। বাড়ির লোকেরা চোর ভেবে লোকটিকে তাড়া করল। উত্তেজিত জনতার হাত থেকে বাঁচার জন্য লোকটি নিকদের বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে ওখানে আশ্রয় নিল। অন্ধকারে চুপ করে বসে যখন বুঝতে পারল লোকেরা চলে গিয়েছে, তখন অবাক হয়ে ভাবল, এ বাড়ির লোকেরা কোথায়? কিন্তু লোকটি পরিশ্রান্ত ছিল মনে ভয় থাকলেও নীরব, নির্জন বাড়িতে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে, ঘরের এক কোণে শুয়ে পড়ল।

ভোরের আলো ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটির ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠেই দিনের আলোয় দেখতে পেল— ঘরের ভেতরে তিনটি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। প্রথমেই ওর মনে হল, বাড়ির লোকেরা এখনই জেগে উঠবে এবং ওরা ভাববে সেই এদের খুন করেছে। এর পরের অবস্থাটা কল্পনা করেই লোকটি দিশেহারা হয়ে সিং এর বুক থেকে ছুরিটা তুলে নিজের বুকে বিঁধিয়ে দিল।

মৃত্যুর শীতলতায় বাড়িটি স্তব্ধ হয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের লোকেরা ঘটনাটি জানতে পারল। লেক প্রতিবেশীদের কাছে সামান্য খাদ্যবস্তু চাইতে গিয়েছিল। তাই ওরা বুঝতে পেরেছিল এই আত্মহত্যার কারণটা কী?

আতিথেয়তার দায়ে এমন শোচনীয় ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেই নিয়ে গ্রামবাসীরা আলোচনায় বসল। আলোচনার শেষে স্থির হল, ঈশ্বরের কাছে ওরা ওদের আবেদন জানাবে।

পরদিন নদীর জলে স্নান করে, নির্দিষ্ট স্থানে বসে সমবেত কণ্ঠে গ্রামবাসীরা প্রার্থনা করল, ‘‘ হে করুণাময় ঈশ্বর, প্রাত্যহিক জীবনে অতিথি আপ্যায়ন করার জন্য সহজলভ্য কিছু খাদ্যদ্রব্য আমাদের দাও।’’

সর্বশক্তিমান ঈশ্বর প্রার্থনা পূরণ করলেন। তিনি নিক-এর দেহ থেকে পান, লেক-এর দেহ থেকে সুপুরি, সিং-এর দেহ থেকে চুন এবং অপরিচিত লোকটির দেহ থেকে তামাকপাতা তৈরি করে দিলেন। সেই দিনটি থেকে আজও খাসি পাহাড়ের প্রতিটি ঘরে টিমপৌ-কোয়াই (পান সুপুরি) দিয়ে অতিথিকে আপ্যায়ন করার রীতি প্রচলিত। বিদেশীকেও ওরা টিমপৌ কোয়াই’ দিয়ে আপন করে নেয়।