মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন। ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন। প্রান্তিক মানুষের জীবনজীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন।

২৫ মে, ২০০৯। ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত করলো দুই বাংলায়।

আইলার ঠিক আগের দিন। খুলনা ডিভিশনের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার একটি ইউনিয়ন গাবুরা। এলাকাটি কপোতাক্ষ ও খোলপেটোয়া নদীর মোহনায়, তারপরেই সুন্দরবন শুরু। শান্ত সুন্দর সকাল শুরু হয়েছে সেখানে। ওদিকে মাঠে ভিড় করেছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। ঘরের মেয়েরা যে যার কাজে ব্যস্ত। প্রতিদিনের মতো কর্মব্যস্ত সাধারণ জীবন। বেশ কেটে গেল দিনের বেলাটা। পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করলো রাত দশটা থেকে। বাতাস ভারী হয়ে উঠলো, সারা আকাশে মেঘের ঘনঘটা, কুচকুচে কালো হয়ে গিয়েছে সারা আকাশ। রাত বাড়ছে। বাতাস ক্ৰমেই শক্তিশালী হচ্ছে।

পরের দিন সকালে ভারী বাতাস তখন ঝড়ের রূপ নিয়েছে, ঘড়িতে সময় ৯টা। ঝড়ের গতিবেগ ৭০ কিমি প্রতি ঘণ্টা। স্থানীয় প্রশাসন থেকে ঘূর্ণিঝড়ের সাত নম্বর বিপদসঙ্কেত দেওয়া হল। এলাকার অধিবাসীদের ঘর ছেড়ে নিরাপদ কোথাও সরে যেতে বলছে প্রশাসন। কিন্তু সবাই কি পারে সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে ? কিছু মানুষ যেতে পেরেছিল, কিছু থেকে গিয়েছিল গ্রামেই। তারপর, বেলা বাড়ছে সেই সাথে ঝড়ের গতি। ভারী বর্ষণ, জোয়ার আর জলোচ্ছ্বাসের ফলে ভেঙে যাচ্ছে একের পর এক বাঁধ। গ্রামের প্রতিটি ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। একসময় ঝড়ের গতিবেগ গিয়ে দাঁড়াল ১১০ কিমি প্রতি ঘণ্টা। 

আইলার সুন্দরবনে প্রবেশ

 পরদিন সকালে অফিস থেকে আমার কাছে খবর এল, সুন্দরবনে যেতে হবে। আইলা তছনছ করে দিয়ে গেছে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকার বহু গ্রাম। ক্ষতিগ্রস্থ প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ আর সুন্দরবন এলাকার ১১টি জেলা। বেড়িয়ে পড়লাম সুন্দরবনের উদ্দেশে। সেই প্রথম আমার সুন্দরবন যাত্রা। কিছুই তো নেই! বাড়ি ঘর ভেঙেচুরে চুরমার। সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, কলবাড়ি, বুড়িগোয়ালিনী ও দ্বীপ জনপদ,গাবুরা ,পদ্মপুকুর তারপর কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই। এমনকি পিপাসা মেটানোর পানিটুকুও নেই। আমি চেষ্টা করলাম দুর্গত, একরাতের মধ্যে নিঃসম্বল হয়ে যাওয়া মানুষদের কাছে পৌঁছতে। শুনতে হবে তাঁদের কথা, পৌঁছে দিতে হবে বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের কাছে।

কিন্তু অবাক হলাম। ওই ভয়াল, ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে কোনও মানুষ তাঁদের ক্ষতির কথা বলছেন না। বাসস্থান বা খাবারের সমস্যার কথা বলছেন না। তাঁরা বলছেন, অন্য বিপদের কথা !

– ঝড়ের বিপদ তো ফি বছর আসে, চলেও  যায়, কিন্তু আমাদের প্রতিদিন মুখোমুখি হতে হয় আরও বড় বিপদের।

-আরও বড় বিপদ!

-আমাদের তো জঙ্গলই সব, কিন্তু সেই জঙ্গলে যেতে পারছি না।

ওদের কাছে জঙ্গলে যাওয়া মানে কাঁকড়া আর মাছ ধরতে যাওয়া। ওটাই রুজির জায়গা।

– কেন? কেন জঙ্গলে যেতে পারছেন না !

