অবসাদ বা ডিপ্রেশন ঠিক কি? কাকে বলে ডিপ্রেশন, জীবনে কেনই বা আসে ডিপ্রেশন? কেন হঠাৎ করে আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়? মন খারাপ মানেই কি ডিপ্রেশন? এই ডিপ্রেশনের শিকার হয়েই কি অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়?  সেই সব নিয়ে আলোচনার আগে প্রথমে আমাদের জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মুহূর্তগুলিকে নিয়ে ভাবা যাক । 

প্রথম আসছে মানব জীবনের বিভিন্ন সম্পর্কের কথা। আমরা কেউই মেনে নিতে পারি না কোনও ভাঙনকে। সবাই চায় ভালবাসা ভরা এক পৃথিবী। অথচ সম্পর্কগুলো কী ভাবে কখন ভাঙতে শুরু করে নিজেদের অজান্তেই।  

আমাদের  একের পর এক সম্পর্কের ভাঙন থেকে ডিপ্রেশন আসতে বাধ্য । কিন্তু এই ভাঙনের জন্য নিজেরা কতটা দায়ী তা একবারও ভেবেছেন কি? যে বা যাঁরা সম্পর্কের মূল্য দিতে জানেন না, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কে না জড়ানোই ভাল। সম্পর্ক নিয়ে কখনও ছেলেখেলা করবেন না। আপনার মুহূর্তের আবেগে অন্য একজনের জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে।    

        আসলে প্রতিটি সম্পর্কেই থাকে দায়বদ্ধতা। আর সেই দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলতে শুরু করলেই সম্পর্কে সমস্যার শুরু। আর বর্তমানে কর্মব্যস্ত জীবনে সম্পর্ক নিয়ে সমস্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দিনের পর দিন ছোটখাটো বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে বেড়েই চলেছে সমস্যা। একটা সমস্যা কাটিয়ে ওঠার দু’দিনের মধ্যে শুরু হয়ে যাচ্ছে আর একটি নতুন সমস্যা। যে কোনও একটি সম্পর্ক শুরুতে ভাল থাকলেও, কয়েকদিন পর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। আগে যা হাসির ছলেই মিটে যেত এখন সেই একই বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে ঝামেলা, অশান্তি। কিন্তু কেন ?

আসলে মানুষের চাহিদার শেষ নেই , আর এই সুন্দর জীবনটাকে কোনওমতেই অন্যের সঙ্গে কখনও মেলাতে যাবেন না। কোন্ পরিবার কোথায় বেড়াতে গেল, কারা প্রতিদিন দামি রেস্তরাঁয় খাচ্ছে, কারা প্রতিদিন শপিং মলে গিয়ে ভিড় করছেন— এসব  নিয়ে আলোচনা হাস্যকর। আর এই তুচ্ছ বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে যদি প্রিয়জনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেন, তাহলে জীবনের মূল্য, ভালবাসার মূল্য, বন্ধুত্বের মূল্য বা সম্পর্কের কোনও দামই থাকে না। ভালবাসার জন্য, একটা সুন্দর সম্পর্কের জন্য বাহ্যিক এই জগতের কোনও মূল্যই থাকতে পারে না ।

এই পৃথিবী সুন্দর, আমাদের মনটা অনেক সুন্দর । সুন্দর মনের মূল্য বাইরের ওই সব মানুষগুলোর জীবনের চাইতে অনেক অনেক মূল্যবান। কোনও ভাবেই তাকে নষ্ট হতে দেবেন না। 

সম্পর্কে যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক দম্পতি যখন রেগে যান বা কোনও কারণে তাঁদের মধ্যে অশান্তি হয় তখন ধীরে ধীরে অনুভূতিগুলি নষ্ট হতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই কথা বলা বন্ধ করে দেন। এটি একেবারেই ভুল সিদ্ধান্ত। কেউ আবার রেগে গিয়ে মুখের ভাষা খারাপ করে ফেলেন। এক্ষেত্রে এমনটা না করে বরং সমস্যাগুলি নিয়ে কথা বলুন। যোগাযোগ একটি সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি প্রস্তর।

                একে অপরের সঙ্গে যত বেশি যোগাযোগ করবেন, পরস্পরকে যত বেশি করে বুঝতে পারবেন, দেখবেন আপনাদের সম্পর্ক তত উন্নত হবে। আপনি আপনার সঙ্গীর সঙ্গে আপনার চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিগুলি যত বেশি করে ভাগ করে নেবেন অর্থাৎ শেয়ার করবেন ততই ভুল বোঝাবুঝি কমতে থাকবে। যোগাযোগ সুখী সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি। যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন যে কোনও সম্পর্ককে মজবুত করতে সাহায্য করে।

