(সমুদ্র থেকে গঙ্গার মোহনার দিকে পাড়ি দিয়েও শেষ পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ইলিশ। একই অবস্থা রূপনারায়ণে। পশ্চিমবঙ্গ-বিমুখ ইলিশ বাংলাদেশের দিকে ভিড়ছে। জলের রুপোলি শস্যের আকাল নেই পদ্মায়। কিছু ইলিশ চলে যাচ্ছে মায়ানমারের ইরাবতীতে। কী কারণে এসব হচ্ছে, বিশ্লেষণ করেছেন সফিয়ার রহমান।)

বাংলার জলজ রূপোলি শস্য শুধু এদেশে নয়, পৃথিবীতে খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক— সকলের কাছেই কিংবদন্তী হয়ে উঠেছে বাংলার ইলিশ। জন্মদিন, পুজো-পার্বণ, বিয়ের রিসেপশনে ইলিশের বিকল্প নেই। মোদ্দা কথা, যে কোনও অনুষ্ঠানে বাঙালির পাতে ইলিশ না হলে যেন আভিজাত্য থাকে না। এমনকি, বঙ্গবাসী মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধশান্তি বা মৎস্যমুখীতেও ইলিশ রাখে মেনুতে। অথচ সেই ইলিশের ভয়ানক আকাল এপারের বাঙালিকে ভাবিয়ে তুলেছে। ঘোরতর বর্ষা কিন্তু বাঙালির পাতে ইলিশ পড়বে না— এ কখনও হয়? তাই হল এবার। গত কয়েক বছর ইলিশে ভাঁটা ছিল। এবারও আকাল। এই ভরা বর্ষাতেও ইলিশের দেখা নেই। অথচ এ বঙ্গের লক্ষাধিক মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে ইলিশ ধরতে যাওয়া থেকে শুরু করে সেই মাছ বাজারজাত হওয়া পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ নিয়োজিত। তারা পড়েছেন বিপাকে।

কয়েক বছর আগেও কোলাঘাট ভরে উঠত রূপোলি শস্যে। সেই কোলাঘাটের ইলিশ এবার একেবারে মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছে। মৎসজীবীদের চোখেমুখে অনিশ্চয়তার ছাপ। সেই অনিশ্চয়তা থেকে জেগে উঠছে পেশার প্রতি অনীহা ও আতঙ্ক। যত সংখ্যক মানুষ ইলিশ ধরে জীবিকা চালাতেন, সেই সংখ্যাটা এখন কমছে। বার বার লোকসান করে ট্রলার নামাতে চাইছেন না অনেক ট্রলার মালিক। মৎসজীবীরা ভাবছেন অন্য পেশার কথা। কিন্তু কী কারণে ইলিশ মহার্ঘ্য?

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোলাঘাটে রূপনারায়ণের বুকে পাঁচ-পাঁচটা বৃহদাকার সেতু। সেতুর বিরাট বিরাট স্তম্ভে বাধা পেয়ে নদীর স্রোত হারিয়ে যাচ্ছে। সেতুর স্তম্ভ সংলগ্ন নদীগর্ভে নিরন্তর পলি জমছে। নদীর নাব্যতা কমে চর জেগে উঠছে। ফলে ইলিশ আর কোলাঘাটমুখো হচ্ছে না। হুগলি, রূপনারায়ণ ও দামোদরের ত্রিবেণী সঙ্গম গেঁওখালি থেকেই ঝাঁক ঝাঁক ইলিশ রূপনারায়ণে ঢোকে। সেখান থেকেই ইলিশ ফিরে যাচ্ছে। তাছাড়া, রূপনারায়ণ হয়ে কোলাঘাট ঢোকার আগেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহার করে দু’শো-আড়াইশো গ্রামের ছোট ইলিশ ধরে নিচ্ছেন কিছু মৎসজীবী। পরিণত ইলিশ না মেলার এটাও একটা অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মৎসজীবীরা। মীন ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন কেউ কেউ। সেই মীন ধরার সময় অন্য চারামাছের সঙ্গে চারা ইলিশও নষ্ট হচ্ছে। ফলে রূপনারায়ণে ইলিশ বাড়ন্ত।

ইলিশের আকাল পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে

এ তো গেল রূপনারায়ণের কথা। গঙ্গাও তো দু’হাত ভরে উপহার দিত রূপোলি শস্য। তিনিও এখন কৃপণ হয়ে উঠেছেন। জুনের মাঝামাঝি ইলিশ ধরার মরসুম শুরু হওয়ার পর ইতিমধ্যে কেউ কেউ একাধিকবার ট্রলার ভাসিয়েছেন। কিন্তু ইলিশের দেখা নেই। মৎসজীবীদের ফিরতে হচ্ছে প্রায় খালি হাতে। কপালে চিন্তার ভাঁজ ট্রলার মালিকদের। এভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা লোকসান করে কতদিন টানতে পারবেন তারা? কেউ কেউ ঋণ নিয়ে ট্রলার ভাসিয়েছেন। সেই ঋণ শোধ করবেন কী করে?

