বৈশাখ মাসের তৃতীয় শনিবার, ঝকঝকে স্বচ্ছ রোদ উঠেছে চারদিকে। রাস্তার পাশে বড় বেলগাছটার নীচে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন হাফেজ মিয়াঁ। বেলপাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে তাঁর শরীরে। হাফেজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনে টিনের চাতাল দেওয়া ছোট্ট ঘরে ‘মাসানে’র মূর্তিটির পায়ের দিকে। হাফেজের হয়ে ‘মাসান’ পুজোর যাবতীয় কাজ করে দিচ্ছেন তাঁর প্রতিবেশী পঞ্চমী বর্মন। গত চার বছর ধরে এভাবেই হাফেজের হয়ে পুজো দিয়ে আসছেন পঞ্চমী। কোচবিহারের প্রান্তিক জনপদ লালবাজারে এই দৃশ্য একেবারেই বিরল নয়।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ‘মাসানে’র মহত্ব এতটাই যে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামের প্রত্যেক বাসিন্দাই গ্রামকর্তা হিসেবে ‘মাসান’ কে এখনও শ্রদ্ধা করেন। গ্রামবাসীরা মনে করেন, যা কিছু শুভ-অশুভ, ভাল-খারাপ, তার মূলে রয়েছে গ্রামকর্তা ‘মাসানের’ ইচ্ছে’। তাই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে এখনও যে কোনও সামাজিক বা পারিবারিক অনুষ্ঠানের সূচনা হয় এই লৌকিক দেবতার পুজো দিয়ে। উত্তরবঙ্গের লোকজীবনে লৌকিক এই দেবতার মহত্ব অপরিসীম। বেদ-পুরাণের কাহিনীর বাইরে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘মাসান’ কোথাও হয়ে উঠেছে ভয়ের প্রতীক আবার কোথাও সে হয়ে উঠেছে গ্রামবাসীদের ঘরের লোকের মতো আপন। ‘মাসান’কে তাঁরা স্থান দিয়েছেন নদীর পাড়ে, শ্মশানের সামনে, ধান খেতে, গ্রামে ঢোকার মুখে, চৌরাস্তার মাঝে। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বাইরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই লৌকিক দেবতা এখানকার লোকজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আজকাল অবশ্য এই পুজোয় সংস্কৃতায়নের প্রভাব পড়েছে। ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের আবির্ভাব ঘটেছে।
কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির রাজবংশীদের কাছে খুব শ্রদ্ধার এই ‘মাসান ঠাকুর’। অনেকের বিশ্বাস, কালীর ১৮ সন্তানের মধ্যে মাসান সবথেকে বড়, তার জন্ম ভাদ্র মাসের প্রথম শনিবার। স্থানভেদে নাম বদলে গিয়েছে ‘মাসানে’র, প্রচলিত কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে মাসানের রূপের ও বাহনের। এই দুই জেলাতে প্রায় ২৪ রকম ‘মাসানের’ রূপ দেখতে পাওয়া যায়। স্থানভেদে তার নামও বিভিন্ন যেমন- দিনহাটা মহকুমার গোসানীমারীতে ‘গড়কাটা মাসান’(প্রাচীন কামতাপুরের কামতেশ্বর রাজার সীমানা প্রাচীরের স্থানীয় নাম ‘গড়’)। তুফানগঞ্জ মহকুমার শালবড়ী অঞ্চলে পূজা হয় ‘পোড়া মাসানের।’ এখানে পূজার বিশেষ একটি উপকরণ হল পোড়া মাছ। সে থেকেই এর এমন নাম। ভেড়ার পিঠে সওয়ার হন যে ‘মাসান’ তার নাম ‘ভেড়া মাসান।’ মাথাভাঙ্গা মহকুমার ডাঙবোকা গ্রামে পূজা হয় ‘টসা মাসানের।’ এখানে মাসানের বাহন শূকর আর তার একপাশে থাকে শাল মাছ (শোল মাছ নয়)। দিনহাটা মহকুমার সিতাই ব্লকে আছে ‘জলুয়া মাসান।’ জলে বাস করেন বলে তার নাম ‘জলুয়া’। যারা রাতে নদীতে মাছ ধরতে যান তাদের কাছে ‘জলুয়া মাসান খুব শ্রদ্ধার।’ এছাড়াও রয়েছে ‘গদাধর মাসান’, ‘ঘোড়া মাসান’, ‘সিংহ মাসান।’