আরও একটি বিষয় হল, সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকা বা সৎ থাকা খুব প্রয়োজন। এই সুক্ষ্ম জায়গায় চিড় ধরলে সহজেই একটি সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। আপনি আপনার কাছের মানুষটির প্রতি একটু মনোনিবেশ করুন এবং তার মনের কথা শুনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করুন— এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার মনোযোগ আপনার কাছের মানুষটির উপর বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করবে। তার মনের মধ্যে কী চলছে এবং প্রতিদিন তার জীবনে কী ঘটছে তা আপনি যখন শুনবেন তখন আপনি তাঁকে আরও ভাল ভাবে জানতে পারবেন। এর ফলে একটি সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হবে। আপনাকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে। এটি তাঁকে সম্পর্কে সুরক্ষার অনুভূতিও দেবে। কারণ, তিনি আশ্বস্ত হবেন যে তাঁর কথা শোনার জন্য এবং তাঁর অনুভূতিগুলি বোঝার জন্য আপনি সবসময়েই উপস্থিত।

             আর একটা ব্যাপার, যে কোনও সম্পর্কের গুরুত্ব তখনই বাড়ে যখন আপনি নিজেকে ভালবাসতে পারবেন। যে মানুষ নিজেকে ভালবাসতে জানেনা, সে কখনই অপরকে ভালবাসতে পারবে না। পাশাপাশি প্রয়োজন আত্মমর্যাদা বোধ। আত্মমর্যাদা আর অহং অর্থাৎ ইগো কখনওই এক নয়। একটা সুন্দর সম্পর্কে এই বিষয়টি না থাকাই শ্রেয়। আসলে মনের মধ্যে থাকা ছোটখাটো দ্বন্দ্ব, জিজ্ঞাসা বা চাহিদা থেকেই সমস্যাগুলি শুরু হয়। তাই আত্মমর্যাদা বোধ থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয়।

অনেকেই বলেন, আমার জীবনসঙ্গী মানে লাইফ পার্টনার আমাকে সময় দেয় না বা আমাকে গুরুত্ব দেয় না কিংবা আমাকে ছেড়ে ও চলে গেল। দেখুন, জোর করে আপনি কাউকে আটকে রাখতে পারবেন না। যে চলে যায়, তাঁকে যেতে দিন । ফেরার হলে সত্যিই সে আসবে। সম্ভব হলে মুখোমুখি বসে একবার আলোচনা করতে পারেন। যদি সে না ফেরে তা হলে মনে করবেন সে আপনার যোগ্যই নয়। তা ছাড়া খেয়াল রাখবেন, সম্পর্কের বাইরেও কিন্তু আপনার নিজস্ব একটি জগৎ রয়েছে। নিজেকে বেশি করে সময় দিন আর সঙ্গীকেও তাঁর নিজের মতো করে সময় কাটাতে দিন। জীবনে চলার পথে সব সময় দু’টো মানুষের আলাদা আলাদা জগৎ থাকে। সম্পর্কে রয়েছে বলে সব সময় আপনাকেই সময় দিতে হবে— এই দাবি করাও ঠিক নয়।  এতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সঙ্গীর মতামত গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন। আপনার মতামতও সঙ্গীকে বোঝান। এ ভাবেই একটি বিষয়ে মিলেমিশে দু’জনে জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তগুলি নেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে সম্পর্কও ভাল থাকবে, দু’জনের কাছে দু’জনের গুরুত্বও সমান থাকবে।

  আচ্ছা, আপনি আপনার কাছের মানুষটিকে সম্মান করেন তো ? একটা সুন্দর সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই আছেন, যাঁরা তাঁদের কাছের মানুষটিকে নিয়ে সবসময়ই সমালোচনা করেন, নেগেটিভ মন্তব্য করেন। এটা খুবই খারাপ ব্যাপার। অন্যের কাছে নিজের মানুষটিকে নিয়ে সমালোচনার করার চাইতে, তাঁর ভুল ত্রুটিগুলি নিয়ে তাঁর সঙ্গেই সুন্দর করে বিশ্লেষণ করুন। নইলে একটা সময় পর সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হতে বাধ্য। একটি স্বাস্থ্যকর ও সুখী সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য, অবশ্যই আপনার কাছের মানুষটির মতামত নিন এবং তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে শিখুন। আপনার সব ভাবনা বা সিদ্ধান্ত ঠিক আর তাঁর সবকিছুই ভুল— এমন ভাবলে কোনও সম্পর্কই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আর দীর্ঘদিনের একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে অবসাদ ধীরে ধীরে আপনাকে গ্রাস করতে পারে। সেজন্য নিজেকে ও কাছের মানুষটিকে ভাল রাখতে এবং ডিপ্রেশনের হাত থেকে বাঁচাতে পারস্পরিক সহযোগিতা ভীষণরকম প্রয়োজন।