টেলিভিশন, স্মার্টফোন, জামাকাপড় থেকে খাবারদাবার। নিদেন পক্ষে ঘর গোছানোর জিনিসপত্র। বাজারে যাওয়ার বদলে অনলাইনে অর্ডার দিলেই বাড়ির দুয়ারে হাজির। আর এই ব্যবসায় আমাজন, ফ্লিপকার্টের সঙ্গে এতদিন লড়াইয়ে নেমেছিল রিলায়েন্স। এবার তাতে শামিল হতে চলেছে টাটারাও।

শুধু অনলাইনে অর্ডারই বা কেন, এক ছাদের নীচে গুছিয়ে বাজার করার সুখানুভূতি দিতে যে সব ঝা চকচকে শপিং মল,  সেই ব্যবসাতেও দেখা যাবে টাটাদের।

এবার দেখা যাক, ভারতে রিটেল ব্যবসার অবস্থাটা ঠিক কী? রিটেল ব্যবসায় মূলত দু’টি দিক। একটি বাড়িতে বসেই বাজার করে নেওয়ার সুযোগ। অন্যটি সরাসরি দোকানে গিয়ে কেনা। একটি মার্কিন রিসার্চ সংস্থার মতে, এই সময়ে ভারতের রিটেল মার্কেট ৮০০ থেকে ১০০০ বিলিয়ন ডলারের। এবং এটি ক্রমাগত বাড়ছে। দুই ট্রিলিয়ন হওয়ার কথা ২০৩২ সালে। ই কমার্স, অর্থাৎ বাড়িতে বসেই জিনিস কিনে ফেলার যে অভ্যাস, সেটা নাকি ৩৫০ বিলিয়ন ডলার পার করে যাবে ২০৩০ সাল নাগাদ। এক বিলিয়ন ডলার মানে প্রায় ৭৫০০ কোটি টাকা। হিসেব বলছে, ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে, ভারতে বিক্রি হাওয়া ইলেট্রনিক জিনিসের তিনভাগের একভাগ, স্মার্টফোনের প্রায় অর্ধেক এবং পাঁচ ভাগের প্রায় এক ভাগ জামাকাপড় ই-কমার্সের সাহায্যে কিনেছেন ক্রেতারা।

একদা এর পুরোটাই ছিল ব্যক্তিগত মালিকদের আওতায়। ওই পাড়ার দোকান, বাজারের মুদি দোকান। ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, মোট বাজারের প্রায় ১২ শতাংশ অর্গানাইজড সেক্টরে আছে। একটু অবশ্য জেনে নেওয়া ভাল, অর্গানাইজড সেক্টর বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়? অর্গানাইজড রিটেল ব্যবসা বলতে বোঝানো হয়, মোটামুটি অনেক ধরনের জিনিস একই ছাদের নীচে, একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিক্রি করার ব্যবস্থা। এটাকে মল কিংবা সুপারমার্কেট, ডিপার্টমন্টাল স্টোর ইত্যাদি যে কোনও নামে ডাকা যেতে পারে।

২০১১ সালের পর সরকার অনেক বাধা নিষেধ তুলে দেওয়ায়, দেশবিদেশের বেশ কিছু কোম্পানি এই সেক্টরে এসেছে। যেমন আমাজন, ফ্লিপকার্ট, লেনস্কর্ট। তবে  ভারতে এই ব্যবসার সিংহভাগ অংশ দখলে রয়েছে রিলায়েন্স কোম্পানির। ২০০৬ সালে, এই ব্যবসায় পা রাখার পর থেকে ধীরে ধীরে তারা এই ক্ষেত্রে ভারতের এক নম্বর কোম্পানি হয়ে উঠেছে। ২০২১ সালে মোট ব্যবসার পরিমাণ ছিল ১৫৭৬২৯ কোটি টাকা ( ২১.৬ বিলিয়ন ডলার)। ২০২১-এর ৩১ মার্চে দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ৭০০০ শহরে ১২৭১১টি স্টোর ছিল রিলায়েন্সের।

আবার ভারতের অন্যতম ব্যবসায়ী সংস্থা টাটা, এত বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে তেমন জোরদার ভাবে জুড়ে ছিল না। লোহা লক্করের সঙ্গে, কনজিউমার প্রোডাক্ট যদিও তারা বানাতে শুরু করেছিল সেই ১৯১৭ সাল থেকেই। টাটা অয়েল মিলস কোম্পানি, সংক্ষেপে TOMCO সেই তখন থেকেই বানাচ্ছিল সাবান, ডিটারজেন্ট, রান্নার তেল। তারপর এতগুলি বছরের মধ্যে বাজারে বিক্রয়যোগ্য চা পাতা, লবণ থেকে পানীয় জলের বোতল বানিয়ে টাটার একটা সুনির্দিষ্ট বাজার তৈরি হয়ে গিয়েছে। রিটেল মার্কেটে দোকান খুলে তাদের ব্যবসায় নামা অবশ্য ১৯৯৮ সালে, ওয়েস্টসাইড নামের ব্র্যান্ডের দোকান খুলে। ২০১৯ সালে টাটা গ্লোবাল বিভারেজ এবং টাটা কেমিক্যালস মিলিয়ে দিল তাদের আলাদা ব্যবসা। টাটার ঘড়ির ব্যবসা দেখছে টাইটান ব্র্যান্ড। অলঙ্কারের ব্যবসা তনিশক। ভোল্টাস দেখছে এসি, ইলেকট্রনিক ব্যবসা। কফির রিটেল স্টার বাকস এখন ভারতের মাঝারি শহরগুলিতেও খুলে যাচ্ছে। টাটা কনজিউমার প্রোডাক্টস কোম্পানি, টাটার খাবার এবং পানীয় ব্যবসাকে নিয়ে এসেছে এক ছাদের তলায়।

