পর্ব ৪৭

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

আগের পর্বে বলেছি, কী ভাবে সরু খালের মধ্যে দিয়ে চলার সময়ে একটা বাঘ আমাদের অনুসরণ করেছিল প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে। সাগর বাহিনীর সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় ওই ঘটনা ঘটেছিল।
এই সাগর বাহিনী ছিল মাঝারি আকারের একটি জলদস্যু দল। এই দলের নেতা সাগর নামে পরিচিত ছিল। তবে তার আসল নাম আলমগীর। বাড়ি মংলা অঞ্চলে পশুর নদীর পাশে সুন্দরবন ঘেঁষা একটি লোকালয়ে। আলমগীরের সঙ্গে আমার আগে পরিচয় ছিল না। তবে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন ছেলে তার সঙ্গে মিলে দস্যুতা করছে। এই ব্যাপারে আমি প্রথমে কিছু শুনেছিলাম, কানাঘুষো কয়েকজনের নামও জেনেছিলাম, কিন্তু সেখানে গিয়ে পরিচিত কয়েকজন ছেলেকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। ওদের জিজ্ঞাসা করলাম, কী মনে করে তোমরা জলদস্যু হলে? কথা শুনে বুঝলাম, ওদের একেক জনের কাহিনী একেক রকম। এর আগে ওদের কারও সঙ্গে পথেঘাটে আমার দেখা হয়েছে, কখনও দুবলার চরে দেখা হয়েছে, কখনও সুন্দরবনে মাছ ধরছিল— এরকম অবস্থাতেও দেখা হয়েছে। এদের মধ্যে হাসান নামে একজন আবার আমাদের সঙ্গে ঘুরেছেও কিছুদিন, মানে ট্রলারে করে যাতায়াত করেছে। ছেলেটিকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কেন দস্যুতার পথ বেছে নিলে? হাসান আমাকে বলল, ‘‘ভাই আমি মামলায় ফেরারি হয়ে গিয়েছিলাম।’’ আমি প্রশ্ন করলাম, ‘‘কোন মামলায় ফেরারি হয়ে গিয়েছিলে?’’ হাসান বলল, ‘‘ঈদের সময় ছোটখাটো একটা মামলা হয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। পুলিশের তাড়া খেয়ে এলাকা ছেড়ে দিয়েছিলাম। পালিয়ে চট্টগ্রাম চলে গেছি। এরপর আর কোর্টে হাজিরা দেওয়া হয়নি। পরে জানতে পারি, পুলিশ আমাকে খুঁজছে। এই অবস্থায় আমি আর এলাকায় ফিরবো কি করে? তখনই এই দস্যু দলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। ওরা বলল, তুমি এখানে চলে এসো।’’ হাসান ভেবেছিল, জামিন করতেও তো টাকাপয়সা লাগবে। সেই টাকাটাও হবে আবার লুকিয়ে থাকার একটা জায়গাও হবে। পুলিশ খুঁজে পাবে না। এই মনে করে দস্যুদলে নাম লিখিয়ে দিল সে। আমি বললাম, ‘‘তোমার যে টাকাপয়সা জোগাড় করার কথা ছিল, সেটা হয়েছে?’’ হাসান বলল, ‘‘না ভাই, সেটা হয় নাই। বরং জলদস্যু হিসাবে নাম ছড়িয়ে গেছে চারপাশে। ফিরে যাওয়ার পথ নাই।’’