-কি করে যাবো? সারা সুন্দরবন তো বনদস্যুদের দখলে। 

সুন্দরবনের এই এলাকার বেশির ভাগ জেলেরাই বনজীবী। তাঁরা জঙ্গলে যায়, কাঁকড়া ধরে, মাছ ধরে, মধু সংগ্রহ করে। ওইগুলিই ওদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। ক্ষুধার কাছে কোনও  ঝড়, কোনও বাঘ কিছু না। তাই দুর্যোগ নয়, ওদের ভয় সুন্দরবনের বনদস্যু বা জলদস্যুদের।

আইলায় সুন্দরবনের দুর্গতি

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে আমি আইলার নিউজ পাঠালাম। কিন্তু শুধু আইলার খবরের মধ্যে বাধা পরে থাকতে মন চাইলো না। ওদের সাথে কিছুক্ষণ থেকেই বুঝতে পারলাম, এখানকার সমস্যা অনেক গভীরে। এদের জীবনের সব উদ্বেগের মুলে এই অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা দস্যুরা। বিষয়টি মাথায় গেঁথে গেল আমার।

পরদিন আবার গেলাম সেই জনপদে। পরিচয় হলো আরও কিছু লোকের সাথে। কথা হল, গল্প হল। একটু একটু করে মিশে গেলাম ওঁদের সাথে। এঁরা প্রকৃতিকে ভয় পায় না, এমনকি বাঘকেও না। তবে সবসময় তটস্থ থাকে দস্যুদের ভয়ে। কাঁকড়া বা মাছ ধরতে কিংবা মধু সংগ্রহ করতে জঙ্গলে ঢুকলে চাঁদা দিতে হয় দস্যুদের। চাঁদা না দিলে মাছ কেড়ে নেয়। কখনও আবার বন্দি করে রাখে, অত্যাচার করে। তখন মুক্তিপণ দিয়ে খালাস পেতে হয়। ওঁদের কাছে শুনলাম গাবুরার মান্নানের কথা। মান্নানের একটা বাহিনী আছে -‘মান্নান বাহিনী’। এছাড়াও আছে মুন্সিগঞ্জের আলিফের বাহিনী। খুব অত্যাচারী বনদস্যু এরা। তাদেরকে খুব ভয় পায় গাবুরা আর মুন্সিগঞ্জের মানুষ। 

তবে মোতালেবের সম্পর্কে শুনলাম অন্য কথা। পশ্চিম সুন্দরবনের সবচেয়ে বড়ো দস্যুর দলের সর্দার  মোতালেব। সাতক্ষীরা সুন্দরবনের প্রায় সবটাই তাঁর দখলে। মোতালেবের একটা গুণ হল, ছোট ছোট প্রান্তিক জেলেদের উপর কখনই অত্যাচার করে না। কিন্তু বড় জেলেদের জন্য মোতালেব ভয়ঙ্কর এক ত্রাস।

আইলার স্টোরি কভার করে ফিরে এলাম হোটেলে। একটা চিন্তা যেন মাথায় একেবারে গেড়ে বসলো। বার বার মনে পড়তে লাগলো ওই মানুষগুলির ভয় মেশানো কথাগুলি। প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবিকার জায়গা এই সুন্দরবন। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার অর্থনীতি জড়িয়ে আছে সুন্দরবনের সাথে। এখানে কেউ মাছ ধরে ,কেউ কাঁকড়া। শুধু মধু সংগ্রহ করে প্রায় দশ হাজার লোক। এই মানুষগুলির রুজি, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সবটাই আজ সঙ্কটে। মাত্র কয়েকশো দস্যু মিলে কেড়ে নিচ্ছে এঁদের বেঁচে থাকার রসদ. সবসময় তটস্থ রাখছে মানুষগুলিকে। কথাগুলি মনে পড়তেই কেমন একটা অস্বস্তি হতে শুরু হলো। কিছু তো একটা করতেই হবে।

সিদ্ধান্ত নিলাম, সুন্দরবনের দস্যু বাহিনীগুলির সম্পর্কে খোঁজ করবো। যাবো ওদের কাছে। সামান্য কিছু লোকের জন্য এতগুলি মানুষকে বিপদের মধ্যে রাখা ঠিক হবে না।

আগামী পর্বে যাবো মোতালেবের সাথে দেখা করতে। সঙ্গে থাকবেন।

(ক্রমশ)