নতুন ব্যাপার হল, টাটারা ভারতে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে চাইছে। ১০৩ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় থাকা এই গোষ্ঠী এখন কিনে নিতে চাইছে বিভিন্ন ছোট কোম্পানিগুলিকে। টাটা কনজিউমার্স কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার সুনীল ডিসুজা জানিয়েছেন, এব্যাপারে পাঁচটি কোম্পানির সঙ্গে তাঁদের কথা চলছে। তবে কোন কোন কোম্পানি, তা স্পষ্ট করেননি তিনি। ২০১৯ সালে, টাটা কনজিউমার প্রোডাক্টস তৈরি হওয়ার পর থেকেই টাটা গোষ্ঠীর ১৫৩ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যবসাকে স্ট্রিমলাইন করার  চেষ্টা চলছে।  এর ফাঁকে ফাঁকে এই কোম্পানি বোতলে পানীয়জলের কোম্পানি নৌরিশ কো বিভারেজ কোম্পানি, সেরিয়াল ব্র্যান্ড সৌলফুলের মেজরিটি শেয়ার কিনেছে। আর কোভিড পরবর্তী ভারতে ব্যবসা ফিরে আসছে আগের চেহারায় ধীরে ধীরে। টাটার স্টারবাকস, যারা কাফে কফি ডে-র মতো কফি বিক্রি করে, সেরকম আউটলেট ৫০ টা খোলা হয়েছে ২০২১-২২ সালে। এখন ২৬৮টি দোকান রয়েছে ২৬টি শহরে। ডিসুজা জানিয়েছেন তারা এরকম ১০০০ টি দোকান খুলতে চাইছেন।

এই সময়ে ভারতে রিটেল বাজারে প্রচুর খালি জায়গা পড়ে রয়েছে। খেলাটা হচ্ছে, কে, কত তাড়াতাড়ি এর দখল করে নিতে পারে। টাটাদের ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে এমন সময়ে, যখন ইউক্রেনের যুদ্ধ, কৃষি সামগ্রী রপ্তানি বন্ধের নির্দেশ, এবং বিদেশ থেকে আসা জিনিসপত্রের দাম বেড়ে কনজিউমার গুডস নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন, তাদের খরচ বেড়ে গিয়েছে সাংঘাতিক রকম। ইউনিলিভার কোম্পানির ভারতের অংশ, ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রি, ডাবর ইন্ডিয়া এই অবস্থা সামলাতে গিয়ে  প্রোডাক্টের দাম হয় বাড়িয়েছে, নাহলে জিনিসের পরিমান কমিয়েছে। মুশকিল হচ্ছে, ব্যবসাটি প্রচন্ড মূল্য কেন্দ্রিক। দাম বাড়লেই, ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে অন্য কোম্পানির জিনিস কিনতে শুরু করে দেন। টাটাদের অবশ্য তেমন অবস্থা হয় নি। তাদের মুখ্য তিনটি সামগ্রী, কফি, চা এবং লবণের দাম খুব একটা হেরফের হয়নি। ডি সুজা অবশ্য বলেন, পরিবহণ এবং প্যাকেজিং-এর খরচ যথেষ্টই বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার অবস্থাও, চা ব্যবসায় তাদের জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি নিয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কা এবার চায়ের উৎপাদনে মার খেয়েছে। সুতরাং কম মাল আসায়, চায়ের দাম কমেনি। সব মিলিয়ে টাটা গ্রুপের অবস্থা বেশ ভাল। তাই তারা, মার্কেট শেয়ার বাড়াবার জন্যে নতুন নতুন জায়গা খুঁজছেন, নতুন নতুন প্রোডাক্ট নেবেন। সেসব করার জন্যে একই ধরনের ব্যবসায়ে থাকা কোম্পানি কিনবেন।  টাটারা এই ব্যবসার ই কমার্সের দিকটা নিয়ে বেশি জোর দিচ্ছিলেন। এই অংশীদারিত্বের জন্য ওয়ালমার্টের সঙ্গে কথা চলছিল তাদের। পরিকল্পনা চলছে, একটা সুপার অ্যাপ তৈরি করে অনলাইনে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে যাওয়া।

tata

একই রকম চিন্তা ভাবনা রিলায়েন্সও করছে।  কিছুদিন আগেই বিগবাজারের অনেকগুলি দোকান তাদের আওতায় চলে এসেছে। তারাও প্ল্যান করছেন, নিজেদের ব্র্যান্ডে , কনজিউমার গুডস বানাবেন। নিজেদের দোকানেই বেচবেন। অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্রে রিলায়েন্সের সুবিধা হল, তাদের নিজস্ব জিও নেট ওয়ার্কেই প্রায় ৪০০ মিলিয়ন উপভোক্তা আছেন। তাছাড়া এই মুহূর্তে তাদেরই রয়েছে সবচেয়ে বড় রিটেল চেন।

ভারতের রিটেইল মার্কেট আপাতত পৃথিবীর পঞ্চম স্থানে। রিলায়েন্স এর সিংহভাগ দখলে করতে চায়। টাটারাও তাই করতে চাইছে। ভারতের, এই দুই মহারথী ছাড়া, আমেরিকার  আমাজন কোম্পানিও ব্যবসা বাড়াতে চাইছে। এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় কোম্পানি। ভারতের বাজার বিশাল বড়। আপাতত, বেশ কিছু বছর সবার জন্যই খেলার মাঠে বেশ কিছুটা জায়গা রয়েছে।

সব মিলিয়ে একটা বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে স্মার্টফোনে বাজার করতে অভ্যস্ত হতে থাকা ভারতীয়দের জন্য।