আসলে প্রলোভন, বিপদে পড়া মানুষজন, ফেরার মানুষজন— তাদেরই একটা বড় অংশ সুন্দরবনে দস্যুতায় নাম লেখায়। এটা আমি অনেকবার, অনেক জায়গায় দেখেছি। সাগর বাহিনীর কথা বলতে গিয়ে ওই কথাগুলি মনে পড়ল। যাই হোক, সাগর বাহিনীর সঙ্গে আমি যখন দেখা করতে যাই, তাদের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৭-১৮ জন। তিনটে ডিঙি নৌকা নিয়ে তারা ডাকাতি করতো। মূলত লোকালয়ের খুব কাছাকাছি, পশুর নদীর এপাশে ওপাশে ঘোরাফেরা ছিল ওদের। ওখানকার জেলেদের কাছেই চাঁদাবাজি করতো ওই সাগর বাহিনী। এই বাহিনীতে ছিল বিভিন্ন মামলায় ফেরারিরা। তারাই এক জোট হয়ে দল গড়ে তুলেছিল।
আলমগীরের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তাদের অস্ত্র গোলাবারুদ কোথা থেকে আসে, কারা দেয় বা তারা এসব কিনেছে কিনা। আলমগীর জানালো, খুলনায় তার এক বন্ধু, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী তাকে প্রথমে দু’টো অস্ত্র আর কিছু গুলি দিয়েছিল। সেগুলি আলমগীরের হাতে তুলে দিয়ে সে বলে, তুমি ডাকাতি শুরু করো। পরে দস্যুতার টাকা দিয়ে আলমগীর তার ওই বন্ধুর থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ কেনা শুরু করে। এই করতে করতে ১৭-১৮টা বন্দুক, হাজার-বারোশো রাউন্ড গুলি জোগাড় করে ফেলেছে সাগর বাহিনী। মানে সুন্দরবনে দস্যুদল চালানোর মতো একটা অবস্থায় তারা পৌঁছে গেছে।
এবার সেই অবস্থা থেকে তারা যখন ফিরে আসার চেষ্টা করছিল, তারা তখন নানারকম বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সাগর বাহিনীকে। আমার সঙ্গে যোগাযোগের আগেও তারা সারেন্ডার করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যারা সাগর বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক ছিল— যেমন সেখানকার কিছু মাছ ব্যবসায়ী, কিছু RAB ও পুলিশের সোর্স— তারা তাদের নিরুৎসাহ করছিল। বলেছিল, তোমরা সারেন্ডার করতে যেও না। বিপদে পড়বে। পরবর্তীতে আলমগীর তার ছোট ভাইকে ঢাকায় আমার কাছে পাঠায়। তার ছোটভাই ঢাকায় একটা চাকরি করে। সে অফিসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে। এবং জানায় যে আলমগীর সারেন্ডার করতে চায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অংশ, তাদের সোর্স, কিছু মাছ ব্যবসায়ী এবং কিছু অবৈধ অস্ত্রের কারবারি তাকে আত্মসমর্পণ করতে দিতে চায় না। তারা আলমগীরকে বলছে, তুমি আরও অনেক দিন ধরে ডাকাতি করো। আরও অনেক টাকাপয়সা কামাও, তারপরে সারেন্ডার করো।
আসলে সাগর বাহিনী থাকাতে এই সব লোকেদের নিশ্চয়ই কিছু লাভ বা সুবিধা ছিল। আমি বারবার বলেছি, সুন্দরবনে দস্যুতার টাকা যায় কোথায়? মোট যে ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের মধ্যে আমি পাঁচ-ছয় জনকেও পাই না যাদের কাছে কয়েক লক্ষ টাকা আছে। তারা দেখি একেবারেই ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থার প্রান্তিক মানুষ। তার চেয়েও হয়তো খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে।