মাসান যতটা শ্রদ্ধার তার থেকেও বেশী ভয়ের। এই ভয় থেকেই তৈরি হওয়া শ্রদ্ধার কারণে ‘মাসান’কে এখানকার স্থানীয়রা স্থান দিয়েছেন বাড়ির বাইরে, ‘মাসান’ গৃহদেবতা হয়ে ওঠেনি। মাসানের মূর্তিগুলি দেখলেই বোঝা যায়, লোকসমাজে এই ঠাকুরের প্রতি কতটা ভয় রয়েছে। ‘মাসানে’র বেশিরভাগ মূর্তি পদ্মাসনে বসানো থাকে। কোথাও এই মূর্তি মুণ্ডহীন(দিনহাটা মহকুমার আদাবাড়ি গ্রামে এরূপ ‘মাসানের’ নাম ‘গলাকাটা মাসান’) কোথাও সিংহের পিঠে রুদ্রমূর্তি রূপে আবার কোথাও বিশাল আকৃতি বিশিষ্ট গদা হাতে হাতির পিঠে উপবিষ্ট। কল্পনার সঙ্গে ভয় মিশিয়ে মূর্তিগুলি তৈরি করেন স্থানীয় লোকেরাই। মূলত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য মাসানের পুজো করা হয়। তবে স্থানেভেদে পুজোর পার্থক্য রয়েছে। ‘মাসান’ কোথাও সর্বজনীন আবার কোথাও শুধু ওঝা, বৈদ্য, পূজারীর।
‘মাসান’ পুজো হয় দুপুরবেলা। সূর্য যখন মাঝআকাশে। শ্মশানে থাকা ‘মাসানে’র পুজো হয় গভীর রাতে। এই পূজার প্রধান উপকরণ আঁটিয়া কলা (স্থানীয় এক ধরনের কলা, যার ভিতরে অসংখ্য বীজ) দই, লাল রঙের দুটি নিশান। কোথাও কোথাও চালভাজাও দেওয়া হয়। ঠাকুরের সামনে কলা গাছের পাঁচ বা দশটি খোলের মধ্যে চিড়ে দই আঁটিয়া কলা দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি প্রায় সব জায়গাতেই এক হলেও স্থানভেদে পুজোর কিছু বিশেষ পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন, ‘গড়কাটা মাসান’ পুজোর সময় স্থানীয় রাজবংশী সম্প্রদায়ের তৈরি গোবরের ধুপকাঠি জ্বালানো হয়। যতক্ষণ ওই ধুপকাঠিটি জ্বলে ততক্ষণ পুজো হবে। এটা অন্য কোথাও দেখা যায় না। ‘গড়কাটা মাসান’ পুজোয় অনেকে পায়রা বলি দিয়ে মানত করেন। ‘মাসান’ পূজার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এই পুজোর যাবতীয় উপকরণ হতে হবে কাঁচা যেমন- কাঁচা দই, কাঁচা কলা, কাঁচা দুধ।
উত্তরবঙ্গের এখনও অনেক গ্রামের বাসিন্দারা মনে করেন, তাদের গ্রাম ‘মাসান’ দ্বারা পরিচালিত। দীর্ঘদিন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বাইরে থাকা এই পুজোর সমস্ত আচার পালন করতেন স্থানীয় রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এখন ‘মাসান’ পুজোর পদ্ধতিতে ছোঁয়া লেগেছে বেদের নিয়ম কানুনের। অনেক জায়গায় পুজো করছেন ব্রাহ্মণেরা। শাস্ত্রীয় রীতিনীতির বাইরে লোকায়ত বিশ্বাস ও স্থানীয় রাজবংশী সম্প্রদায়ের আন্তরিকতার মিশেল প্রচলিত এই পূজা দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছে তার স্বতন্ত্রতা। অবক্ষয় রোধ খুব দরকারি। তা না হলে রাজবংশী সম্প্রদায়ের এই নিজস্ব পুজো থাকবে শুধু বইয়ের পাতায়। এই লোক-সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে রাজবংশীদেরই।
বেশ ভালো
অত্যন্ত সুলিখিত এবং তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। ছবিগুলো ও যথাযথ। এগিয়ে চলুক বালি হাঁস