মেঘালয়ের লোককথা

বহুদিন আগের কথা। খাসি পাহাড়ে উ মানিক রাইতং নামে একটি যুবক ছিল। ছেলেটি বড়ই দুঃখী। মা-বাবাকে অনেকদিন আগেই হারিয়েছিল, তার আত্মীয়স্বজনের খবর কেউ জানত না। উ মানিক রাইতং খুব ভাল বাঁশি বাজাত। দিনের বেলা অপরিচ্ছন্ন পোশাকে মাঠে-কাদায় কাজ করত। সন্ধের পর বাড়ি ফিরে ভাল পোশাক পরে বাঁশি বাজাত। সঙ্গীবিহীন যুবকটিকে তখন মনে হত, প্রকৃতির রাজ্যে ও যেন সবাইকে আনন্দ দিয়ে নিজে আনন্দিত। ওর বাঁশিতে সব সময়েই করুণ সুর শোনা যেত। সেই সুরে আনন্দ-বেদনা একাকার হয়ে যেত। 

উ মানিক রাইতং যে-রাজ্যে বাস করত সেখানকার সিয়েমকে (রাজা) কাজের জন্য রাজ্যের বাইরে যেতে হয়েছিল। সেই সময় এক রাতে, উ মানিক রাইতং-এর বাঁশির সুরের মূৰ্ছনা রানির কানে পৌছল। বাঁশির সুরে যুগে যুগে নারীরা ঘর ছেড়েছেন, এই রানিও ঘর ছেড়ে উ মানিক রাইতং-এর দরজায় এসে করাঘাত করলেন। উ মানিক রাইতং তখন বিভোর হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিল। ফলে কিছুই শুনতে পেল না। রানি অপেক্ষা না করে ঘরে ঢুকে পড়লেন। বাঁশির সুর শুনে আগেই রানির মন চঞ্চল হয়েছিল, এই মুহূর্তে উ মানিক রাইতং-এর সুন্দর পোশাক এবং দীপ্ত চেহারা দেখে রানি মুগ্ধ হলেন। রানি নিজেকে নিবেদন করলেন উ মানিক রাইতং-এর কাছে। উ মানিক রাইতং রানিকে বোঝাতে চাইল, কিন্তু তিনি কোনো কথাই শুনতে চাইলেন না।

রানির সঙ্গে উ মানিক রাইতং-এর মিলন হল। প্রতি রাতেই রানি অভিসারে যেতেন। কিছুদিন পর রানি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। শিশুটির জন্মের আটমাস পরে রাজা ফিরে এলেন। রানির কোলে সন্তান দেখে রাজা প্রথমে বিস্মিত, তারপর ক্রদ্ধ হয়ে শিশুটির পিতার নাম জানতে চাইলেন। কিন্তু রানি নিরুত্তর।

রাজা একটি সভার আয়োজন করলেন। রাজা ঘোষণা করলেন, রাজ্যের সব পুরুষকে এই সভায় একটি করে কলা নিয়ে উপস্থিত থাকতে হবে। যথাসময়ে রাজ্যের পুরুষেরা সভায় এলেন। শিশুটিকে সভার মাঝখানে বসানো হল। একজন একজন করে পুরুষ এসে শিশুটিকে কলা দিতে চাইলেন, কিন্তু শিশুটি ওদের থেকে কলা নিল না। রাজার মনে হয়েছিল, শিশুটি ওর পিতাকে চেনে। শিশুটি যার হাত থেকে ফল নেবে সেই পুরুষই হবে ওর জনক। কিন্তু শিশুটির চোখ দেখে মনে হল, সবাই ওর অচেনা। রাজা জিগ্যেস করলেন, “কে আসেনি এই সভায়? আমার স্থির বিশ্বাস, কোনো একজন পুরুষ এখানে অনুপস্থিত।’’ একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘ উ মানিক রাইতং আসেনি! অনাথ ছেলেটি মনে দুঃখ নিয়ে একা একা ঘুরে বেড়ায়। ওকে আমরাই খবরটা জানাইনি।’

রাজা বললেন, “আমি কিছুই শুনতে চাই না। ও একজন পুরুষ, এটাই ওর পরিচয়, ওকে নিয়ে এসো। ’’

উ মানিক রাইতং যখন সভায় এসে দাঁড়াল, শিশুটি খুশি হয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। রাজা সমবেত জনতার সামনেই উ মানিক রাইতংকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন। উ মানিক রাইতং রাজাকে বলল, ‘‘আমার শেষ ইচ্ছে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরতে চাই।’’ রাজা ওর শেষ ইচ্ছেপূরণের ব্যবস্থা করলেন। চিতার আগুন জ্বলে উঠল। উ মানিক রাইতং স্নান করে, সুন্দর পোশাক পরে, বাঁশিতে করুণ সুর বাজাতে বাজাতে তিনবার অগ্নিকে প্রদক্ষিণ করল, তারপর বাঁশিটার মুখের দিকটা মাটিতে পুঁতে দিয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হঠাৎ সবাই দেখতে পেল, রানিও বসনে-ভূষণে সজ্জিতা হয়ে উ মানিক রাইতং-এর সঙ্গে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

উ মানিক রাইতং এবং রানির মৃত্যুর পর ওখানে একটি জলাধারের সৃষ্টি হল এবং সেখানে এক ধরনের বাঁশ গাছের জন্ম হল, যার আগের দিকটা মাটিতে এবং গোড়ার দিকটা উপরে। এই ধরনের বাঁশ গাছ এখনও দেখা যায়।

খাসি পাহাড়ে এই করুণ প্রেমকাহিনি আজও লোকমুখে শোনা যায়।