যাই হোক, এই সাগর বাহিনী নামের দস্যু দলটি সুন্দরবনের জোংড়া, ঝাঁপসি, মরাপশুর, ভদ্রা— এই অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতো। বেশ কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের উপর চড়াও হয়েছে, গোলাগুলিও হয়েছে— কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ধরতে পারেনি। যে দফায় আমরা বাঘের ঝুঁকির মধ্যে পড়লাম, তার মাসখানেকের মধ্যে সারেন্ডারের জন্য সাগর বাহিনীকে নিতে গিয়েছিলাম। রাতের বেলা ওদের যখন নিতে গেছি, সাগর বাহিনীর সদস্যরা তখন জোংড়া খালের ভিতরে ছোট বস্তা নামে একটা ছোট খালে অবস্থান করছিল। আমি খবর পেয়েছিলাম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গ্রুপ আমাদের অনুসরণ করছিল এবং তাদেরকেও অনুসরণ করছিল তাদের একটি সোর্সের মাধ্যমে। সেই সময় আমি অনুভব করতে পারছিলাম, যে কোনও সময়ে দস্যুদের কাছে আমাদের যাওয়ার পথে বাধা আসতে পারে। এমনকি, ফেরার পথে বাধা আসতে পারে অথবা দস্যুদলটির উপরেও আক্রমণ হতে পারে। যদি সাগর বাহিনীর সঠিক অবস্থান তারা জানতে পারে, তাহলে আক্রমণ হয়ে যাবে। কারণ, পাশাপাশি খালেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই গ্রুপটা অবস্থান করছে।
এই সব কাজে আমি এমন ভাবেই যেতাম যাতে কেউ দেখতে না পায়। সেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই গ্রুপটাকে বিভ্রান্ত করেছিলাম আমি। আমাদের মূল ট্রলারটিকে মাঝপথেই আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, ওই ট্রলারটির দিকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই গ্রুপটির নজর যাবে। ট্রলার ছেড়ে দিয়ে আমি দু’টো ডিঙি নৌকা নিয়ে সাগর বাহিনীর কাছে পৌঁছে যাই। তারপর রাতের বেলা চারদিকে একটু খোঁজখবর নিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে আসি। বরিশাল RAB-এর একটি ট্রলারও সেই সময় পশুর নদীতে অপেক্ষা করছিল। মানে আমরা রেখে এসেছিলাম। আমরা যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে ওই ট্রলারটিকে ডেকে নিই এবং সেখানে সাগর বাহিনীর সদস্যদের উঠিয়ে দিই।


সাগর বাহিনীর কথা আলাদা করে বলছি এই কারণে যে সুন্দরবনে সবই যে পেশাদার জলদস্যু-বনদস্যু ছিল, তা নয়। ফেরার মানুষ, বিভিন্ন মামলায় লুকিয়ে পালিয়ে বেড়ানো মানুষগুলির হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে একটি পক্ষ সুন্দরবনকে অস্থির করার চেষ্টা করতো। তাদের মধ্যে কিছু মাছ ব্যবসায়ীও ছিল— যারা এদের সহযোগিতা করতো এবং এদের ব্যবহার করে ওই অঞ্চলে মাছ, কাঁকড়া ধরার ব্যবসা করতো। একই সঙ্গে সাগর বাহিনীর নামে চাঁদা তুলতো অন্যান্য জেলেদের কাছ থেকে। ওই সব লোকেরা সেই টাকা নিয়ে সিংহভাগই নিজেদের কাছে রেখে দিত।
আমি অনেক বাহিনীকে সহজেই আত্মসমর্পণ করাতে পেরেছি। কিন্তু সাগর বাহিনীকে সহজে সারেন্ডার করাতে পারিনি। সেই ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল। যাই হোক, পরবর্তীতে তারা আত্মসমর্পণ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। সাগর বাহিনীকে নিয়ে একটা আলাদা উত্তেজনা ছিল। কারণ, তাদের সঙ্গে অনেকগুলি পক্ষ জড়িয়ে ছিল। যারা চাইছিল না এই বাহিনী সারেন্ডার করুক। আর সাগর বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে পারে— এই খবর পাওয়ার পর ওই সব লোকেরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল সারেন্ডার ঠেকানোর জন্য।
সাগর বাহিনীকে তাই এত গোপনে আমি নিয়ে এসেছিলাম যে সপ্তাহ খানেক ধরে কেউ জানতেই পারেনি গ্রুপটা সুন্দরবন থেকে উঠে এসেছে। পরবর্তীতে তারা RAB-এর হাতে যায় এবং সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে, অস্ত্র গোলাবারুদ জমা দেয়। এই ভাবে সাগর বাহিনী নামে দস্যুদলের বিলুপ্তি ঘটে।

(ক্রমশ)

1 COMMENT

Comments are closed.