কখনও কখনও কোনও ঘটনা গল্পকে হার মানায়। কোন আবিষ্কার বিস্মিত করে আমাদের। এই গল্প এমন একটি পরিবারের গল্প, যাঁরা আর পাঁচজনের মতো সাধারণ নন। যাঁরা হতে পারেন মানুষ ও বাঁদরের মধ্যে একটি মিসিং লিঙ্ক। যে ঘটনার কোনো খোঁজ আগে কখনও বিজ্ঞানের কোনও পত্রিকায় পাওয়া যায়নি। এটা তেমনই একটা ঘটনা।

তুরুস্কের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি গ্রামে বসবাস করে রাজিত আউলেসের পরিবার। রাজিত আউলেস ও তার স্ত্রী ছাড়াও রয়েছে তাঁদের ১৮জন সন্তান। ১৮ জনের মধ্যে ১২ জন গড়পড়তা সাধারণ মানুষের মতো একদম ঠিকঠাক। কিন্তু এই প্রতিবেদন ওই বাকি ছয়জনকে নিয়ে।

কী বৈশিষ্ট এই ছয়জনের? বাকি সব কাজ সাধারণ মানুষের মতো.হলেও পার্থক্য হল, আজ থেকে ৪০ লক্ষ বছর আগে মানুষ যে ভাবে হাঁটতো, তারাও ঠিক সেই ভাবে হাঁটেন। অর্থাৎ, দুপায়ে নয় চার পায়ে। গত কয়েক বছর ধরে, এঁদের অস্তিত্বের কথা জানা ছিল মাত্র কয়েকজন বিশেষজ্ঞের কাছে। তাঁরা বিষয়টিকে গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা এই রহস্য সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছেন। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, এই ছয়জন জীবন্ত জীবাশ্মের (Living Fossil) সমতুল্য যাঁদের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে!

২০০৫ সালের জুন মাসে বিবর্তন বিশেষজ্ঞ জন স্কোয়েলস, রাজিত পরিবারকে নিয়ে তুরস্কের অধ্যাপক উনার তানেরের একটি নিবন্ধ পড়েন। প্রবন্ধটি তখনও কোথাও প্রকাশিত হয়নি। তবে সেটি পড়েই স্কোয়ালস ফোন করেন ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী নিকোলাস হামফ্রেকে। স্কোয়েলসকে সঙ্গে নিয়ে হামফ্রে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়েন ওই পরিবারটিকে দেখতে। তাঁদের সঙ্গী হন অধ্যাপক উনার তান। রাজিত পরিবারের কাছে তাঁরা পৌঁছলে প্ৰথমে ওই ছয়জনের মধ্যে একজন, গুলিনের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা দেখেন, তিনি চারপেয়ে নন, দু’পায়েই হাঁটেন। তবে নেশা না করেও মাদকাসক্তের মতো সারাক্ষণ টলতে থাকে সেই ব্যক্তি। পরে ওই তিন অধ্যাপক-বিজ্ঞানী পরিচিত হন সেই পাঁচজনের সঙ্গে, যাঁরা চার হাত পায়ে হাঁটেন। পাঁচজনের মধ্যে রয়েছে  চার বোন— সাফিয়ে, হাসার, সেনেম এবং এমিন ও তাঁদের এক ভাই হুসেইন। হামফ্রে ওই পাঁচজনকে দেখে প্রথমে অবাক হয়ে যান। বলেন “এটা হয়তো পাঁচজনের জন্য  একটা দুঃখজনক ঘটনা কিন্তু যে ভাবে এঁরা হাটছে, সেটা অনেকটা আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো। যাঁরা মানব বিবর্তনের উপরে কাজ করেন সেই নৃতত্ত্ববিদদের কাছে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক আবিষ্কার।”

আজ থেকে প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে মানুষ প্রথম দু’পায়ে হাঁটতে শুরু করে। তারপর থেকে মানুষ দুপায়ে হাঁটতে অভ্যস্ত হয়েছে। ওই পাঁচজনকে দেখে অধ্যাপক হামফ্রের প্রথমে মনে হয়েছিল, এঁদের এই ভাবে হাঁটার মূল কারণ, জিনঘটিত কোনও অসুবিধা। তিনি এঁদের শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেন। দেখা গেল, এঁদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে কিছু সমস্যা রয়েছে। সেখানে সেরিবেলামের মাঝখানে ভার্মিস খুবই  সঙ্কুচিত। তবে সেই কারণে কেন তাঁরা দুপায়ে হাঁটতে পারছে না, সেটা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। এরপর জার্মানি, ব্রিটেন, ডেনমার্কে বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। বার্লিন থেকে বলা হয়, পুরো বিষয়টিই জেনেটিক। জার্মানরা একটি রিপোর্ট বের করে দাবি করেছেন, ওই পাঁচজনের চারপায়ে হাঁটার কারণ বের করেছেন তাঁরা। কিন্তু সেই রিপোর্ট অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সম্প্রতি ডেনমার্কের আরহাস ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, পরিবারটির ব্যাধির জৈবিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে  Cerebellar Ataxia, Mental Retardation, and Dysequilibrium Syndrome  বা সহজ ভাবে CAMRQ বলা হয়। তাঁদের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কী ভাবে একটি অত্যন্ত বিরল মিউটেশন প্রোটিনকে কোষের ফ্যাট অণুগুলিতে সঠিক ভাবে বিতরণ করতে বাধা দেয়। যা স্নায়ু কোষগুলিকে ত্রুটিযুক্ত করে তোলে এবং মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে মানুষ শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আর এই কারণেই তুরস্কের ওই পরিবারের পাঁচ সদস্য ভারসাম্য বজায় রাখতে হাঁটার সময় তাঁদের হাত এবং পা উভয়ই ব্যবহার করে।

তথ্যসূত্র— সিক্সটি মিনিট অস্ট্রেলিয়া ,সায়েন্সনর্ডিক ও উইকিপিডিয়া