গঙ্গা বা তার শাখা-প্রশাখার মোহনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ইলিশ। মোহনার কাছাকাছি এসেই তারা ফিরে যাচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের পদ্মায় এবং মায়ানমার ইরাবতীতে। এবারও বাংলাদেশে রূপোলি শস্যের আকাল নেই পদ্মার দাক্ষিণ্যে। মরসুম শুরু হয়েছে মাসখানেক। হতাশ হননি সেখানকার জেলেরা। বাংলাদেশের মৎসজীবীরা আশা করছেন, এবারও তাঁরা দেশবাসীর রসনা তৃপ্ত করতে পারবেন। পারবেনই না-ই বা কেন? গঙ্গা-বিমুখ ইলিশ যে সেখানেই পাড়ি দিচ্ছে। গঙ্গার কোল খালি করে পদ্মার কোল ষোলআনা পূর্ণ করে তুলছে তারা। অথচ এখানে পনেরো-কুড়ি দিন ট্রলার ভাসিয়ে ইলিশ উঠছে সাকুল্যে এক থেকে দেড় মন। লাভ তো দূরের কথা, ট্রলারের খরচও উঠছে না।
গঙ্গায় ইলিশের এমন আকালের আরও নানা কারণ উঠে আসছে। রূপনারায়ণের মতো গঙ্গাতেও অনবরত পলি জমছে। পলি পড়ে গঙ্গার নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। তলদেশ পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর গভীরতা কমছে, স্রোত যাচ্ছে হারিয়ে। স্রোতস্বিনী নদীর গভীর জলই ইলিশের পছন্দ। তা না পেয়ে ইলিশ আর গঙ্গাভিসারে যেতে চাইছে না।
সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অফ ড্যাম রিভার অ্য়ান্ড পিপল (এসএএনডিআরপি) নামক আধা সরকারি সংস্থার মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এসবের মূল কারণ গঙ্গাদূষণ। পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার পাড় বরাবর একশোরও বেশি পুরসভার সমস্ত আবর্জনা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নদীতে মেশে। নদী বরাবর গড়ে ওঠা কারখানাগুলির বর্জ্য বহন করে গঙ্গা। গঙ্গা-দূষণের মাত্রা সীমাহীন বেড়ে গিয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে মিষ্টি জলের গঙ্গায় লবণের মাত্রাও বেড়েছে। অথচ সমুদ্রের লবণাক্ত জলের ইলিশ, ডিম পাড়ার জন্য মিষ্টি জলের গঙ্গায় আসে। দূষণে জেরবার গঙ্গায় আর ফিরতে চাইছে না ইলিশ।
অন্যদিকে, প্রতিবেশী বাংলাদেশের পদ্মা বা তার শাখা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভারী শিল্প তেমন একটা নেই। ফলে নদীবাহিত দূষণে সে দেশের মোহনা ততটা বিষাক্ত হয়ে ওঠেনি। জলের মিষ্টতাও নষ্ট নয়নি গঙ্গার মতো। তাই ইলিশ পদ্মাকে বয়কট করেনি। নৌকা ভরে ইলিশ তুলছেন সেদেশের মৎস্যজীবীরা।

এসএএনডিআরপি-র সমীক্ষা বলছে, গভীর সমুদ্র থেকে গঙ্গার মোহনার দিকে পাড়ি দিয়েও শেষ পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ইলিশ। পশ্চিমবঙ্গ বিমুখ ইলিশ ওপার বঙ্গের খুলনা, চট্টগ্রাম, ভোলা, পটুয়াখালির দিকে ভিড়ছে। কিছু চলে যাচ্ছে মায়ানমারে। টন টন ইলিশে সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ। আর গঙ্গায় ইলিশের দেখা নেই। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে গঙ্গাকে পলিমুক্ত ও দূষণমুক্ত করতে না পারলে একদিন পশ্চিমবঙ্গ থেকে হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে বাঙালির অহংকারের ইলিশ।

2 COMMENTS

Comments are closed.